আজ তারা শুনতে পাচ্ছে ব্রাহ্মণবাদ যুগ যুগ ধরে দলিতদের, আদিবাসীদের পদদলিত করে এসেছে এবং মনুষ্যত্বের কোন মর্যাদা দেয়নি।কথাগুলো এখনও সারা দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েনি তবে অচিরে পড়বে। তোমরা শুনে আকাশ থেকে পড়ছ যে মহিষাসুরের আর এক নাম হুদুড় দুর্গা। তোমরা যখন দুর্গোৎসবে মেতে থাকো তখন নাকি আদিবাসীরা শোক পালন করে; স্মরণ করে তাদের সাহসী, প্রজাদরদী, বীর রাজা মহিষাসুরকে। ছলনাময়ীর ছলনায় নিহত সেই বীরের জন্য আদিবাসীরা ‘হায় হায়’ করে। এ নিয়ে লিখেছেন দিলীপ মজুমদার।
প্রিয় বঙ্গবাসীগণ ,
তোমাদের দুর্গাপুজো শেষ হয়েছে। ভাসান দিয়েছ প্রতিমা। প্রতিমার সঙ্গে আমিও জলের তলায় সমাধিস্থ। তবে কি না, ওই যে কার্নিভালের আয়োজন হয়েছে, তারই কৃপায় কয়েকটি প্রতিমা অক্ষত আছে। তাই আমিও আছি বেঁচে। কথায় বলে, যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। আশ মানে আশা। কিসের আশা আমার? সত্যটা জানানোর আশা। জানি, আমাকে নিয়ে তোমাদের কেউ কেউ বড্ড দোটানায় পড়েছে। এতদিন নির্বিবাদে তারা আমাকে অশুভ শক্তির প্রতীক বলে জেনে এসেছে। মার্কণ্ডেয় পুরাণ, শিবপুরাণ, বামনপুরাণের ভাষ্য সেই রকম।
কিন্তু আজ তারা শুনতে পাচ্ছে দুর্গা-মহিষাসুর একটা ব্রাহ্মণবাদী প্রকল্প; যে ব্রাহ্মণবাদ যুগ যুগ ধরে দলিতদের, আদিবাসীদের পদদলিত করে এসেছে এবং মনুষ্যত্বের কোন মর্যাদা দেয়নি। এ সব নতুন কথা শুনতে পাচ্ছ তোমরা। কথাগুলো এখনও সারা দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েনি তবে অচিরে পড়বে। তোমরা শুনে আকাশ থেকে পড়ছ যে মহিষাসুরের আর এক নাম হুদুড় দুর্গা। তোমরা যখন দুর্গোৎসবে মেতে থাকো তখন না কি আদিবাসীরা শোক পালন করে; স্মরণ করে তাদের সাহসী, প্রজাদরদী, বীর রাজা মহিষাসুরকে। ছলনাময়ীর ছলনায় নিহত সেই বীরের জন্য আদিবাসীরা ‘হায় হায়’ করে।
তোমাদের মধ্যে যারা লেখাপড়া করো , তারা নিশ্চয়ই বলবে , কই এই হুদুড় দুর্গার কথা আমরা তো শুনিনি এর আগে , পড়ি নি তার কথা। তোমরা বলবে শরৎচন্দ্র দে’র ‘মুণ্ডাজ অ্যান্ড দেয়ার কান্ট্রিতে’ হুদুড় দুর্গা নেই, জন ব্যাপটিস্ট হফম্যানের এনসাইক্লোপিডিয়ায় হুদুড় দুর্গা নেই , কে কে লুইভের ‘দ্য অসুর –আ প্রিমিটিভ আয়রণ স্মেল্টার’ এ হুদুড় দুর্গা নেই . বুলেটিন অফ বিহার ট্রাইবাল রিসার্চ ইন্সটিটিউটে হুদুড় দুর্গা নেই , জে এম কুজুরের ‘অসুরস অ্যান্ড দেয়ার ডানসারস’এ হুদুড় দুর্গা নেই। এর পরে তোমরা মহাশ্বেতাদেবীর নাম করবে। ইনি আজীবন আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করেছেন , বীরসা মুণ্ডাকে নিয়ে ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছেন। হুদুড় দুর্গাকে নিয়ে লোককথা থাকলে ইনি নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও তার উল্লেখ করতেন !
না হয় স্বীকার করে নিলাম , আমাকে নিয়ে আদিবাসীদের কোন লোককথা নেই। নেই বলে কি আর হতে নেই ? তোমাদের ঐতিহাসিক নাটক আর উপন্যাসে ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কাল্পনিক চরিত্র গ্রহণ করো কি না ! তা যদি অপরাধ না হয় , তাহলে আমাকে নতুন করে নির্মাণ করাও অপরাধ নয়। আর একটা কথা। তোমাদের হিন্দুত্ববাদীরা রামচন্দ্রকে কি নতুন করে নির্মাণ করে নি ? রামকে আদিকবি ‘পুরুষোত্তম’ বলেছেন , হিন্দুত্বের মুখ বলেন নি কখনও। হিন্দুত্ববাদীরা নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করছেন রামচন্দ্রকে। সেটা যদি অপরাধ না হয়, তাহলে আমাকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করাও অপরাধ নয়। অপরাধ নয় ‘অশুভ শক্তি’ থেকে আমাকে ‘শহিদে’র মর্যাদা দেওয়ায়। আমি তো অজিতের কোন দোষ দেখি না।
অজিত হল অজিত হেমব্রম। মানুষটি নাস্তিক ও বিজ্ঞানমনস্ক। কিন্তু আগ্রাসী হিন্দুত্বের মুখোমুখী হয়ে অস্তিত্বের সুরক্ষার জন্য ব্যাকুল। ২০০৯ সালের কথা। টিভিতে বাবা রামদেবের কথা শুনতে শুনতে তার মনে হল নির্যাতিত খেড়োয়াল সম্প্রদায়ের একটা প্রতীক হতে পারি আমি, মহিষাসুর; আমি হতে পারি সিধু , কানু, বীরসার পূর্বসূরী; আমি হতে পারি তাদের লড়াইএর উপাদান। প্রথমে সে রামায়ণের রাবণকে ধরতে চেয়েছিল। পরে দেখল তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে রাবণ ঠিক খাপ খায় না। তখন ধরল আমাকে।
এ ভাবেই জন্ম হল আমার। এটা নবজন্ম কি না জানিনা। তৈরি হল নতুন মিথ। আমার বাসস্থান হল চাইচম্পা। আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু করল ব্রাহ্মণবাদী আর্যরা। আলপাইন গোষ্ঠীর মানুষের বিরুদ্ধে নর্ডিক গোষ্ঠীর মানুষের চক্রান্ত। এক গৌরবর্ণা, খলস্বভাবসম্পন্না নারীকে পাঠাল আমার কাছে যে প্রেমের অভিনয়ে আমাকে বশ করে প্রহরীবিহীন , অস্ত্রবিহীন অবস্থায় আক্রমণ করল আমাকে। অবশ্য সে জানত অস্ত্র থাকলেও আমি তাকে আক্রমণ করতাম না নারী সম্পর্কে আমার নীতিবোধের জন্য।
অজিতের সঙ্গে হাত মেলালো পুরুলিয়ার চারিয়ান মাহাতো , সুখুয়াপানির সুষমা অসুর, বিহারের প্রেমকুমার মণি প্রভৃতিরা। চারিয়ান তো ছত্র-উৎসব শুরু করে দিল। সে এক ছাতার তলায় সমস্ত আদিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ করতে চায়। কাজে লাগালো দাঁশায় নৃত্যকে । যা ছিল জলের জন্য মানুষের ‘হায় হায়’, তা হয়ে গেল মহিষাসুরের মৃত্যুর জন্য ‘হায় হায়’। এই যে ‘ব্রাহ্মণবাদী প্রকল্পে’র বিপরীতে নতুন ন্যারেটিভ, তার একটা রাজনৈতিক অভিসন্ধি থাকতে পারে ; কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে আদিবাসীদের দুঃখ, বঞ্চনা, নির্যাতন নিছক কল্পিত ব্যাপার। এই হল ব্যাপার। তোমরা একটু ভাবনা-চিন্তা করো। বঞ্চিত অসুরের জন্য একটু চোখের জল ফেলো । অলমিতি বিস্তারেণ।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct