রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের রাজমুকুটের কোহিনূর হীরার সঙ্গে তুলনীয় সুবিশাল কার্চ স্ট্রেইট ব্রিজে কয়েক দিন আগে ঘটা শক্তিশালী বিস্ফোরণ ইউক্রেনে উচ্ছ্বাস এনে দিয়েছিল বটে, কিন্তু এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ক্রেমলিনের তরফ থেকে ভয়ংকর প্রতিশোধের ভয়ও জেঁকে বসেছিল জনগণের মনে। সেই ভয়ের আশঙ্কা বাস্তব রূপ নিয়ে মুহুর্মুহু ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কেঁপে ওঠে ইউক্রেন। একযোগে চালানো হয় ভয়াবহ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। তবুও ক্রমশ ঠেলে উঠছে ইউক্রেন। এ নিয়ে লিখেছেন মাইকেল বোসিউরকিউ। আজ শেষ কিস্তি।
এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা প্রয়োজন, রেকর্ড সৃষ্টিকারী বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্প গড়ে তুলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলকে সংযুক্ত ও করায়ত্ত করার মধ্যে একপ্রকার অনুপ্রেরণা খুঁজে পেতে দেখা যাচ্ছে স্বৈরশাসকদের। ২০১৮ সালে পুতিন নিজে ট্রাক চালিয়ে ইউরোপের দীর্ঘতম কার্চ ব্রিজটি উদ্বোধন করার পর থেকে এই অঞ্চলকে তিনি কবজায় রাখতে মরিয়া। পুতিনের মতো একই বছর ম্যাকাও ও হংকং পুনরুদ্ধার করার পর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র পারাপার সেতু নির্মাণ করেন এবং সেতুসংলগ্ন সাবেক পর্তুগিজ ও ব্রিটিশ অঞ্চলগুলোকে সংযুক্ত করেন। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত টেলিভিশনসহ দেশের অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান সমালোচনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে পুতিনকে। এই অবস্থায় দাঁড়িয়েও অহংকার ও স্বার্থের মোহে আচ্ছন্ন পুতিনের কাছ থেকে ভালো কিছু পাওয়ার আশা করাটা অরণ্যে রোদন। সত্যিকার অর্থে, তিনি কেবল মারণাস্ত্র চালিয়ে এবং পেশিশক্তির সাহায্যে ধ্বংসযজ্ঞের সূচনা করতে পারেন, হাজার হাজার মানুষ মারতে পারেন। তিনি কেন এমনটা করেন বা করছেন, তার উত্তর সম্ভবত তিনিই ভালো জানেন।ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ও গোয়েন্দা অধিদপ্তরের প্রধান মেজর জেনারেল কিরিলো বুদানভ আগস্টের শেষের দিকে ইউক্রেনীয় সাংবাদিক রোমান ক্র্যাভেটসকে বলেছিলেন, ‘বছরের শেষের দিকে আমাদের ক্রিমিয়ায় প্রবেশ করতে হবে।’ তার এই চিন্তাকে ইউক্রেনীয়রা ব্যাপকভাবে সমর্থন জানিয়েছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল মূলত রাশিয়ান বাহিনীকে ২০১৪ সালের আগের অবস্থায় ঠেলে দেওয়ার একটি পরিকল্পনা। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে উলটো চিত্র। রাজধানীসহ ইউক্রেনের প্রধান শহরগুলোতে ভয়াবহ হামলার মধ্য দিয়ে রাশিয়া দেখিয়েছে যে, দেশটিকে ধাক্কা মেরে পেছনে ফেলে দেওয়া বেশ কঠিন। সোমবারের হামলা রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্বকে ২০১৪ সালের পর সবচেয়ে বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে গেছে। হামলার ধরন দেখে নিশ্চিত করে বলা যায়, কার্চ ব্রিজে বিস্ফোরণের পর পুতিনের উত্তেজনাকর বিবৃতি থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে, কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রগুলো পুতিনের টেবিলে সাজিয়ে রাখা আছে।
তবে রাজধানী কিয়েভে এ ধরনের হামলাকে খাটো করে দেখা ঠিক হবে না আদৌ। পশ্চিমা সরকারগুলোকে একে ‘লাল রেখা অতিক্রম করার শামিল’ হিসেবেই দেখা উচিত। আরো মারাত্মক অস্ত্র ব্যবহার করা ঠেকাতে এখন যে কাজটি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো ওয়াশিংটন ও তার মিত্রদের জরুরি ভিত্তিতে টেলিফোন কূটনীতি ব্যবহার করে চীন ও ভারতকে অনুরোধ করা। এই মুহূর্তে পশ্চিমের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ঐক্য ও সংকল্প ধরে রেখে অগ্রসর হওয়া। তাদের উচিত হবে ইউক্রেনীয়দের সশস্ত্র করা চালিয়ে যাওয়া এবং যোদ্ধাদের জরুরি প্রশিক্ষণ প্রদান করা। এমনকি উচ্চ প্রযুক্তি ও অত্যাধুনিক অস্ত্র সরবরাহসহ বিশেষজ্ঞদের ইউক্রেনের কাছাকাছি রাখার ব্যবস্থা করার বিষয়েও ভাবতে হবে। এছাড়া কিয়েভ এবং দেশের চারপাশে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি অবকাঠামোগুলো রক্ষা করার জন্য উচ্চ প্রযুক্তির প্রতিরক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজন। বাণিজ্য, ভ্রমণসহ আরো বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাশিয়াকে আরো বিচ্ছিন্ন করার বিষয় নিয়েও ভাবতে হবে। এর অংশ হিসেবে বিপুলসংখ্যক রাশিয়ান পর্যটককে দেশে ঢুকতে দেওয়া তুরস্ক ও উপসাগরীয় রাজ্যগুলোকে চাপ দেওয়া জরুরি। উপর্যুক্ত পদক্ষেপগুলোর ঘাটতি পুতিনকে তার ধ্বংসাত্মক সহিংসতা চালিয়ে যেতে রসদ জোগাবে। এর ফলে মানবিক সংকট বাড়বে আরো বহু গুণে। আর এর প্রভাব প্রতিধ্বনিত হয়ে আছড়ে পড়বে সমগ্র ইউরোপে। মনে রাখতে হবে, দুর্বল প্রতিক্রিয়া দেখালে তা জ্বালানি, খাদ্য সরবরাহব্যবস্থা এবং খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে ক্রেমলিনকে উত্সাহ জোগাবে। সুতরাং, দাঁতভাঙা জবাব দিতে দেরি করাটা হবে বড় ধরনের বোকামি। কোনোভাইে ভুলে গেলে চলবে না, ‘এটি একটি বৈশ্বিক যুদ্ধ এবং একে সেভাবেই বিবেচনা করা উচিত।’
(সমাপ্ত...)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct