ক্রসেডের আরও এক মহানায়ক নুর আল্ দিন ‘ফকির বাদশা’
ক্রুসেডের আর একটি মহৎ চরিত্র নুর আল্ দিন, তার অনাড়ম্বর জীবন ও ইসলামি নিষ্ঠার জন্য তাকে বলা হত ফকির বাদশা। ক্রুসেডের বিখ্যাত চরিত্রগুলির মধ্যে তিনি একজন। নুর আল্ দিন আবুল কাসিম মাহমুদ ইবনে ইমাদউদ্দিন জানগি ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভূত জানগি রাজবংশীয় শাসক। ১১৪৬ থেকে ১১৭৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি সেলজুক সাম্রাজ্যের সিরিয়া প্রদেশ শাসন করেছেন। তিনি ১১৪৬ থেকে ১১৭৪ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। তার পিতা ইমাদুদ্দিন জানগি দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিলেন। তাঁকেই ‘আতাবেগ’ বলা হয়েছে। তাঁরই মৃত্যুর পর নুর আল দিনের কাহিনির শুরু। ইতিহাসের পাতা থেকে তা তুলে ধরেছেন আব্দুস শুকুর।
আল্ দিন জানগি ফ্রাঙ্কদের ব্যাস্ত রাখতে বানিয়াসে আক্রমন করেন। এদিকে দিরগাম কোন উপায় না দেখে কিছুদিন আগে আক্রমন করা জেরুজালেমের রাজার কাছেই সাহায্য চান (বিষয়টা কেমন না এতেই বুঝা যাচ্ছে দিরগামের সাথে জেরুজালেমের যোগসূত্র ছিল আর জেরুজালেমের রাজা দিরগাম কেই রাখতে চাইছিল যেনো তাকে সরিয়ে মিশর দখল করতে পারে) জেরুজালেমের রাজা আম্রালিক প্রথম এই যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করার আগেই শিরকুহ দিরগামের ভাইয়ের নেতৃত্বে পেলুসিয়ামের নিকট একটি বাহিনীকে পরাজিত করে। অবশেষে ১১৬৪ দিরগামের মৃত্যুর পর শাওর তার উজিরের পদ ফিরে পান। শাওর ছিলেন একজন কুচক্রী লোক এর আগেও তিনি ক্ষমতায় থাকা কালীন অনেক ফাতেমিদের নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন এবং তার অনেক অংশীদারকেও হত্যা করছিলেন এমনকি তার রাজধানী ফুসতাত কেও জ্বালিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে শত্রুরা সেই শহর না পায় এমন কর্মকান্ড দেখে দিরগাম তাকে বরখাস্ত করেছিলেন। এদিকে শাওর ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার পর চুক্তি লঙ্গন করে নুর আল্ দিন জানগি সেনাপতি শিরকুহ কে মিশর ত্যাগ করতে বলেন শিরকুহ শাওর এর এমন কর্মকান্ড দেখে এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে তিনি বিলবাইসকে আক্রমন করে তা দখল করে নেন। এই শাওর মূহুর্তে জোট বদলের জন্য কুখ্যাত ছিলেন তিনি শিরকুহ কে দমানোর জন্য জেরুজালেম এবং ক্রুসেডরদের সাথে জোট করেন। শাওর ক্রুসেডরদের কাছে থেকে শিরকুহর বিরুদ্ধে সামরিক সাহয্য চান এর বদলে এই অভিযানের প্রতিটি মারহালার জন্য এক হাজার দিরহাম এবং নাইটস এবং হসপিটালের ঘোড়ার খাদ্য ব্যয় বহন, এবং আরো দামী উপহার দিবেন বলে চুক্তিবদ্ধ হন (মারহালা তখনকার সময়ের রাস্তার দূরত্ব বুঝানো হতো আর জেরুজালেম থেকে নীল নদ পর্যন্ত ছিল ২৭ মারহালা)। কিছুদিনের মধ্যে ফাতেমী এবং ক্রুসেডর মিত্র বাহিনী বিলবাইসকে অবরোধ করে। এদিকে নুর আল্ দিন জানগি জেরুজালেমের রাজা আমাল্রিককে মিশর ত্যাগ করার জন্য ফাঙ্কের ভূমিতে আক্রমন করেন কারন তিনি সরাসরি শিরকুর কাছে যেতে পারছেন যেতে হলে খ্রীষ্টানদের সিমানা দিয়ে যেতে হবে ।নুর আল্ দিন জানগির রাজ্য সিরিয়া থেকে মিশরের পথে ছিল লিবিয়া তা ছিল খ্রীষ্টানদের দখলে। তিনি সিরিয়া থেকে বেরিয়ে লিবিয়াতে আক্রমন করেন এই যুদ্ধ আল বুকাইয়া যুদ্ধ নামে পরিচিত যা ১১৬৩ সালে সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে জেরুজালেম সম্রাজ্য, বাইজাইন্টাইন এম্পায়ার, প্রিন্সপালিটি অফ এন্টিওক, কাউন্টি অফ ত্রিপলি একত্রিত হয়ে যৌথ বাহিনী গঠন করে নুর আল্ দিন জানগিকে আক্রমন করে । তাদের এমন যৌথ আক্রমনে নুর আল্ দিন জানগির বাহিনী কিংকতব্যবিমূড় হয়ে যায় এবং নুর আল্ দিন জানগি বাহিনী পরাজয় করে। এই যুদ্ধে নুর আল্ দিন জানগি প্রায় মরতে মরতে বেচেঁ যান। এই বিজয়ের ফলে খ্রীষ্টানদের আত্মবিশ্বাস কয়েক গুনে বৃদ্ধি পায়।
অন্যদিকে ১২ আগস্ট ১১৬৪ মসুলের আমীর কুতুবদ্দিন মওদুদ আর্টকুইট শাসক ফখরুদ্দিন ওরা আরসলান (হিসান কেইফার আমীর) এবং নাইমউদ্দিন আলপি (মারডিনের আমির) এর সহযোগিতায় ৭০ হাজার অশ্বারোহী এবং ৪০ হাজার পদাতিক সৈন্য জড় করেন এবং হারিম অবরোধ করেন। এই দূর্গ এন্টিওকের প্রতিরক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ন ছিল সেন্ট ভ্যালারি রিনাল্ড এন্টিওক রাজ্যের সিমানায় থাকা ফ্রাঙ্কের কাছে সাহায্য চান। ভ্যালারির সাহায্যে সাড়া দিয়ে এন্টিওকের প্রিন্স বোহেমন্ড তৃতীয়, ত্রিপোলির কাউন্ট রেমন্ড তৃতীয়, বাইজেইন্টাইন গভর্নর কনস্ট্যান্টাইন কালামোনস, আর্মেনিয়ার লর্ড থোরাস এবং এডেসার কাউন্ট তৃতীয় জোসেলিন মিলে ১৩ হাজার সৈন্য জড় করে এবং হারিমকে সাহায্য করার জন্য দ্রুত ছুটে আসে। যখন নুর আল্ দিন জানগি তার ভাই কুতুবদ্দিন মওদুদ সাথে যোগ দেন তখন সবাই অবরোধ তুলে ফিরে যাচ্ছিল (অনেকের মতে এইটা নুর আল্ দিনের কৌশল ছিল)। খ্রীষ্টানদের উৎসাহ উদ্যম তখন ছিল তুঙ্গে কারন তারা ইতিমধ্যে আল বুকাইয়ার যুদ্ধে বিজয় লাভ করেছিল তারা আর্মেনিয়ার লর্ড থোরিসের পরামর্শ উপেক্ষা করে নুর আল্ দিন জানগি এবং কুতুবদ্দিন মওদুদের পিছনে দাওয়া করে আর্তাহ এর কাছে পৌছায়। আর্তাহ তে নুর আল্ দিন জানগি ও কুতুবদ্দিনের বাহিনী পাল্টা আক্রমন করে তাদেরকে জলাভূমি দিকে ঠেলে দেয় এবং এক অবিশ্বাস্য বিজয় লাভ করে। এই যুদ্ধে ১০ হাজার খ্রীষ্টান সৈন্য নিহত হয় এবং সকল নেতাদের বন্দি করা হয় শুধুমাত্র আর্মেনিয়ার লর্ড থোরেস ছাড়া তিনি যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যেতে সফল হন। এন্টিওকের যুবরাজ বোহেমন্ড তৃতীয়, ত্রীপলির কাউন্ট রেমন্ড তৃতীয়, বাইজাইন্টাইন গভর্নর কনস্ট্যান্টাইন কলোমানোস এবং লুসিগানের হিউকে শিকল বেঁধে আলোপ্পোতে প্ররন করা হয়।
ক্রুসেডরদের আরতাহ তে হারানো পর নুর আল্ দিন জানগি হারিমে ফিরে আসেন এবং তা নিয়ন্ত্রণে নেন এবং কিছু দিনের মধ্যে বানিয়াস ও বিজয় করেন এই শহরগুলো ১১৪৯ থেকে খ্রীষ্টানদের দখলে ছিল। নুর আল্ দিন জানগিকে সকলে পরামর্শ সত্ত্বেও তিনি এনন্টিওক আক্রমন করেন নি করেন নি কোন এক কারননে। জেরুজালেম এর রাজা আমরাল্রিক দ্বিতীয় যখন দেখলো নুর আল্ দিন জানগি হারিম এবং বানিয়াস দখল তখন তিনি শিরকুহ এর উপর অবরোধ তুলে নিয়ে মিশর ত্যাগ করে। এরপরে আমাল্রিক দ্বিতীয় বানিয়াসে আক্রমন করেন কিন্তু তার এই চেস্টা নুর আল্ দিন জানগির বাহিনী ব্যার্থ করে দেয়। কিছুদিন পর নুর আল্ দিন জানগি এন্টিওকের রাজপুত্র এবং সিলিসিয়াসের গভর্নর কনস্টাইনকে স্বাধীন করে দেন। মুক্তিপন এবং প্রচুর মুসলিম বন্দীদের মুক্তির বিনিময়ে নুর আল্ দিন জানগি বোহেমন্ড তৃতীয় কে মুক্তি দিয়েছিলেন। আমাল্রিক নুর আল্ দিন জানগিকে অনুরোধ করেন যাতে ত্রিপলির কাউন্ট এবং চার্টিলনের রেইনল্ড কে যাতে মুক্ত করা হয় কিন্তু নুর আল্ দিন জানগি তাতে অস্বীকৃতী জানান। পুরোনো বেঈমানীর প্রতিশোধ নিতে নুর আল্ দিন জানগি জানুয়ারির ১১৬৭ সালে শিরকুহ প্রধান করে আবার একটি বাহিনী প্রেরন করেন এই যুদ্ধেও নুর আল্ দিন জানগির অনুরোধে সালাউদ্দিন আয়ুবী তার মামার সঙ্গ দেন। এই অভিযানের কথা জানতে পেরে শাওয়ার দ্রুত রাজা আমাল্রিক এর কাছে সাহায্য চান রাজা আমাল্রিক মরুভূমির মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় শিরকুহ কে ধরার জন্য একটি বাহিনী প্রেরন করেন কিন্তু ব্যার্থ হন । মরুভূমির মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় শিরকুহ মারাত্মক এক মরু ঝড়ের কবলে পড়েও গিজায় শিবির স্থাপন করতে সক্ষম হন (গিজা ছিল মিশরের রাজধানীর উত্তরের একটি শহর)। শিরকুহ গিজাতে ৫০ দিন অতিবাহিত করার পর করার পর শাওর কাছে প্রস্তাব পাঠান তিনি যেনো নুর আল্ দিন জানগির সাথে যোগ দেন এবং ফ্রাঙ্কদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেন কিন্তু শাওর আমাল্রিক এর সাথে থাকার জন্য এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। আমাল্রিক তখন শফথ নেন শিরকুহকে মিশর থেকে ত্যাগ না করা পর্যন্ত তিনি মিশর ত্যাগ করবেন না। এই সময় শিরকুহ শাওরের বিরুদ্ধে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়াতে থাকা সুন্নি মুসলিমদের সমর্থন পেয়েছিলেন।
অবশেষে শিরকুহ শাওর বীরুদ্ধে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন শিরকুহ তুর্কিদের প্রাচীন সামরিক কৌশল অবলল্বন করে তার বাহিনী কে তিনটি বাহিনীতে বিভক্ত করেন। শিরকুহ জানতেন ক্রুসেডররা সর্বপ্রথম মূল বাহিনীতেই আক্রমন করবে তাই তিনি মূল বাহিনীর সংখ্যা কমিয়ে সালাউদ্দিন কে তার নেতৃত্ব দেন যাতে মূল বাহিনী জনাকির্ন দেখায়। ১৮ই মার্চ ১১৬৭ সালে আমাল্রিক ও ফাতেমিদের মিত্র বাহিনী বাবাইনে সালাউদ্দিন বাহিনীর উপর আক্রমন চালায় সালাউদ্দিন সংক্ষিপ্ত সংঘর্ষ করে পরিকল্পনা অনুসারে পশ্চাদপসরন করেন আমাল্রিক একদল বাহিনী নিয়ে তার পিছনে ধাওয়া করে। অন্যদিকে শিরকুহ সংকেত পেয়েই তার বাহিনী নিয়ে এসে পিছনে থাকা ফাতেমী এবং আমাল্রিক এর মিত্র বাহিনী ধ্বংস করে দেয়। শিরকুহ জোড়ালো আক্রমন দেখে সালাউদ্দিন আমাল্রিকের বাহিনীর উপর পাল্টা আক্রমন করে এবং আমাল্রিকের বাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হন। এই যুদ্ধে থাকা মিত্র বাহিনীর বেশির ভাগ সৈন্য নিহত হয় আমাল্রিক এবং শাওর তাদের বেঁছে থাকা কিছু সৈন্য নিয়ে কায়রো পালিয়ে যায়। এই বিজয়ের পর শিরকুহ আলেকজান্দ্রিয়া নিয়ন্ত্রণে নেয় সেখানে থাকা সুন্নি মুসলিমরা শিরকুহকে বিজয়ের অভর্থনা দেয় । লজ্জাজনক হারের পরও কিছুদিনের মধ্যে মিত্র বাহিনী আলেকজান্দ্রিয়া অবরোধ করে কারন মিশরে তখনও শিরকুহর সৈন্য সংখ্যা থেকে মিত্র বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা বেশী ছিল। তিন মাসের অবরোধের ফলে আলেকজান্দ্রিয়া শহরে খাদ্য সংকট সহ বিভিন্ন সংকট দেখা দেয় তাই শিরকুহ এই শর্তে শাওররের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে রাজি হন যে ফ্রাঙ্করা মিশরে থাকতে পারবে না এবং জনগনগনকে কোন প্রকার শাস্তি প্রধান করা যাবে না। এই অবরোধের জন্য নুর আল্ দিন জানগি ফ্রাঙ্কদের ভূমিতে আক্রমন করছে শুনে আমাল্রিকও শিরকুহর এই শর্ত মেনে নেয়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct