ক্রসেডের আরও এক মহানায়ক নুর আল্ দিন ‘ফকির বাদশা’
ক্রুসেডের আর একটি মহৎ চরিত্র নুর আল্ দিন, তার অনাড়ম্বর জীবন ও ইসলামি নিষ্ঠার জন্য তাকে বলা হত ফকির বাদশা। ক্রুসেডের বিখ্যাত চরিত্রগুলির মধ্যে তিনি একজন। নুর আল্ দিন আবুল কাসিম মাহমুদ ইবনে ইমাদউদ্দিন জানগি ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভূত জানগি রাজবংশীয় শাসক। ১১৪৬ থেকে ১১৭৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি সেলজুক সাম্রাজ্যের সিরিয়া প্রদেশ শাসন করেছেন। তিনি ১১৪৬ থেকে ১১৭৪ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। তার পিতা ইমাদুদ্দিন জানগি দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিলেন। তাঁকেই ‘আতাবেগ’ বলা হয়েছে। তাঁরই মৃত্যুর পর নুর আল দিনের কাহিনির শুরু। ইতিহাসের পাতা থেকে তা তুলে ধরেছেন আব্দুস শুকুর।
৪ আগস্ট ১১৬৭ সালে শাওর ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার পর তিনি মুসলিম এবং ফ্রাঙ্কদের ক্ষতিপূরণ প্রধান করলে উভয় দল মিশর ত্যাগ করে। শাওর ক্রুসেডরদের সাথে চুক্তির বাতিল করার জন্য ১০০,০০০ হাজার স্বর্ন মুদ্রা শ্রদ্ধা হিসেবে প্রধান করেন এবং মিশর ত্যাগ করা আগে আমাল্রিককে ইবেলিনের বালিয়ানের কমান্ডে কাইরোর থাকতে দেন আমাল্রিক মিশর থেকে গেলেও ক্রুসেডররা সেখানে থেকে যায়। কায়রোতে থাকা ক্রুসেডর সেনাবাহিনী স্থানীয় সেনাবাহিনীর সাথে অশান্তি সৃষ্টি করছিল এতে জনগন শাওয়ারের বিরোধিতা করা শুরু করে। তখন কায়রোতে থাকা ক্রুসেডররা আমাল্রিকের কাছে বার্তা পাঠান মিশর এখন সহজেই দখল করা যাবে এবং তারা আমাল্রিককে মিশর দখল করার পরামর্শ দেয় । অবশেষে শাওরের সাথে চুক্তি সন্ধি থাকা সত্ত্বেও আমাল্রিক বিশাল এক বাহিনী নিয়ে নভেম্বরের ১১৬৮ সালে পুনরায় মিশর আক্রমন করেন। ৪র্থ নভেম্বর ১১৬৮ সালে ক্রুসেডররা বিলবাইস দখল করে এবং সেখানের সমস্ত মানুষকে গনহত্যা করে। এর কিছুদিন পর তারা তানিস শহরে আক্রমন করে এবং সেখানেও আগেরমত গনহত্যা চালায় । শাওয়ার আতঙ্কিত হয়ে দ্রুত নুর আল্ দিন জানগির কাছে সাহায্য চান নুর আল্ দিন জানগি তৃতীয় বারের মত শিরকুহকে নেতৃত্ব করে ৭হাজার সৈন্য সহ মিশরে প্রেরন করেন। এই যুদ্ধেও নুর আল্ দিন জানগি জোর করে তার মামার সাথে সালাউদ্দিনকে পাঠান । ২ জানুয়ারী ১১৬৯ সালে কায়রো অবরোধ করার সময় আমাল্রিক যখন জানতে পারেন নুর আল্ দিন জানগির বাহিনী এগিয়ে আসছে তখন তিনি পিছু হটতে শুরু করেন । সবমিলিয়ে শাওরের শাসনের অবসান গঠে ১১ জানুয়ারী ১১৬৯ সালে শিরকুহ যখন কায়রোতে প্রবেশ করেন। ফাতেমীদের খলিফা শাওরের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করেন এবং কায়রোর ক্ষমতা শিরকুহর হাতে ন্যাস্ত করেন ২ মাস পর শিরকুহ ইন্তেকাল করলে সালাউদ্দিন তার স্থলাভিষিক্ত হন। মিশর শাসনের লড়াইয়ে হেরে আমাল্রিক হতাশ হন তবে তিনি পশ্চিমের কাছে আরকেটি ক্রুসেড চালু করার অনুরোধ করেছিলেন। এই অনুরোধে কেবল বাইজাইন্টাইন সম্রাট ম্যানুয়েল প্রথম একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী পাঠিয়ে ক্রুসেডরদের সহায়তা করতে সম্মত হয়েছিল। ডিসেম্বর ১১৬৯সালে বাইজাইন্টাইন এবং ক্রুসেডর জোট ৫০ দিন মিশর অবরোধ করার পর মিশর জয় করতে ব্যার্থ হয়েছিল । এই অবরোধের পর সালাউদ্দিন মিশরে তার অবস্থান আরো সুরক্ষিত করেন। ১০ সেপ্টেম্বর ১১৭১ নুর আল্ দিন জানগির নির্দেশে সালাউদ্দিন আদেশ দেন ফাতেমিদের খলিফার নাম খুৎবা থেকে বাদ দিয়ে আব্বাসি খলিফা নাম যুক্ত করার জন্য। এর কিছুদিন পরে ফাতেমিদের শেষ খলিফা আল আদিদ মারা যান তার মধ্যে দিয়েই ২৭২ বছরের ফাতেমি সম্রাজ্যের ইতি ঘটে। এর কয়েকবছর পরেই ১৫ মে ১১৭৪ সালে নুর আল্ দিন জানগি তার ৫৬ বছর বয়সে দামেস্কে ইন্তেকাল করেন। তার ২৮ বছর রাজত্বকালে তিনি দুর্দান্ত সাফল্য পেয়েছিলে নুর আল্ দিন জানগি একজন জ্ঞানী, দৃড় প্রত্যয়ী, পরিকল্পিত,সাহসী, সচেতন এবং সগ্রামী মানুষ ছিলেন।
তিনি জ্ঞানী সুদক্ষ শাসক ও সেনপতি নির্বাচন করেছিলেন এর ফলে অল্পদিনেই তার রাস্ট্রকে এক মহান সালতানাতে পরিনত করতে পেরেছিলেন। । তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি নিজের লক্ষ্যের প্রতি দৃড় প্রত্যয়ী ছিলেন তার অন্যতম স্বপ্ন ছিল ক্রুসেডরদের তাড়ানো, মুসলিম বিশ্বকে এক করা ফাতেমি সম্রাজ্যের ইতি টানা যা অনাকাংশেই পূরন করেছিলেন তার আরেকটি স্বপ্ন ছিল ইস্তামবুলকে মুক্ত করা। তিনি জিবীত থাকা কালীণ ইস্তাম্বুলকে মুক্ত করার জন্য অনেক উদ্যগ গ্রহন করেছিলেন কিন্তু তিনি তার এই স্বপ্ন পূরন হবার আগেই পরলোক গমন করেন পরে তারই অনুচর সালাউদ্দিন ইস্তাম্বুল বিজয় করেছিলেন । নুর আল্ দিন জানগি ছিলেন একজন মহান মুজাহিদ তিনি ধর্মের প্রতি আন্তরিক , শালীনতা এবং ন্যায়বিচার বোধের জন্য সকলের প্রশংসা পেয়েছিলেন। আল আতির নুর আল্ দিন জানগি সম্পর্কে বলেন আমি পূর্ববর্তী অনেক শাসকের উপর গবেষনা করেছি চার খলিফা ব্যাতীত তার মত ভালো এবং ন্যায়বিচারক শাসক কাউকে পাইনি (Ibn al-Athir, XI, p. 323; the same auth., Târih al-Bâhir fi’d-Devleti’l-Atabekiyye bi’l-Mavsıl,RHC or., II, (part II), Paris 1876, p. 297 f.)। নুর আল্ দিন জানগি আল মালিক বা আল আদিল নামেও পরিচিত ছিলেন তিনি সবসময় তিনি কখনো শক্তীশালী বা দুর্বলদের মধ্যে বৈশম্য করতেন না তার বিচারব্যাবস্থা সবার জন্য সমান ছিল তিনি ভুক্তভোগীরা কথা মনযোগ দিয়ে শুনতেন কখনো অনুমানের ভিত্তিতে কারো উপর শাস্তি চালিয়ে দিতেন না এবং তিনি শরিয়া ভিত্তিতে ইসলামি আদালত চালু করেছিলেন । নুর আল্ দিন জানগি সপ্তাহে দুইদিন আদালতে গিয়ে জনগনের অভিযোগ শুনতেন যেই কেউ ব্যাক্তিগতভাবে তার কাছে অভিযোগ বা তার পরস্থিতির বর্ননা করতে পারতো। নুর আল্ দিন জানগি ন্যায়বিচারকে শ্রদ্ধা করতেন এবং অন্য যে কোন কিছুর চেয়ে এটাকে এত গুরুত্ব দিতেন যাতে তিনি নিজে বিচার এড়াতে না পারে। একবার, একজন ব্যক্তি যিনি নিজেকে নুর আল্ দিন জানগির ঋণগ্রহীতা বলে দাবি করেন, তিনি তাকে বিষয়টি আদালতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন । নুর আল্ দিন জানগি ওই ব্যাক্তির সাথে পায়ে হেটে কামাল আলদিন ইবনে শাহজুরির আদালতে যান এবং তাকে বার্তা দেন সবাইকে আচরন করেন তার প্রতি যেন তেমনটাই আচরন করেন এবং কারো পক্ষে যেনো তিনি ঝুকে না পড়েন। নুর আল্ দিন জানগি কাজির সামনে ততক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলেন যতক্ষন না কাজি বিচারের উপসংহার টেনেছে কাজি রায় দেন বাদীর দাবি সত্য নয় উল্টো নুর আল্ দিন জানগি বাদীর কাছে পাওনা ছিলেন তা সত্তেও নুর আল্ দিন জানগি সবার সামনে তাকে করা সম্পত্তি প্রধান করেন (Ibn al-Athir, XI, p. 323)। নুর আল্ দিনের ন্যায়বিচারের খ্যাতি এমন ছিল যে পার্শ্ববত্তী খ্রিষ্টানরাও তার প্রশংসা করতো একবার এক খ্রীষ্টান দামেস্কে ভ্রমন করলে তিনি সেখানে বসবাসের সিন্ধান্ত নেন । নুর আল্ দিন জানগির মৃত্যুর পর যখন সালাউদ্দিন দামেস্কের শাসনভার গ্রহন করেন তখন সালাউদ্দিন এক শাসক ওই খ্রীষ্টান ব্যাক্তিকে আঘাত করে তখন ওই ব্যাক্তি সালাউদ্দিনের কাছে গিয়ে চিকিৎসার জন্য সাহায্য চান কিন্তু সেই সময়ে তার আর্জি সালাউদ্দিনের কাছে যাওয়ার জন্য অনুমোদিত ছিল না। তখন সেই খ্রীষ্টান ব্যাক্তি কাঁদতে কাঁদতে প্রসাদ থেকে নেমে এসে নুর আল্ দিন জানগির কবরে পাশে গিয়ে কাঁদতে থাকেন এই খবর শুনা মাত্রই সালাউদ্দিন উক্ত ব্যাক্তির তলব করেন এবং তার সকল সমস্যার সমাধান করেন লোকটি আগের থেকে আরো জোরে কাঁদতে থাকেন তখন সালাউদ্দিন তাকে জিজ্ঞেস করলেন এরপরেও আপনি কাদছেন কেনো তখন লোকটি উত্তর দিলো আমি সুলতান নুর আল্ দিন জানগির জন্য কাঁদছি তিনি মৃত্যুর পরও আমাদের প্রতি ন্যায়বিচার করছেন (Ibn al-Athir, al-Bâhir, p. 304)। সালাউদ্দিন বলতেন আমি ন্যায়বিচার শিখেছি নুর আল্ দিন জানগির কাছে।
নুর আল্ দিন জানগির কর নীতিও ন্যায়বিচারের উপর ভিত্তি করে ছিল তিনি মিশর, সিরিয়া, আল-জাজিরা এবং মওসিলের উপর এক ধরনের ঐতিহ্যবাহী ভারী কর মুকাস ও তিতার এর বিলুপ্ত ঘটান। নুর আল্ দিন জানগি পরিবারের চাহিদা পূরন করতেন নিজের টাকা দিয়ে তিনি গনিমতের থেকে শুধু নিজের প্রাপ্ত অংশ নিতেন এর বেশি তিনি গ্রহন করতেন না এই ব্যাপারে তিনি ফকিহ দের কাছে ফতোয়া জানতে চেয়েছিলেন ফতোয়া অনুসারে তার প্রাপ্ত অর্থ গ্রহন করতেন। ইনবে আতির তার বইতে লেখেন একবার নুর আল্ দিন জানগির স্ত্রী ইসমাত আল-দ্বীন নুর আল্ দিন জানগির কাছে অভিযোগ করেন যে তার পরিবার চালানোর জন্য তার কাছে প্রয়জনীয় অর্থ ও সম্পদ নেই। এই অর্থনৈতিক মন্দা কাটানোর জন্য তিনি তিনি হিমসে৩ টি দেন যা বছরে ২০ দিনার উৎপাধন করতো। যখন তার স্ত্রী এই আয়কে অপর্যাপ্ত মনে করলেন তখন নুর আল্ দিন জানগি তার স্ত্রীকে ধমক দিয়ে বলেন আমার কাছে আর কোন টাকা নেই আমার হাতে টাকা থাকা সমস্থ অর্থ এবং সম্পত্তি মুসলিম জনগনের যাদের আমি কোষাধ্যক্ষ তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার করার সাহস করিনা আর আমি তোমার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে জাহান্নামে যেতে রাজি নই (al-Bâhir, p. 298)। নুর আল্ দিন জানগি সংসার ও সম্পত্তিকে গুরুত্ব দিতেন না, বিশুদ্ধ জীবন যাপন করতেন, সোনা-রূপা বা রেশমের পোশাক পরতেন না; তিনি একজন সংযত এবং মধ্যপন্থী ব্যক্তি ছিলেন এমন কি তার রাজ্যের দরিদ্রতম ব্যাক্তিও তার থেকেও বেশি খরচ করতো।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct