উৎসশ্রী প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষকগণের ব্যাপক বদলির সুযোগ মিলেছে। একটি স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৩২০০ এর অধিক, প্রায় অর্ধেকের বেশি মেয়ে। অনুমোদিত শিক্ষক পদ ৬৪। ২০ জন শিক্ষকের পদ খালি। এই অবস্থায় প্রধান শিক্ষক সহ ২২ জন শিক্ষক উৎসশ্রী প্রকল্পের মাধ্যমে অন্যত্র বদলি হওয়ার ফলে বিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনের শোচনীয় পরিস্থিতি। তাই শিক্ষামন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি লিখেছেন বর্ধমানের কাঁদরা জেএম উচ্চবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোঃ রেজাউল হক যিনি ‘হক সাহেব’ হিসেবে পরিচিত।
দীর্ঘ প্রায় দুই বছর করোনার কারণে পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যালয়গুলি খোলার প্রাক্কালে উৎসশ্রী প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষকগণের ব্যাপক বদলির সুযোগ হয়। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি বাস্তবায়নের কি বিশেষ জরুরি প্রয়োজন ছিল? এর ফলে বহু স্কুলের পঠন পাঠন দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আজ নিদারুণ দুঃখ, ক্ষোভ ও বেদনার সঙ্গে জানাই আমাদের গ্রামের তেঘরী নাজিরপুর ইনস্টিটিউশন (উচ্চমাধ্যমিক)-র কী করুণ অবস্থা! গ্রামবাসীদের অদম্য সংকল্প, ত্যাগ এবং সর্ব প্রকার সাহায্যের ফলে ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়। নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে বর্তমান উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এতদাঞ্চলের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা পালন করছিল। বর্তমানে এই বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৩২০০ এর অধিক, প্রায় অর্ধেকের বেশি মেয়ে । শিক্ষকের অনুমোদিত পদ ৬৪ কিন্তু ২০ জন শিক্ষকের পদ খালি। কিন্তু নিয়োগ হয়নি। এই অবস্থায় প্রধান শিক্ষক সহ ২২ জন শিক্ষক উৎসশ্রী প্রকল্পের মাধ্যমে অন্যত্র বদলি হওয়ার ফলে বিদ্যালয়ের পঠন পাঠনের শোচনীয় পরিস্থিতি। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই বিদ্যালয়ের মূল বা প্রধান উদ্যোক্তার মধ্যে অন্যতম। প্রথমদিকে দীর্ঘ প্রায় সাড়ে ১৩ বছর সম্পাদক পদে থেকে অক্লান্ত পরিশ্রমে সকলের সহযোগিতায় উচ্চ বিদ্যালয়ের জন্য যাবতীয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করেছিলাম। পরেও আরোও তিন বছর সম্পাদকের পদে ছিলাম। বর্তমানে বিদ্যালয়ের সব শিক্ষকই বহিরাগত। জানতে পারলাম অবশিষ্ট শিক্ষক মহাশয়দেরর কয়েকজন এখন বদলির অপেক্ষায় আছেন । স্বাভাবিকভাবে বিদ্যালয় এখন নিদারুণ সঙ্কটের মধ্যে। পঠন- পাঠন শিকেয় উঠেছে। এখন বিদ্যালয়ের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে খুবই মুশকিলে পড়তে হয়। ছাত্রছাত্রীরাই তো শিক্ষা ব্যবস্থার মূল। তাদের জন্যই শিক্ষক। তাদের জন্যই বিদ্যালয়। তাদের জন্যই শিক্ষা ব্যবস্থা। অথচ তাদের স্বার্থ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চরম ক্ষিপ্রতার সঙ্গে শিক্ষকদের বদলি ব্যবস্থা করা হল।
দ্বিতীয়ত, বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির মূল কর্তব্য বিদ্যালয় স্বার্থরক্ষা করা। এখন দেখছি সেই কমিটির সভাপতি পদাধিকারীর বিরাট ক্ষমতা শিক্ষকদের বদলির আবেদনে এনওসি দিয়ে বিদ্যালয়ের সর্বনাশ সাধন করা। কি অদ্ভুত ব্যবস্থা! পূর্বতন কমিটি বর্তমানের তুলনায় অনেক স্বচ্ছ , দায়িত্বশীল এবং গণতান্ত্রিক বাস্তবসম্মত ছিল। তৃতীয়ত, আমি দেখেছি শিক্ষকদের পেনশন প্রথা চালু হওয়ার আগে ৬০ বছরের উর্ধ্বে অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ সুস্থ শিক্ষককেও অতিরিক্ত ৫ বছরের এক্সটেনশন-এর জন্য প্রতিবছর ফিজিক্যালি এবং মেন্টালি এলার্ট এই মর্মে মেডিকেল সার্টিফিকেট দিতে হত।
এখন শিক্ষকদের লোভনীয় বেতন হার পেনশন, ডিএ, স্বেচ্ছায় অবসর ও মিউচ্যুয়াল ট্রান্সফার, হাউসরেন্ট অ্যালাউন্স, মেডিকেল অ্যালাউন্স, গ্রাচুইটি সুবিধা সত্ত্বেও এত অধিক সংখ্যা শিক্ষককে বিদ্যালয়ের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে বিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থাকে একেবারে পঙ্গু করার সুযোগ দেওয়া হল! তুলনামূলকভাবে আগেকার চেয়ে অনেক বেশি চাকরির সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও এত অধিক সংখ্যক শিক্ষক ব্যক্তিগতভাবে পরিবারিক ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে বদলি, কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ বলে মনে করি না । এটা কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি বিরাট অবিচার। এ পর্যন্ত যত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে তার মূলে আছে সেই অঞ্চলের জনসাধারণের অদম্য ইচ্ছা। সেই ইচ্ছাকে সঠিকভাবে রূপদানের জন্য তাদের দ্বারা গঠিত কমিটি দায়িত্বশীল পরিচালনা কমিটির মাধ্যমে বিদ্যালয়ের অনুমোদন করে বিদ্যালয়ের সমস্যামুক্ত করা । এমতবস্থায় সচেতন নাগরিক এবং সমাজসেবী, ছাত্র দরদী অভিজ্ঞ অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক হিসাবে ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থে উপরিক্ত বিষয়গুলি পর্যালোচনা করার অনুরোধ জানাই। অবিলম্বে সমস্ত শিক্ষকের শূন্যপদ পূরণের ব্যাবস্থা করার সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাই। বিশেষ প্রয়োজনে সাময়িক ভাবে কিছু আংশিক সময়ের শিক্ষক চুক্তি ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করুন।
এই প্রসঙ্গে অতি বিনয়ের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত শিক্ষক জীবনের কিছু প্রসঙ্গ উল্লখ করছি। প্রায় দীর্ঘ ৩৭বছর বর্ধমান জেলার কেতুগ্রাম থানার কাঁদরা জ্ঞানদাস উচ্চ বিদ্যালয়ের ইতিহাসের সহকারী শিক্ষক ছিলাম। সালার এডওয়ার্ড জাকরিয়া হাইস্কুলে চাকরি পেলেও যাইনি। কাঁদরার গ্রামবাসীদের ভালবাসার জন্য সেখানে থেকে যাই। একজন শিক্ষকের প্রতি গ্রামবাসী ও ছাত্রছাত্রীদের ভালবাসা সত্যিই ভুলতে পারি না। অবশেষে ২০০৬ সালে অবসর গ্রহণ করি। প্রায় প্রতি সোমবার রাত সর্বশেষ ৪:৪০মিনিট অন্ধকার জনশূন্য সাড়ে তিন মাইল আলপথ পার হয়ে ট্রেনে ১০ কিমি পরে, ১৭ কিমি তিনচাকা অটো, তারপরে গঙ্গা নদী পার হয়ে রিকশায় কাটোয়ায় ছোট লাইনের ‘একে,’ গাড়ি ধরতে হত। কোনও কোনও দিন কয়েক সেকেন্ডের জন্য ৮:২০ মিনিটের ট্রেন আমার চোখের সামনেই চলে যেত চেয়ে চেয়ে দেখতে হতো। অন্য কোন বিকল্প না থাকায় অনেক দিন অনুপস্থিত থাকতে হতো। অনেক পরে রাস্তা নির্মাণ ও বাস চালু হওয়াতে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। অন্যদিকে শনিবারের দিন ছুটি করে বাড়ি আসতে রাত ৮-৯টা লাগত। কোনও কোনওদিন বাড়ি পৌঁছানো সম্ভব হত না।তবে যেসব শিক্ষক স্কুল থেকে ট্রান্সফার নিয়ে চলে গেছেন তাদের প্রতি ভালোবাসা রয়েছে। কিন্তু অন্য স্কুলে যাওয়ার আগে তাদের ছাত্রছাত্রীদের কথা ভাবা উচিত বলে মনে করি। তাই, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর কাছে সবিনয় অনুরোধ, শিক্ষকদের বদলি করার আগে ওই স্কুলে আংশিক সময়ের শিক্ষক নিয়োগ করা হোক, যতদিন না স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ হয়।
লেখক গ্রাম ও পো: নাজিরপুর, থানা-রেজিনগর, মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct