পরিবারের মধ্যে কি বয়োজ্যেষ্ঠ নিখোঁজ?
বার্ধক্য না বাধ্যতা
মোঃ সাহিদুল ইসলাম
গবেষক, ইনস্টিটিউট অফ রুরাল ম্যানেজমেন্ট আনন্দ, গুজরাট
জীবনচক্রের অন্তিম পর্যায় হচ্ছে বার্ধক্যতা যেটি প্রাকৃতিক নিয়মে সর্বজনকে অভিজ্ঞতালব্ধ করতে হয়। জন্মের পর থেকে কৈশোর দশায় পোঁছানো পর্যন্ত যেমন একটি শিশু, পরিবার এবং পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল থাকে তেমনি মনুষ্য জীবনের অন্তিম বা বার্ধক্য দশায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার ও পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে । কিন্তু ক্রমবর্ধমান ভোগবাদী ও পণ্যবাদী সমাজ ব্যবস্থায় ‘বার্ধক্য-কাল’ যেন “বাধ্যতা” বা “অভিশপ্ত” কাল রূপে পরিগণিত হচ্ছে। এই অভিশপ্তর বহিঃপ্রকাশ একটি পরিবার ও সমাজের প্রতিটি পর্যায়ে খুব স্পষ্ট ভাবেই আমাদের খালি চোখেই ধরা পড়ে। চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী, শারীরিক দুর্বলতার সাথে সাথে অসংক্রামিত রোগের মধ্যে ডায়বেটিস, উচ্চরক্ত চাপ, হৃদরোগ সহ বিভিন্ন শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিত্য সঙ্গী হয়ে ওঠে বৃদ্ধ বয়সে। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১০ জন হচ্ছে বৃদ্ধ অর্থাৎ ১৪০ কোটি জনগণের মধ্যে প্রায় ১৪ কোটি মানুষের বয়স ৬০ বছরের বেশি। সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, ২০৫০ সালে আমাদের দেশে বৃদ্ধ বয়সের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুন হয়ে ৩০ কোটির ওপরে দাঁড়াবে। আর যদি পশ্চিমবঙ্গের নিরিখে দেখি, তাহলে পশ্চিমবঙ্গে বর্তমান জনসংখ্যা অনুমিত ১০ কোটির ও বেশি , সেই হিসেবে আমাদের বঙ্গেও বৃদ্ধ বয়সের সংখ্যা প্রায় ১ কোটির ও বেশি দাঁড়ায়। পরিবার পিছু হিসেবে করে দেখলে, প্রতি ৫ টি বাড়ি পিছু ৩ টি করে বৃদ্ধ মানুষ দেখা যায়।
শিল্পায়ন ও নগরন্নোয়ন যুগে আধুনিকতার নামে আমরা সকলেই আজ “ছোট পরিবার, সুখী পরিবার “ মন্ত্র জপ করছি। ‘হাম দো, হামারা দো’ সরকরি স্লোগান ও আজ কোথাও যেন আমাদের খুব সংকীর্ণ মানসিকতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই ছোট্ট-পরিবার কে আরো বেশি ‘খুশি ও সুখী’ বানাতে গিয়ে আমাদের বৃদ্ধ পিতা-মাতা ও বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যকেও যেন কোথায় হারিয়ে ফেলছি। আবার অনেক সময় পরিবারের মধ্যে থেকেও তাঁদের উপস্থিতি কোথায় যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এই ‘হারিয়ে যাওয়া’ ব্যাপারটা দুই ধরণের পরিবারের মধ্যেই কিন্তু বিদ্যমান। প্রথমত, সেই সব ছোট পরিবার যারা হয়তো কাজ-কর্মের সন্ধানে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্বল্প সময়ের জন্যে চলে আসে এবং যারা উচ্চশিক্ষিত স্থায়ী কর্মমুখী হয়ে দেশান্তরে স্থায়ী বসতি স্থাপন করে আর, দ্বিতীয়ত, গ্রামাঞ্চলে ও শহরাঞ্চলে যৌথ পরিবার ভেঙ্গে ছোট ছোট পৃথক পরিবার হয়ে যায় যেখানে বয়োজোষ্ঠ সদস্য তথা পিতা মাতা অবহেলার শিকার হয়ে যায়। তাঁরা নির্ভরশীল হয়ে অসহায়তার শিকার হয়ে পড়ে । অনেক সময় তাঁদেরকে যত্নহীন অবস্থায় ছেড়ে চলে যায় বা অনেক সময় সামর্থ অনুযায়ী বৃদ্ধাশ্রমে স্থায়ী বিছানা বানিয়ে দেয়।
তাঁদের এই অসহায়তা জনিত দুঃখ্, কষ্ট, ক্লেশ, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা বিভিন্ন ভাবে ‘পরিবার’ ও ‘পরিবারের বাইরে’ লক্ষ্য করা যায়। পরিবারের মধ্যে, তাঁরা আপনাপন বা নিজস্বতা খুব সহজেই হারিয়ে ফেলে। শারীরিক দুর্বলতা ও রোগ-জ্বালা-যন্ত্রনাও মুখ বুঝে সহ্য করতে বাধ্য হয়, কেননা শোনার বা যত্ন নেওয়ার মতো কেউ পাশে আর থাকে না। অসহায়তার চরমসীমা বেশি স্পষ্ট হয় যখন শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধক বা বিছানাগত হয়ে যন্ত্রনায় ছটপট করে রাতের অন্ধকারে। শারীরবৃত্তিও প্রক্রিয়ায় বৃদ্ধ অবস্থায় দৈনন্দিন যে পরিমানে পুষ্টি ও খাবার প্রয়োজন হয় সেটাও হয়তো পায়না, রান্নার ক্ষেত্রেও যে মসলা-পাতির ভিন্নতা প্রয়োজন হতে পারে সেটিও হয়তো আমরা প্রাধান্য দিয় না , সবার জন্যে একই মসলা যুক্ত খাবার বানিয়ে থাকি। অধিক বয়সে প্রাকৃতিক নিয়মে অনেক সময় জীবন-সঙ্গীকেও চিরতরে বিদায় জানাতে হয়, যার ফলে, মানসিক ও অনুভূতির দিক থেকে ভেঙে পড়ে ও নিঃসঙ্গতা সহ নানান মানসিক অবসাদের শিকার হতে হয়। তাঁরা শুধু মাত্র শারীরিক ও মানসিক ভাবে অসহায় হয়ে পরে না বরং তাঁদের ইচ্ছা, পছন্দ, স্বাধীনতা সব কিছু ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে পড়ে। পরিবারের বাইরে অর্থাৎ বৃহৎ সমাজেও একই চিত্র আমাদের চোখে পড়ে। হোক সেটা ট্রেন-বাস এ ভ্রমণ করার সময় বা হাসপাতালের লম্বা ওপিডির লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা, সব জায়গাতেই বিদ্যমান বৃদ্ধ বয়সের অসহায়তা । যুব সম্প্রদায় যেন আজ কোথাও তাদের সামাজিক মূল্যবোধ হারিয়ে ডিজিটাল যন্ত্র নিয়ে মেতে উঠেছে, আশে -পাশে দাঁড়িয়ে-থাকা বৃদ্ধ মানুষটির দিকে একবার তাকিয়ে দেখার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলছে, ভালোবাসার হাতছানিটা দিতেও ভুলে যাচ্ছে। অনেক গবেষণালব্ধ পেপার এ দেখা গেছে , যদিও সমস্ত বয়োজ্যেষ্ঠ নির্দিষ্ট সময়ের পরে অসহায়তা অনুভব করে, তবে আর্থিক সামাজিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া বৃদ্ধ লোকগুলো অসহায়তা, শারীরিক দুর্বলতা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে অনেকটাই বঞ্চিত, ধনি-বৃদ্ধ পেনশনধারী চাকরি জীবিদের তুলনায়। আবার সামাজিকভাবে সঙ্গতা গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলে কম।
এটা হয়তো যুক্তিসঙ্গত নয় যে জনকল্যাণকর কোনো সরকারি প্রকল্প নেই, কিন্তু এটা অবশ্যই বলবো যে সেগুলো খুবই নগন্য এবং সেগুলোর সুবিধা পাওয়া খুব মুশকিল হয়ে পড়ে। যেমন, বৃদ্ধশ্ৰী সুবিধা আছে কিন্তু অনেক কম আজকের মূল্যবৃদ্ধির বাজারে, সর্বোপরি জীবনদায়ী ঔষধ । তাই সরকারের আরো বেশি যুক্তিসঙ্গত প্রকল্প ও স্কিম চালু করা খুব প্রয়োজন। পরিবার ও সমাজে তাদের প্রতি যত্ন ও গ্রহণীয়তা, এবং সুযোগ-সুবিধার সুড়ঙ্গ তৈরি করা একান্ত কাম্য। শারীরিক ও মানুসিক অবসাদ এর হাত থেকে রক্ষা করতে তাঁদের জন্যে “দুয়ারে স্বাস্থ্য পরিষেবা” ও পাড়াতে ‘শান্তিলয়” সূচনা, এবং ইমার্জেন্সি মেডিকেল পরিষেবা সহ পঞ্চায়েত ও নগরনিগম পিছু অ্যাম্বুলেন্স এর ব্যবস্থা করা শ্রেয় । বৃদ্ধ বয়সে ‘মালিকানা ও কর্তৃত্ব ‘ এবং অর্থ উপার্জন করার ক্ষমতা না থাকায় অবহেলা ও লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়, সেক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি (NGOs) একসাথে তাদের শারীরিক ও মানসিক কার্যক্ষমতা অনুযায়ী কর্ম উন্নয়ন করে তোলা খুব দরকার। শুধুমাত্র সরকারই নয়, আমরা একজন সুস্থ-মানুষ হিসেবে ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমাদের নিজেদেরকেও সঞ্চয়মুখী ও প্রস্তুতি নিতে হবে। সর্বোপরি, আমাদের যুব সম্প্রদায়ের সব থেকে বেশি অগ্রণী ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয়, কারণ তাদের পিতা-মাতার যেমন কর্তব্য লালন পালন করা তেমনি পিতা-মাতার বৃদ্ধকালেও সেবা-যত্ন করা নৈতিক ও কর্তব্যের তুলনায় আরো অনেক বেশি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct