যে কোনও একটি সম্প্রদায়ের বিশ্বাস অনুসারে, তার অনুসারীদের নিজস্ব ধর্ম থাকতে পারে। কিন্তু কোনো একটি সম্প্রদায় বা পন্থার ধর্ম সমগ্র দেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। পৃথিবীতে বহুত্ববাদী দেশে একটি সম্প্রদায়ের বিশ্বাসকে দেশের স্বধর্ম বলে মেনে নেওয়ার ভুল করা হয়েছে, সেই দেশ ক্রমাগত দুর্বল হয়েছে এবং শেষে ভেঙে পড়েছে।কিন্তু অন্য এক বিশেষ অর্থে দেশেরও স্বধর্ম থাকতে পারে। দেশ যদি একটি রাজনৈতিক সম্প্রদায় হয়, তার নিজস্ব ধর্ম থাকা অসম্ভব নয়। এ নিয়ে লিখেছেন যোগেন্দ্র যাদব। আজ প্রথম কিস্তি।
কীসের ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি যে ভারতের স্বধর্ম আজ আক্রমণের মুখে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য নিবন্ধের প্রথম পর্বে আমি স্বধর্মের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। বোঝাতে চেয়েছি যে স্বধর্ম আমাদের স্বাভাবিক প্রবণতার সেই অংশ, যাকে আমরা সর্বোত্তম হিসেবে গ্রহণ করতে চাই। অর্থাৎ মানব জীবনের আদর্শ হল স্বধর্ম খুঁজে বের করে তাকে অনুসরণ করা। এখন প্রশ্ন জাগে, একটি দেশের কি স্বধর্ম থাকতে পারে? আপনি যদি এর বাইরের রূপটি নিয়ে চিন্তা করেন, তবে কথাটি অদ্ভুত বলে মনে হতে পারে। ধর্ম তাই, যা ধারণ করা যায়। ধারণ করার জন্য প্রয়োজন চেতনাশীল ধারক। তাই একজন মানুষের ধর্ম থাকতে পারে। পশুপাখি বা গাছ-গাছালিরও থাকে। কিন্তু দেশের মত একটা অচেতন সত্ত্বার কীভাবে ধর্ম থাকতে পারে? দেশ যদি মানচিত্রে চিহ্নিত একটি রেখা হয়, তবে তার ইতিহাস এবং আবহাওয়া থাকতে পারে, কিন্তু ধর্ম থাকতে পারে না।
‘ধর্ম’ মানে যদি শুধু ‘রিলিজয়ন’ বা ‘মজহব’ হয়, তাহলে সেটা দেশের ধর্ম হওয়া উচিত নয়। ইংরেজি শব্দ ‘রিলিজিয়ন’-এর ভুল অনুবাদের কারণে এই বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। পছন্দের দেবদেবী বা উপাসনা পদ্ধতির বিশ্বাসকে ‘পন্থা’ বলা উচিত, ‘ধর্ম’ নয়। হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান ইত্যাদি বিভিন্ন পন্থার নাম। স্পষ্টতই, যে কোনো একটি সম্প্রদায়ের বিশ্বাস অনুসারে, তার অনুসারীদের নিজস্ব ধর্ম থাকতে পারে। কিন্তু কোনো একটি সম্প্রদায় বা পন্থার ধর্ম সমগ্র দেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। পৃথিবীতে যেখানে কোনো বহুত্ববাদী দেশে একটি সম্প্রদায়ের বিশ্বাসকে দেশের স্বধর্ম বলে মেনে নেওয়ার ভুল করা হয়েছে, সেই দেশ ক্রমাগত দুর্বল হয়েছে এবং শেষে ভেঙে পড়েছে।কিন্তু অন্য এক বিশেষ অর্থে দেশেরও স্বধর্ম থাকতে পারে। দেশ যদি একটি রাজনৈতিক সম্প্রদায় হয়, তার নিজস্ব ধর্ম থাকা অসম্ভব নয়। সচেতন ব্যক্তির যদি ধর্ম থাকে, তবে সচেতন গোষ্ঠীরও একটি ধর্ম থাকবে। তাই একটি রাজনৈতিক সম্প্রদায় গঠনের প্রক্রিয়া দেশপ্রেমের সংকল্পের চাবিকাঠি। একজন ব্যক্তির স্বধর্মে, ‘স্ব’-এর মাত্রাগুলি তার নশ্বর দেহের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত হবে, তার জন্মের প্রেক্ষিতে (পরিবার, জাতি/শ্রেণী) যুক্ত থাকবে। এবং ‘ধর্ম’ তার মনন, কথা এবং কাজকে নিয়ন্ত্রণ করবে। দেশের মতো সম্প্রদায়ের স্বধর্ম দীর্ঘজীবী – সময় এবং স্থান অনুসারে সংজ্ঞায়িত, জাতীয় মর্যাদা সংজ্ঞায়িত করে। দেশের স্বধর্মকে চিহ্নিত করা এবং সে অনুযায়ী ইতিহাসের চাকা ঘোরানোই প্রকৃত ‘পুরুষার্থ’, যদি না ‘পুরুষ’কে শুধুমাত্র ‘পুংলিঙ্গ’ অর্থে বোঝানো হয়। এখন প্রশ্ন জাগে, দেশের স্বধর্ম কোথায় পাব? এটি খুব গভীর প্রশ্ন। যে দেশ গঠনের প্রক্রিয়া কোনো মতবাদের ওপর ভিত্তি করে হয়, তার স্বধর্ম স্পষ্টভাবে এবং লিখিত আকারে পাওয়া যায়। তবে সেখানেও বিষয়টি সহজ নয়। উদাহরণ হিসেবে ইসরায়েলের কথাই ধরুন। দেশটি গড়ে উঠেছে ইহুদি চিন্তাধারা এবং জাতিগত পরিচয়কে ঘিরে। কিন্তু সেই ভূখণ্ডের আদি ফিলিস্তিনি জনগণ এই চিন্তাধারার ফলে অস্পৃশ্য রয়ে গেছে। এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নও একটি মতাদর্শ ভিত্তিক দেশ ছিল, কিন্তু যখন এটি ভেঙে গেল, তখন মতাদর্শ তাকে একত্রিত রাখতে পারেনি। ইসলামের নামে গঠিত পাকিস্তান নিজের বাংলাভাষী নাগরিকদের বেঁধে রাখতে পারেনি। স্বধর্ম কেবল দলিল, লিখিত আদর্শ কিংবা মতাদর্শের ভিতর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
লেখক ‘স্বরাজ ইন্ডিয়া’র প্রতিষ্ঠাতা।
অনুবাদ: সুদীপ্ত রায়
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct