বছরের পর বছর ধরে মার্কিন সমরাস্ত্রশিল্প খাত অধিক পরিমাণে অস্ত্র রপ্তানিকারক অন্যান্য দেশগুলো যেমন রাশিয়া, চিন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও ইসরায়েলের মতো দেশের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ এবং দীর্ঘমেয়াদি সামরিক জোটের সুফল ভোগ করে আসছে। মার্কিন ঠিকাদারেরা এখন বিশ্বব্যাপী অস্ত্র ব্যবসার ৩৯ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগ থেকেই ইউরোপে অস্ত্র বিক্রি করে আসছিল। তারা নতুন করে ১৯ শতাংশ অস্ত্র সরবরাহ বাড়িয়েছে। এ নিয়ে লিখেছেন শলমো বেন-আমি। আজ শেষ কিস্তি।
স্নায়ু যুদ্ধ শেষে বিশ্বে অস্ত্রের চাহিদা কমে আসছিল। প্রতিরক্ষা ঠিকাদারেরা আশা করেছিল ন্যাটোর সম্প্রসারণ হলে তাদের জন্য একটি নতুন বাজার তৈরি হবে। দেখা যায়, ১৯৯৬ সালে দ্য ইউএস কমিটি টু এক্সপান্ড ন্যাটো নামে একটি পরামর্শক সংস্থা গড়ে ওঠে। লকহিড মার্টিনের কৌশলগত পরিকল্পনার পরিচালক ব্রুস এল জ্যাকসন এটি গঠন করেন। কার্যত এটি প্রতিরক্ষা শিল্পই সৃষ্টি করেছিল। ন্যাটোতে হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড ও চেক প্রজাতন্ত্রের মতো সাবেক কমিউনিস্ট মধ্য ইউরোপীয় দেশগুলোর যোগদান আধুনিক সমরাস্ত্র নির্মাতা মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ব্যাপক লাভজনক প্রমাণিত হয়েছিল। এই ব্যাপক লাভের বিষয়টি ডেমোক্রেটিক ইউএস সিনেটর টম হারকিনের চোখ এড়াতে পারেনি। তিনি ১৯৯৭ সালে সিনেটের এক শুনানিতে ক্লিনটন প্রশাসনের ন্যাটো সম্প্রসারণের জন্য চাপকে ‘প্রতিরক্ষা ঠিকাদারদের জন্য একটি মার্শাল প্ল্যান যারা অস্ত্র বিক্রি এবং মুনাফা অর্জন করতে চায়’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। ফিনল্যান্ড ও সুইডেনকে ন্যাটোতে যুক্ত করা একইভাবে মার্কিন প্রতিরক্ষা ঠিকাদারদের জন্য একটি বড় নতুন বাজার উন্মুক্ত করবে। কারণ, ইউরোপিয়ান জোটের আন্তকার্যক্ষমতা নীতি তাদের আমেরিকার তৈরি প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে আবদ্ধ করবে। ইউক্রেনের যুদ্ধ ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ অর্জনে ইউরোপের ব্যর্থতার মাত্রাই প্রকাশ করেছে। দেখা গেছে ইউরোপের সামরিক প্রযুক্তির ধরন ও পরিমাণের ৬০ শতাংশ বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে থেকে আসে।
এই পরিস্থিতি মার্কিন অস্ত্রের ওপর ইইউ ব্লকের নির্ভরতা কমাতে ইউরোপীয় নীতিনির্ধারকদের পরিকল্পনা প্রণয়নে নতুন করে ভাবাচ্ছে। গত মে মাসে ইইউ প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির জন্য ১৯ হাজার ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারের অনুমোদন দেয়। এই অর্থ পাওয়ার আশায় ইউরোপীয় অস্ত্র নির্মাতারা এবং বিনিয়োগ ব্যাংকগুলো তাদের এই শিল্প খাতকে পরিবেশগত, সামাজিক ও শাসনের মানদণ্ডের অধীন ‘সামাজিক স্থায়িত্ব রক্ষায়’ ‘একটি ইতিবাচক অবদান’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করতে বহুদূর এগিয়েছে।যা–ই হোক, নিকট ভবিষ্যতে মার্কিন অস্ত্রশিল্প খাতই ইউরোপের প্রতিরক্ষা ব্যয় ব্যবস্থার কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর সম্প্রতি জার্মানির কাছে ৮৪০ কোটি ডলারের এফ-৩৫ ফাইটার জেট বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে। মধ্য এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর কাছে মার্কিন উড়োজাহাজ ও অস্ত্র কেনার মানে হলো নিজেদের জন্য মার্কিন সুরক্ষা নিশ্চিত করার সর্বোত্তম উপায়।
কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে ইউরোপকে পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ পথ। ইউরোপীয় দেশগুলোর তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিরক্ষা বাজেটে গবেষণা ও প্রযুক্তি খাতে ছয় গুণ বেশি ব্যয় করে। এই বছরের শুরুতে কংগ্রেস মার্কিন প্রতিরক্ষা বাজেট বরাদ্দ ৯ শতাংশ বৃদ্ধি করে। এর ফলে তাদের বাজেট বরাদ্দ ৮০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি দাঁড়ায়, যা এ খাতে রেকর্ড। আর এর মধ্য দিয়ে মার্কিন অস্ত্রশিল্প যে আরও অনেক বছর ধরে তার প্রযুক্তিগত সুবিধা কাজে লাগাবে সেই নিশ্চয়তা দিয়েছে। আগ্রাসনের হাত থেকে বাঁচাতে শুধু যে অস্ত্রের কারণে সহায়তা তেমনটা নয়, ইউক্রেনীয় জনগণের সাহায্যের আহ্বানে সাড়া দিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবশ্যই বাধ্যতামূলক রাজনৈতিক এবং নৈতিক কারণ রয়েছে। কিন্তু এটাও স্পষ্ট যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি তার পররাষ্ট্রনীতির ওপর বিশাল সামরিক-শিল্প খাতের প্রভাবকে সীমিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে তারা আরও অনেক সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে। আর সেগুলোয় জড়িয়ে পড়ার ন্যায্যতা ইউক্রেনের যুদ্ধের মতো সহজ না–ও হতে পারে। (সমাপ্ত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct