দেশজুড়ে দুই দশক পূর্বের বিলকিস বানো গণধর্ষণ মামলা নিয়ে তুমুল চর্চা চলছে। গণধর্ষণ মামলায় দোষীদের মুক্তির সিদ্ধান্তে হতবাক দেশের সংবেদনশীল আমজনতা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, এই অব্যাহতির নেপথ্যে রয়েছে আসন্ন গুজরাট বিধানসভা নির্বাচন। যাইহোক, ধর্ষকদের ফুল মালা দিয়ে বরণ আদতে কালিমালিপ্ত করছে ভারতবর্ষের সনাতনী ঐতিহ্য। আলোকপাত করেছেন- ওহিদ রেহমান
এই মর্মে শিরোনামের কোন অভিপ্রায় ছিল না। কিন্তু, সম্প্রতি গুজরাট সরকারের নির্দেশে ধর্ষণে সাজাপ্রাপ্ত ১১ জন নরপিশাচের সমর্থনে এহেন মন্তব্য করেছেন গুজরাটের গোধরা বিধানসভার বিধায়ক সিকে রাউলজি। তিনি পঞ্চমহলের কালেক্টর সুজল মায়াত্রার নেতৃত্বে এই মর্মে গঠিত ‘অব্যাহতি কমিটির’ অন্যতম সদস্য ও বটে। সংবাদমাধ্যমে তিনি বলেছেন, “অপরাধ ঘটিয়েছে কিনা জানি না আমি। তবে জেলে ওদের আচরণ ভাল ছিল। ওরা সব ব্রাহ্মণ সন্তান। মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ। তাদের কোণঠাসা করা এবং শাস্তি দেওয়া কারও খারাপ উদ্দেশ্য হতে পারে।”(!!) হ্যাঁ, মাননীয় বিধায়ক এই বিবৃতিতে একটি বিশেষ ধর্মের ধর্ষণকারীর পক্ষে সদার্থক জোরালো সমর্থন করেছেন। খুব সঙ্গতকারণেই চলে আসে ধর্ষিতার ধর্ম পরিচয়। বিলকিস বানো। ধর্মে মুসলমান। ধর্ষণের শিকার পর্বে বিলকিস পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এবার নিশ্চয়ই আপনি ধর্ষক এবং ধর্ষিতার ধর্মীয় পরিচয়ে আত্মতৃপ্ত(!)। এই অতি সরলীকৃত সমীকরণে নিশ্চয়ই কোন সচেতন মানবিক বোধসম্পন্ন নাগরিক সহমত হবেন না। তবে, দেশে এই বৃত্তের বাইরে সহ নাগরিকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। ফলস্বরূপ, ধর্ষকের পক্ষে রাজপথে মিছিল দেখেছে এই দেশ। সত্যি বড্ড আক্ষেপ হয় তখন। ভারতবর্ষের হাজার হাজার বছরের সনাতনী ঐতিহ্য, ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ এবং ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’ এর ইতিহাসের বিপরীতে সমান্তরালভাবে ফলে ফুলে চাষ হচ্ছে ডানপন্থী ধর্মীয় উগ্রবাদের। দুর্ভাগ্যের হলেও একথা সত্যি যে, এইধরনের পৈশাচিক নিষ্ঠুরতা পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে ক্ষমতাসীন সরকার বাহাদুরের।
বিলকিসের জীবনের সেই কালো দিন:
সময়টা ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষাংশ।
২৭ ফেব্রুয়ারি গোধরায় সবরমতি এক্সপ্রেস ট্রেনে অগ্নিসংযোগের পর পুরো গুজরাট হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। সেই অগ্নিকাণ্ডে ট্রেনের ৫৯ জন করসেবক নিহত হন। রাজ্যজুড়ে সহিংসতার প্রাদুর্ভাবের ফলে, পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা বিলকিস বানো তার সাড়ে তিন বছরের মেয়ে এবং পরিবারের অন্য ১৫ জন সদস্যকে নিয়ে তাদের গ্রামের বাড়ি রাঁধিকপুর থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তারা সকলে ছাপারবাদ জেলায় আশ্রয় নেয়। কিন্তু, না তাদের রেহাই মেলে না। অভিশপ্ত ৩ মার্চ কাস্তে, তলোয়ার ও লাঠিসোঁটা নিয়ে প্রায় ২০-৩০ জনের একটি উগ্রবাদী হিন্দুত্ব গোষ্ঠী তাদের ওপর হামলা চালায়। বিলকিস, তার মা এবং আরও তিনজন নারীকে নির্মমভাবে গণধর্ষণ করা হয়। বিলকিসের চোখের সামনে তার পরিবারের আট সদস্যকে হত্যা করে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সেই গোষ্ঠী। পরিবারের ছয় সদস্য এখনো নিখোঁজ। শুধুমাত্র বিলকিস এবং পরিবারের অন্য দুই সদস্য অপ্রত্যাশিতভাবে এই নরসংহার থেকে বেঁচে যান।একাধিক রিপোর্ট অনুসারে, ঘটনার ঘন্টা তিনেক পরে বিলকিস চেতনা ফিরে পান এবং একজন আদিবাসী মহিলার কাছ থেকে পড়নের কাপড় সংগ্রহ করে অভিযোগ দায়ের করার জন্য লিমখেদা থানায় যান। বিলকিসের ঠাঁই হয় গোধরা ত্রাণ শিবিরে। সেখান থেকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য তাকে একটি সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেইসময় মামলাটি ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন (এনএইচআরসি) এবং সুপ্রিম কোর্ট গ্রহণ করে এবং সিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়।
ধর্ষণের সাতকাহন:
ধর্ষণ প্রসঙ্গে আমাদের সাধারণ মানুষের ধারণা অতি সরলীকৃত। আমাদের অধিকাংশের ধারণা নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপনকে ধর্ষণ বলে। কিন্তু, বিষয়টি এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। ধর্ষণ আসলে একটি নারীর অস্তিত্বকে দুমড়েমুচড়ে ছিন্নভিন্ন করার কৌশল। তাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার উদযাপন, তাকে খুবলে খুবলে মাটিতে মিশিয়ে দেবার আয়োজন, যা তাকে মনে করিয়ে দেয়,- You are nothing but a ‘Object of Sex.’ ধর্ষণ আসলে একটি মানসিকতা। পুরুষতন্ত্রের বেআব্রু বহিঃপ্রকাশ। নারীর স্পর্ধা গুড়িয়ে দেবার সহজ হাতিয়ার ধর্ষণ। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নারী স্বনির্ভরতা আদতে তাকে শত্রু লিঙ্গে পরিনত করেছে এই সমাজ ব্যবস্থায়। মনোবিদদের পর্যবেক্ষণে ধর্ষকদের তিনটি বৈশিষ্ট্য স্পষ্টতই প্রতীয়মানঃ ক্ষমতা (Power), ক্রোধ (Anger) এবং যৌনতা (Sexuality)। অনেকেই আবার, ধর্ষণকে কর্তৃত্ব (Dominance) প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আবার, কিছু গবেষক ধর্ষণের দুইটি শ্রেণীর কথা উল্লেখ করেছেন। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, একটি হচ্ছে Power Rape এবং অন্যটি Anger Rape। তারা মনে করেন, “The use of sex is to express issues of Power or Anger” বিশিষ্ট আমেরিকান সাংবাদিক সুজান ব্রাউনমিলার তাঁর সাড়াজাগানো গ্রন্থ: Against Our Will: Men, Women, and Rape (1975) এ ধর্ষণের নানাবিধ স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। মিস ব্রাউনমিলার এই গ্রন্থে ধর্ষণকে পুরুষাধিপত্য প্রতিষ্ঠার কেন্দ্রীয় উপাদানরূপে তুলে ধরেছেন। ব্রাউনমিলারের পর্যবেক্ষণ,- ধর্ষণ কেবলমাত্র কিছু মনোব্যাধিগ্রস্ত মানুষের কাজ নয়, এটি পুরুষতন্ত্রের ফসল। লৈঙ্গিক রাজনীতিতে ধর্ষণ একটি বড় হাতিয়ার, নারীকে অধীনে রাখার পুরুষের চরমতম পন্থা।
ন্যায়ের অপেক্ষায় বিলকিস:
বিলকিস বানো কান্ডের নেপথ্যে যে সকল কুশীলব ছিল, তাদের রেহাই মিলেছে সরকারি বদান্যতায় (!) জেলের বাইরে তাদের ফুল মালা দিয়ে বরণ করেছেন এই দেশের আমাদের কিছু সহ নাগরিক (!) সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, গুজরাট সরকারের এহেন চূড়ান্ত অন্যায় আর্জিতে সুবজ সঙ্কেত ছিল ‘সব কা সাথ, সাব কা বিকাশ’ বুলি আউড়ানো নরেন্দ্র মোদী সরকারের। মুখ এবং মুখোশের এযেন এক অদ্ভুত সমাপতন। কি চমৎকার ক্রোনোলজি। তাই, বোম্বে হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি মৃদুলা ভাটকর কোন রাখঢাক না রেখেই বলেছেন,- এটা আইনের রায় নয়, এটা ক্ষমতাসীন সরকারের সিদ্ধান্ত। ১৫ আগষ্ট স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের সকালে লালকেল্লায় নরেন্দ্র মোদী প্রায় ৮০ মিঃ ধরে শোনালেন নতুন ভারতের কথা, নারীর ক্ষমতায়নের কথা, লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণের কথা। আর দুপুর গড়িয়ে অপরাহ্নের নরম রোদ গুজরাটের দাহোড জেলার দেবগড় বাড়িয়া কলোনির ছোট্ট ঘরে নামিয়ে আনলো শশ্মানের নীরবতা। হ্যাঁ, বর্তমানে এখানেই স্বামী ইয়াকুব রসুলের সঙ্গে থাকেন মুসলমান ধর্ষিতা (স্বতপ্রণোদিতভাবেই লিখলাম) বিলকিস বানো। না, তাদের কেউ আলাদাভাবে এই বিষয়ে জানানোর প্রয়োজনবোধ করেননি। হয়তোবা গুজরাটের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের নিকট বিলকিস বানোর অস্তিত্বই অনুভূত হয়নি। তার স্বামী ইয়াকুব রসুল সংবাদমাধ্যমে বলেছেন,- তারা বিষয়টি সংবাদমাধ্যম থেকে জেনেছেন। এই প্রসঙ্গে নির্যাতিতা বিলকিস বানোর প্রতিক্রিয়া সভ্য সমাজের মেকি ভদ্রতার খোলস খুলে ফেলেছে নিঃসন্দেহে। তিনি বলেছেন, “আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। এই সাজাপ্রাপ্তদের মুক্তি আমার থেকে আমার শান্তি কেড়ে নিয়েছে এবং ন্যায়বিচারের প্রতি আমার বিশ্বাসকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এই দুঃখ এবং বিশ্বাস নড়ে যাওয়ার বিষয়টি আমার একার জন্য নয়, প্রতিটি মহিলার জন্য। যারা আদালতে ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রাম করছেন, তাঁদের সকলের বিষয় এটা।” সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন ওঠে, ধর্ষিতার মানসিক মনোবেদনা অনুধাবন করার প্রতি কি আমরা সত্যিই সংবেদনশীল ? সত্যিকারের ‘সংস্কারী’ কোন মানুষ কি ধর্ষক হতে পারে ? আর কতদিন ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধকে ধর্ম এবং রাজনীতির চশমায় দেখা হবে ? আসুন আওয়াজ তুলি,- ধর্ষকের কোন ‘ধর্ম’ নেই। ধর্ষক সভ্যতার শত্রু, মানবতার শত্রু। শেষ করবো কাজী নজরুল ইসলামের ‘নারী’ কবিতার কালজয়ী কয়েকটি লাইন দিয়ে-
“বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct