রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের রাজমুকুটের কোহিনূর হীরার সঙ্গে তুলনীয় সুবিশাল কার্চ স্ট্রেইট ব্রিজে কয়েক দিন আগে ঘটা শক্তিশালী বিস্ফোরণ ইউক্রেনে উচ্ছ্বাস এনে দিয়েছিল বটে, কিন্তু এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ক্রেমলিনের তরফ থেকে ভয়ংকর প্রতিশোধের ভয়ও জেঁকে বসেছিল জনগণের মনে। সেই ভয়ের আশঙ্কা বাস্তব রূপ নিয়ে মুহুর্মুহু ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কেঁপে ওঠে ইউক্রেন। একযোগে চালানো হয় ভয়াবহ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। তবুও ক্রমশ ঠেলে উঠছে ইউক্রেন। এ নিয়ে লিখেছেন মাইকেল বোসিউরকিউ। আজ প্রথম কিস্তি।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের রাজমুকুটের কোহিনূর হীরার সঙ্গে তুলনীয় সুবিশাল কার্চ স্ট্রেইট ব্রিজে কয়েক দিন আগে ঘটা শক্তিশালী বিস্ফোরণ ইউক্রেনে উচ্ছ্বাস এনে দিয়েছিল বটে, কিন্তু এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ক্রেমলিনের তরফ থেকে ভয়ংকর প্রতিশোধের ভয়ও জেঁকে বসেছিল জনগণের মনে। সেই ভয়ের আশঙ্কা বাস্তব রূপ নেয় গত সোমবার। এদিন ভোরে মুহুর্মুহু ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কেঁপে ওঠে ইউক্রেন। সমগ্র ইউক্রেনে একযোগে চালানো হয় ভয়াবহ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। প্রথম বারের মতো আক্রান্ত হয় রাজধানী কিয়েভ। এমনকি ক্রুজ মিসাইল ছোড়া হয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার অতি নিকটবর্তী স্থানগুলোতেও। ব্যাপক হারে রুশ বোমাবর্ষণের ফলে ইউক্রেনের বেশ কয়েকটি শহর বিপুল ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। ন্যাটোর পূর্ব দিকের খুব কাছাকাছি পশ্চিম ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলসহ সমগ্র দেশে আক্রমণ চালায় রাশিয়ান বাহিনী। দুঃখজনক বিষয় হলো, এমন একটি সময়ে বোমাবর্ষণ শুরু করে পুতিন বাহিনী, যখন মানুষ তাদের রোজকার কাজকর্ম শুরু করতে যাবে। মানুষ যখন কাজে বের হচ্ছিল, শিশুসন্তানদের স্কুলে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, ঠিক সেই সময়েই ব্যাপক গোলাবর্ষণে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। কিয়েভে অবস্থানরত আমার পরিচিত এক ইউক্রেনীয়কে সে সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখতে দেখেছি, ‘আমি এখন খুবই বাজে অবস্থায় আছি।’
সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে রাজধানী কিয়েভের তারাস শেভচেঙ্কো ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও মাইদান স্কয়ারের কাছাকাছি বোমা পড়তে দেখা যায়। প্রেসিডেন্ট অফিস ভবন থেকে এই এলাকা দুটির দূরত্ব সামান্য হাঁটা পথ। রাজধানীতে চালানো এই হামলায় পাঁচ জন নিহত হয়েছেন বলে জানান ইউক্রেনের কর্মকর্তারা। আঘাত হানা হয় ইউরোপের বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের নিকটবর্তী অঞ্চলেও। নতুন করে আক্রমণের কবলে পড়ে কয়েক দিন আগেই আক্রান্ত হওয়া দক্ষিণ-পূর্ব শহর জাপোরিঝিয়া। শহরের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনগুলোতে ঘুমন্ত মানুষের ওপর বোমা ফেলা হলে অন্তত ১৭ জন নিহত এবং বহু আহত হয়।ঘটনার পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, ‘ইউক্রেন জুড়ে চালানো শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার লক্ষ্য ছিল দেশের শক্তি অবকাঠামো গুঁড়িয়ে দেওয়া। রাজধানী কিয়েভসহ দেশের আটটি অঞ্চলে চালানো হামলায় অন্তত ১১টি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ আক্রমণ করতে করতে রাশিয়ান বাহিনীর এভাবে রাজধানীর খুব কাছাকাছি চলে আসা যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকের দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। পুতিন বাহিনী যেভাবে সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করে, তাতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে রাজধানী কিয়েভবাসী। বেশ কিছু মিডিয়া অফিস তাদের সম্প্রচার সরঞ্জাম কিছু সময়ের জন্য ভূগর্ভস্থ বোমা আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তর করতে বাধ্য হয়। আশ্রয়স্থল হিসেবে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় একটি মেট্রো স্টেশন। দেশাত্মবোধক ইউক্রেনীয় গান গেয়ে প্ল্যাটফরমে জড়ো হওয়া লোকদের সাহস জোগাতে থাকে একটি ছোট দল। সত্যিকার অর্থেই ইউক্রেন জুড়ে বিভিন্ন শহরের লাখ লাখ লোক লম্বা সময় বোমা আশ্রয়কেন্দ্রে কাটাতে বাধ্য হন। ব্যবসা-বাণিজ্য যতটা সম্ভব অনলাইনে চলমান রাখেন উদ্যোক্তারা। স্থানীয় রেডিওতে শোনানো হয় ‘শিক্ষামন্ত্রী শিশুদের জন্য হোম-স্কুলিংয়ের আহ্বান জানিয়েছেন।’
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বিগত কয়েক মাস ধরে ইউক্রেনের বহু অঞ্চল প্রাণ ফিরে পেতে শুরু করেছিল, জনগণ নতুন করে কর্মচঞ্চল হয়ে উঠছিল এবং বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে আশ্রয় নেওয়া বহু লোক দেশে ফিরে আসছিল; কিন্তু সব এলোমেলো করে দেয় ইউক্রেন জুড়ে রাশিয়ার সর্বাত্মক হামলা। এই হামলা জনগণের মনে শুধু ব্যাপক ভীতিই সঞ্চার করেনি; এর কারণে ব্যাবসায়িক আস্থায় তৈরি হয়েছে বড় আঘাতের ঝুঁকি। দেশব্যাপী চালানো সোমবারের আক্রমণ আশ্চর্যজনক ছিল না মোটেই। কেননা, পুতিন এর ঠিক আগের দিন, অর্থাত্ রবিবার কিয়েভকে কার্চ ব্রিজে হামলার জন্য অভিযুক্ত করে একে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ বলে অভিহিত করেছিলেন। পুতিনের এ কথার পরে অনুমিতই ছিল যে, ইউক্রেনে বড়সড় আক্রমণ চালাবে রাশিয়া। বাস্তবিক অর্থে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ড ও ক্রিমিয়ার মধ্যে সংযোগকারী একমাত্র ব্রিজে হামলার ঘটনার পর পালটা হামলা আসার বিষয়কে খুব একটা বাড়াবাড়ি হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। পুতিনের ৭০ তম জন্মদিনের মাত্র এক দিন পরেই কার্চ ব্রিজের মতো স্থাপনায় যে ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটে, পুতিনের জন্য তা ছিল বিরাট আঘাত—মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার শামিল। এরূপ একটি বড় আঘাত ও আক্রমণ ঠেকাতে না পারার লজ্জা ও অপমান সহ্য করার ক্ষমতা একজন বয়স্ক স্বৈরশাসকের জন্য স্বভাবতই কঠিন। এবং এই আঘাতের জবাবে পুতিনের মতো নেতার কাছ থেকে যে পালটা আঘাত আসবে অবধারিকভাবেই, তা ধারণা ছিল সবার।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct