পথের সাথী
সনাতন পাল
সবে ভোর হয়েছে। তখনও অন্ধকার পুরোপুরি কাটেনি,কিছুটা আছেই। রাহুল ট্রেন ধরার জন্য স্টেশনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পাশের বাড়ির বিমল কাকুও তখন স্টেশনে হাজির, ব্যাঙ্গালোর যাবে।বিমল কাকু রাহুল কে দেখেই জিজ্ঞেস করলেন
- কি রে, কোথায় চললি?
- বোম্বে, কাকু।
- কেন! হঠাৎ বোম্বে কেন?
- এখানে আর ভালো লাগছে না।
- ওখানে যাচ্ছিস কেন ?
- না, ভাবলাম বোম্বে গিয়ে দেখি, সিনেমায় সুযোগ পাওয়া যায় কি না ।
- হা হা হা। সিনেমা করবি!
- হাসছো যে ! কেন, আমি সিনেমায় সুযোগ পেতে পারি না ?
- আমি কি বলেছি, সুযোগ পাবি না !
--তাহলে !
- তাহলে আবার কি ?
- না,বলছি হাসির কারণটা কি ? খুলে বলো।
- তুই পাশের গ্রামের পরাণ মন্ডলের ছেলে বিশু কে চিনিস?
- পাশের গ্রামের ছেলে চিনব না কেন? আলবার্ট চিনি।
- বিশুও তোর মতো গ্রাম ছেড়ে বোম্বে গিয়েছিল সিনেমার নায়ক হবে বলে, শেষে এখন ফিরে এসে টোটো চালাচ্ছে। কিন্তু তখন বোম্বে না গিয়ে এখানেই যদি চেষ্টা করত, তাহলে হয়তো কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যেত। আজকে আর টোটো চালাতে হতো না। ভালো করে ভেবে যাচ্ছিস তো ?
- হ্যাঁ,ভেবেছি।
ইতিমধ্যে স্টেশনে বোম্বে যাওয়ার ট্রেন এসে লাগল। রাহুল,বিমল কাকুকে হাত নেড়ে বলল এখন তাহলে আসি, কাকু।
- পরে ফিরে এলে আবার কখনও দেখা হবে।
- আচ্ছা, ভালো করে যাস -বাবা।
- হ্যাঁ। তোমরা সবাই ভালো থেকো।
স্টেশন ছাড়তেই ট্রেন ঝড়ের গতিতে ছুটতে লাগল। রাহুল চুপচাপ বসে আছে। আর মনে মনে ভাবছে বোম্বে গিয়ে শুরুটা করবে কোথা থেকে। এর মধ্যেই পরের স্টেশনে ট্রেন থামল। সেখানে একজন সম বয়সী ভদ্র মহিলা উঠলেন। তাঁর সিট রাহুলের কম্পার্টমেন্টেই ঠিক তার বিপরীতে। ট্রেন চলছে। কিছুক্ষণ পরে উল্টো দিক থেকে একটা মহিলার মিষ্টি কন্ঠস্বরে জিজ্ঞেসা...
- এই যে মশাই, শুনছেন?
- আমাকে বলছেন ?
- হ্যাঁ, আপনাকেই। বলছি কোথায় নামবেন?
- আজ্ঞে বোম্বে।
- ঘুরতে যাচ্ছেন?
- কেন বলুন তো !
- না, এমনি জিজ্ঞেস করছি। আমার বাড়ি বোম্বেতেই।
- তাই ! বাহ্, খুব ভালো হলো।
- কি ভালো হলো ?
- মানে,বোম্বে আমার পরিচিত কেউ নেই তো, তাই। আপনাকে বোম্বের একজন পরিচিত মানুষ পেয়ে গেলাম।
- আচ্ছা, বেশ।
রাহুল মনে মনে ভাবছে। কোনো রকমে এই মহিলাকে ধরে যদি মাথা গোঁজার একটা জায়গা করে নিতে পারি,তাহলে আর চিন্তা নেই। চারটে খাবার যে ভাবেই হোক জুটে যাবে। ভাবতে ভাবতেই টিটি এলো। রাহুলকে বলল-
- আপনার টিকিট দেখি।
- এই নিন টিকিট।
- এ তো সেকেন্ড ক্লাসের টিকিট। আপনি এখানে কেন? টিটি চিৎকার চ্যাঁচাম্যাঁচি করতেই ভদ্র মহিলা টিটিকে বললেন-
ভুল করে বেচারা হয়তো ওঠে পড়েছে। একটু মানিয়ে নিন না।
টিটি বলল, মানিয়ে নেওয়ার কিছু নেই সামনের স্টেশনে নেমে সেকেন্ড ক্লাসে চলে যেতে হবে। ভদ্র মহিলা টিটিকে বললেন-
একটু ম্যানেজ করে নিন না।
- মানে?
- বলছি উঠেই যখন পড়েছে, তখন এখানে থাকলে কি খুব সমস্যা হবে?
- না, খরচা করলেই কোনো সমস্যা হবে না।
ভদ্র মহিলা তাঁর ব্যাগ থেকে কড়কড়ে একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে টিটি কে ধরিয়ে দিলেন। উনি টাকাটা সট করে পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে বলছেন-
ছেলেটি কি আপনার পরিচিত?
- কেন বলুন তো! আপনার জেনে কি দরকার? টাকার দরকার, সেটা পেয়ে গেছেন। এখন যান।
আর একটি কথাও না বলে উনি চলে গেলেন পরের প্যাসেঞ্জারের টিকি চেক করতে। রাহুল চুপ করে বসে কি যেন ভাবছে। ভদ্র মহিলা বললেন-
কি এতো ভাবছেন,মশাই ?
মৃদু স্বরে রাহুল উত্তর দিল- না, ও কিছু না। পরেই ভদ্র মহিলাকে বলছে-
আপনার নামটাই জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি।
- আমার নাম রিম্পা।
- বাহ্, ভারি সুন্দর নাম।
- আপনার নাম কি?
- আজ্ঞে রাহুল।
- ভারি মিষ্টি নাম। আপনি কি করেন?
- কিছুই না। বোম্বে যাচ্ছি কাজের সন্ধানেই।
- কি কাজ করবেন ?
- আজ্ঞে, নায়ক হবার ভীষণ ইচ্ছে।
- এই সেরেছে ! এক্কেবারে নায়ক ?
- না, মানে সিনেমা করতে চাই।
- বোম্বে গিয়ে উঠবেন কোথায়?
- জানি না।
- মানে !
- আসলে ওখানে আমার কোনো থাকার জায়গা নেই।
- তাহলে !
- যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা কথা বলতে পারি?
- বলুন, সংকোচের কিছু নেই।
- আপনি যদি একটু থাকার জায়গা দিতেন তাহলে ভীষণ উপকার হয়।
রাহুল দেখতে শুনতে খানিকটা নায়কের মতই। রিম্পা ততক্ষণে বুঝে গেছে যে ছেলেটি বেশ সহজ সরল এবং গ্রামের একজন নির্ভেজাল মানুষ। রাহুলের প্রতি ইতিমধ্যেই তার একটা ভালো লাগা জন্ম হয়েছে। উল্টো দিকেরও একই অবস্থা । খানিকক্ষণ ভেবে বলল- বেশ আমাদের বাড়িতেই থাকবেন। এতক্ষণে রাহুলের মুখে হাসি দেখা গেল। খানিকটা নিশ্চিত মনে বলল-
আপনাদের বাড়ীতে কে কে আছেন ?
-বাবা, মা, আর আমি।
- ও, আচ্ছা।
দীর্ঘ পথ জার্নির পরে বোম্বে স্টেশনে ট্রেন থামল। রিম্পার বাড়ী থেকে গাড়ি এসেছে নিতে। দুজনেই গাড়ী করে গেল। বাবা রাহুলের পরিচয় জানতে চাইলে রিম্পা সব ঘটনা খুলে বলল। উনি মেয়ের সব আবদার এক কথায় মেনে নেন। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। রাহুলের বোম্বে শহরে নিজের একটা ঠিকানা হলো। প্রতিদিন সকাল হতেই রাহুল কাউকে কিছু না বলেই বাড়ী থেকে বেরিয়ে যায়। ফিরে আসে সেই রাতে। কিছুদিন ধরে বহু খোঁজ করেও সিনেমায় কি ভাবে সুযোগ পাবে তার কোনো সন্ধান পেল না। একদিন ঘরে ফিরে মন খারাপ করে বসে আছে। হঠাৎ ঠক্ ঠক্- দরজায় শব্দ। বাইরে থেকে আওয়াজ আসছে- রাহুল বাবু ঘরে আছেন? দরজাটা একটু খুলুন। রাহুল দরজা খুলেই দেখে রিম্পা। দুজনেই একে অপরে মুখে হতচকিত হয়ে চেয়ে আছে । কয়েক সেকেন্ড কারো মুখে কথা নেই। রিম্পা বলল-
কি! ভেতরে আসতে বলবেন না?
- এমন করে কেন বলছেন?আমিই তো আপনাদের আশ্রিতা। আসুন, বসুন।
- বলছি, সিনেমার বাতিক মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। আমাদের একটা ফ্যাক্টরি আছে সেটাই দেখা শোনা করুন। বাবার বয়স হয়েছে ফলে আর দেখভাল করতে পারেন না। রিম্পার কথা শুনে খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পরে রাহুল বলল-
আচ্ছা ঠিক আছে। তাই হবে।
- ধীরে ধীরে এখানেই সেটল হয়ে যান।
মানে!
- মানে, খুব সহজ। যদি আর যেতে না দিই!
- জোর !
- জোর নয়- আবদার।
সেই দিনই আপনি থেকে দুজনে তুমি সম্বোধনে চলে এলো। যতদিন যেতে লাগল, সম্পর্কের গাঢ়ত্ব বাড়তে লাগল। ধীরে ধীরে একে অপরের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। অবশেষে বিয়ের কথা হলো। পরিবারের কারো কোনো আপত্তি নেই। সামনের অগ্রহায়ণে ওদের বিয়ে। এর মধ্যেই একদিন হঠাৎ করেই রাহুলের ভীষণ মাথার যন্ত্রণা। কিছুতেই কমছে না, সহ্যের বাইরে। রিম্পা অ্যাম্বুলেন্স ডাকল। রাহুলকে নার্সিংহোমে ভর্তি করা হলো। ডাক্তার বাবু এম আর আই করালেন। রিপোর্ট এলো। রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বাবুর মুখে কথা নেই। রিম্পা জানার জন্য জোর করে বলল-
কি হয়েছে ওর ?
- ব্রেন টিউমার।
- যে কোনো সময় চলে যেতে পারে। অপারেশন করার সময় পেরিয়ে গেছে।
রিম্পা কথাটা শুনে হাঁ করেই রইল কিন্তু মুখ থেকে কোনো আওয়াজ বের হলো না। ডাক্তার বাবু দেখে বললেন প্রচন্ড শক পেয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে।
- এর মধ্যেই খবর এলো রাহুলের শেষ সময় উপস্থিত। মুখে বার বার বলছে-
রিম্পা, শেষ বারের মতো একবার কথা বলো- শুধু একবার। রিম্পা- রাহুল বলে চিৎকার করে উঠতেই বালিশের উপরে রাহুলের ঘাড়টা কাত হয়ে পড়ে রইল। ডাক্তার বাবু নাড়ী ধরে বললেন- “হি ইজ নো মোর”।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct