যে ঘৃণা ও বিভক্তির রাজনীতি ‘মহাত্মা’কে শারীরিকভাবে মেরেছে, ৭৪ বছর পর সেই একই বিভেদবাদের মোকাবিলায় রাহুল নামলেন দীর্ঘ পদযাত্রায়। কংগ্রেস তাদের এই কর্মসূচিকে বলছে ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’। ভারতজুড়ে বিভিন্ন রাজ্যের পুরনো বন্ধু দলগুলোকে পাশে রাখারও মরিয়া চেষ্টা হিসেবে দেখা যায় রাহুলের লংমার্চকে। তাই গভীর নজর রাখছে সিপিএম, তৃণমূল কংগ্রেস, বিহারের আরজেডি, তামিলনাড়ুর ডিএমকে, তেলেঙ্গানার টিআরএসসহ আরও বহু শক্তি। এ নিয়ে লিখেছেন আলতাফ পারভেজ। আজ প্রথম কিস্তি।
মহাত্মা গান্ধী ও রাহুল গান্ধী এক পরিবারের নন। উপরন্তু মহাত্মার মৃত্যুর প্রায় ২২ বছর পর রাহুলের জন্ম। কিন্তু একই দেশ, একই দল এবং একই প্রতিপক্ষ তাঁদের যেন একই ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে। যে ঘৃণা ও বিভক্তির রাজনীতি ‘মহাত্মা’কে শারীরিকভাবে মেরেছে, ৭৪ বছর পর সেই একই বিভেদবাদের মোকাবিলায় রাহুল নামলেন দীর্ঘ পদযাত্রায়। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস তাদের এই কর্মসূচিকে বলছে ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’। কিন্তু রাহুল আদৌ ভারতকে ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে যুক্ত রাখতে সক্ষম কি না, সে প্রশ্নও আছে তীব্রভাবে। এ–ও ভাবছেন অনেকে, রাহুলের পদযাত্রার পরিণতিও মহাত্মার শেষ যুদ্ধের মতো নিষ্ফল হতে পারে—যখন মৃত্যুর ১৭ দিন আগে তিনি অনশনে নেমে ভারত-পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার ডাক দিয়েছিলেন। এসব বিবেচনা একত্র করে রাহুলের চলতি পদযাত্রাকে ভারতে ‘গান্ধী’দের শেষ যুদ্ধও বলা যায়। তবে পদযাত্রার পথে-পথে উচ্ছ্বাস আছে। মনে হচ্ছে, ভারতের সবাই গেরুয়া বিভক্তিবাদের কাছে হার মানতে চাইছে না। কিন্তু বিভেদবাদকে পরাস্ত করার সংগ্রাম রাস্তায় হাঁটাহাঁটির চেয়েও বেশি কিছু। ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ সে চাহিদা কতটা মেটাতে সক্ষম? ভারতকে ‘জোড়া’ দিতে নেমেছে একদল পদযাত্রী
কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত ১২ রাজ্য এবং দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল মিলে ৩ হাজার ৫৭০ কিলোমিটার হাঁটছেন রাহুল। এই লেখা যখন তৈরি হচ্ছে, তখন টিম-রাহুল কেরালায়। এখান থেকে কনটেনার-কাফেলা ঢুকবে কর্ণাটকে। প্রায় দুই শ সদস্যের মূল পদযাত্রী দল তামিলনাড়ু থেকে যাত্রা করেছে ৮ সেপ্টেম্বর। এতে আছেন প্রায় ৪০ জন নারীও। বিভিন্ন বিবেচনায় মূল দলের সদস্যদের বাছাই করেছে কংগ্রেস। প্রতিদিন তাঁরা ২০ থেকে ২২ কিলোমিটার পথ হাঁটছেন। পদযাত্রা চলবে প্রায় পাঁচ মাস। যাত্রী দলের গড় বয়স ৩৮। বোঝা যাচ্ছে, কংগ্রেসের জ্যেষ্ঠ এবং নির্ভরযোগ্য একটা দল রাহুলের পাশে এই মুহূর্তে। পথে পথে শত শত মানুষও এই নেতাদের সঙ্গ দিচ্ছেন—যে যতটা পথ পারছে। হাঁটার পাশাপাশি রাহুল ও সহযোগীরা রাজনৈতিক বিষয়ে বক্তৃতা–বিবৃতি দিচ্ছেন এবং স্থানে স্থানে সাংগঠনিক কাজও সারছেন। রাহুলের প্রত্যাশা, সব বাধা পেরিয়ে জনসংযোগ ছাড়াও দলের একদম নিচুতলার ওয়ার্ড স্তরের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন যাত্রাপথে। পদযাত্রায় প্রধান আগ্রহ ধর্মনিরপেক্ষতা হলেও রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্ব পাচ্ছে দ্রব্যমূল্য ও বেকারি। প্রথম ১৫ দিনে পদযাত্রাকালে তীব্র আবেদনময় কোনো স্লোগান পাওয়া যায়নি। তবে প্রতিদিন পদযাত্রার কোনো না কোনো ছবি ভাইরাল হচ্ছে। এভাবে হয়তো আগামী পাঁচ মাস প্রচারমাধ্যমের লাগাতার নজর থাকবে রাহুলের দিকে। এই ‘পদযাত্রা’ একই সঙ্গে রাহুল ও ভারতের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ঠিক করে দেবে। তার প্রভাব পড়বে দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে।
পদযাত্রার আড়ালে কংগ্রেস সভাপতি খুঁজছে ভারতের ইতিহাসে লংমার্চ বা পদযাত্রা বরাবরই রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে বাড়তি মনোযোগ পায়। কংগ্রেস নিশ্চয়ই এবারের পদযাত্রার ছক করতে নেমে মহাত্মার ১৯৩০-এর লবণ সত্যাগ্রহের কথাও ভেবেছে আরেকবার। সে রকম ইঙ্গিতও আছে দলটির যোগাযোগ বিভাগের প্রধান জয়রাম রমেশের কথায়। ১৬ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন তিনি। বললেন, ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটা রূপান্তর ঘটাবে এবং কংগ্রেসকেও পুনর্জীবিত করবে তা। বিশেষ করে দলের সব প্রদেশের কর্মী-সংগঠকদের মাঝে আত্মবিশ্বাস ও নৈতিক শক্তি বাড়াবে এ কর্মসূচি। মাঠের শক্তি, টাকার শক্তি এবং ভোটের শক্তিতে বিজেপি যখন প্রায় অপ্রতিরোধ্য, ঠিক এ সময় রাহুলের পদযাত্রা নৈতিকভাবে বলীয়ান করতে চাইছে দলকে। কংগ্রেসের জন্য এটা যতটা রাজনীতির প্রচারকৌশল—তার চেয়ে বেশি অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। জয়রাম একে তুলনা করেছেন ‘বুস্টার ডোজে’র সঙ্গে।ভারতজুড়ে বিভিন্ন রাজ্যের পুরোনো মিত্র দলগুলোকে পাশে রাখারও মরিয়া চেষ্টা হিসেবে দেখা যায় রাহুলের লংমার্চকে। সংগত কারণেই এর প্রতি গভীর নজর রাখছে সিপিএম, তৃণমূল কংগ্রেস, বিহারের রাষ্ট্রীয় জনতা দল, তামিলনাড়ুর ডিএমকে, তেলেঙ্গানার টিআরএসসহ আরও বহু শক্তি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct