রবীন্দ্রনাথ জাতি,ধর্ম, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাইকে এক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন এই অক্টোবর মাসেই, যাতে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। আর আজ সেই অক্টোবর মাসেই এই বাংলায় হিন্দুত্ববাদীরা গান্ধীজিকে অসুর বানিয়ে বাঙালির ঐক্যের ভিতকে নাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করল! দুর্গোৎসব হল বৃহত্তর বাঙালি সমাজের একটা মিলন প্রাঙ্গণ। এই উৎসবে গান্ধীজিকে অসুর বানিয়ে বিতর্ক উস্কে দেওয়ায় যে নিম্নমানের রাজনীতির আগমন ঘটানো হল অবশ্যই তার প্রতিবাদ হওয়া দরকার এবং নিন্দা করা উচিত। এ নিয়ে লিখেছেন সনাতন পাল।
১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন স্বদেশ পর্যায়ের সেই গান, যে গানের সুর এবং কথা পৌঁছে গিয়েছিল বাংলার ঘরে ঘরে। বাংলার মানুষ সেই গান আপন কন্ঠে গুনগুনিয়ে গাইতে শুরু করেছিলেন-” বাংলার মাটি,/ বাংলার বায়ু, বাংলার ফল/ পুণ্য হউক, পুণ্য হউক/ পুণ্য হউক, হে ভগবান/..... । এমন কি সেই গান আজও ঘুরে বেড়ায় মানুষের মুখে মুখে। কবিগুরু ১৯০৫ সালের ১৬ ই অক্টোবর রাখি বন্ধন উৎসব করেছিলেন, এই গানই ছিল সেদিনের মূলমন্ত্র। রবীন্দ্রনাথ জাতি,ধর্ম, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাইকে এক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন এই অক্টোবর মাসেই, যাতে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। আর আজ সেই অক্টোবর মাসেই এই বাংলায় হিন্দুত্ববাদীরা গান্ধীজিকে অসুর বানিয়ে বাঙালির ঐক্যের ভিতকে নাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করল! উৎসব সব সময় মানুষে মানুষে মিলন ঘটায়, ভাবের হাটে মতের বিনিময় হয়, পুরাতন আত্মীয় ঝালিয়ে নিয়ে নতুন করে পথ চলা শুরু হয়। দুর্গোৎসব হল সমস্ত বাঙালির একটা মিলন প্রাঙ্গণ। এই মহা মিলন উৎসবে গান্ধীজিকে অসুর বানিয়ে বিতর্ক উস্কে দেওয়াতে যে নিম্নমানের রাজনীতির আগমন ঘটানো হল অবশ্যই তার প্রতিবাদ হওয়া দরকার এবং নিন্দা করা উচিত। এমন ভাবে পুজোকে যদি দলীয় সংকীর্ণ রাজনীতি বিভাজনের তরবারি নিয়ে জড়িয়ে ধরে মানবতার উপরে লুটিয়ে পড়ে তাহলে অবশ্যই পুজোর পবিত্রা নষ্ট হয়।
গান্ধীজির আন্দোলনের ধরণ নিয়ে কারো কারো মনে প্রশ্ন থাকতেই পারে, এতে দোষের কিছু দেখি না। আবার অনেকে একথাও বলতেই পারেন যে, গান্ধীজি চাইলে হয়তো নেতাজী কে দেশ ছাড়তে হতো না, ভগৎ সিং এর ফাঁসি রদ হতো। এসব কথা আমার মনেও আসে । কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনে গান্ধীজির অবদানকে কখনই অস্বীকার করা যায় না। আবার দেশের ধর্মনিরপক্ষেতা রক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অবশ্যই চিরস্মরণীয়। একটা অতি সাধারণ প্রশ্ন- গান্ধীজি যদি ধর্মনিরপেক্ষ না হতেন,তাহলে কি নাথুরাম গডসের হাতে তাঁর মৃত্যু হতো ? অর্থাৎ একথা জোরের সাথেই বলা যায় যে,ধর্মনিরপক্ষেতার স্বার্থে তাঁকে নিজের জীবন টাই বলিদান দিতে হয়েছে। গান্ধীজি হলেন এদেশে ধর্মনিরপক্ষেতার একটা স্তম্ভ। এই স্তম্ভ কে আঘাত করা মানেই মূল ভিতকেই নড়িয়ে দেবার চেষ্টা করা। বর্তমানে সেটাই চলছে। সারা বিশ্ব যে মানুষ টাকে রাষ্টপিতা হিসেবে জানে এবং মানে আজ সেই মানুষটাকেই নিজের দেশে অসুর সাজানো হচ্ছে! এতে কি বিশ্বের দরবারে দেশের সুনাম বাড়ছে?কখনই নয়। আসলে তো রাষ্ট্র পিতাকে অপমান করা মানে স্বয়ং রাষ্ট্রকেই অপমান করা। যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে সেই রুবি পার্কে হিন্দু মহাসভার আয়োজিত এই পুজোর প্রধান উদ্যোক্তা হলেন চন্দ্রচুর গোস্বামী । কেন্দ্র এবং রাজ্যের শাসক দলের মধ্যে এই ঘটনায় কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু হয়েছে। কিন্তু শোনা যাচ্ছে যে এই চন্দ্রচুর গোস্বামী নাকি গত বিধানসভায় ভবানীপুর থেকে নির্দল ক্যান্ডিডেট ছিলেন। অর্থাৎ যাকে বলা হয় ড্যামি ক্যান্ডিডেট। এ ধরণের ক্যান্ডিডেট দেওয়ার মূল উদ্দেশ্যই হলোকাউন্টিং-এ নিজেদের বাড়তি কাউন্টিং এজেন্ট ঢোকানো। এই কাজ সাধারণত শাসক গোষ্ঠী ই করে থাকে। এ বিষয়ে কি কারো কোনো ভিন্ন মত আছে? থাকলে উদাহরণ সহ বলতেই পারেন।
শোনা যাচ্ছে যে এই চন্দ্রচুর গোস্বামীর ক্যান্ডিডেট ফর্মে প্রস্তাবকরা নাকি বিজেপির নয়। তাহলে কি কেন্দ্র এবং রাজ্যের শাসক দল উভয়ে মিলেই কেউ ক্যান্ডিডেট আর কেউ প্রস্তাবক? যদি এটাই সত্যি হয়,তাহলে কেন? উভয়ে যোগসাজস করেই কি রাজ্যে হিন্দুত্বের জিগির জিইয়ে রাখতে চাইছে ? যদি এই ফর্মুলাই কাজ করে,তাহলে দেশের ধর্মনিরপক্ষেতা বজায় রাখার স্বার্থে সাধারণ মানুষকেও ভাবতে হবে। তবে একথাও ঠিক যে, রাজ্যে বিগত দিনে হিন্দুত্ববাদীদের এতো রমরমা ছিল না- এখন যেটা হয়েছে। কিন্তু কেন এসব চলছে? যাতে ভোটের মেরুকরণ ঘটে! নাকি অন্য কোনো কারণ আছে? ভোটের রাজনীতি যদি এতোটাই নিন্মমানের নোংরা খেলা হয়, তাহলে মানুষের উন্নয়নের জন্য রাজনীতি কখন হবে? মানুষের মঙ্গলের জন্য ভাবনা কখন হবে? আরও একটা প্রশ্ন মনে জাগে - এখনই বা এ ধরণের রাজনীতির চাল দেওয়া হল কেন? এটা কি দুর্নীতির প্রচারকে চাপা দিতে! মানুষের অভিমুখ ঘুরিয়ে দিতে? কিন্তু বাস্তব সত্য তো এটাই- এ ধরনের নোংরা রাজনীতির চালে বর্তমানে রাজ্যে উঠে আসা দুর্নীতির প্রচারকে চাপা দেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। কারণ আজ মানুষের কাছে সব উলঙ্গ হয়ে গেছে। এই লেখাটা লিখছি মানেই কোনো দলীয় রাজনীতির স্বার্থে লিখছি এমন নয়- কোনো রাজনৈতিক দলের ঠিকা নিয়ে রাখিনি। মানুষের সামনে যে বিপদ ঘনিয়ে আসছে সেটাই তুলে ধরার চেষ্টা করছি মাত্র।
লেখক বিশিষ্ট শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct