মাতলা নদীর তীরে লর্ড ক্যানিংয়ের বাড়ি
বেবি চক্রবর্ত্তী
লর্ড ক্যানিং, মাতলা নদীর তীরে (১৮৫৬ - ৬২ সালে) একটি অট্টালিকা নির্মাণ করেন যেটি ক্যানিং হাউস নামে পরিচিত | মাতলা নদীর ‘ বন্দর’ তৈরীর লখ্যে এই অট্টালিকা নির্মিত হয়| এটি তৈরী হওয়ার সময় ক্যানিং সাহেব কয়েকদফায় এখানে থেকেছিলেন | পরবর্তীকালে মাতলা নদীর নব্যতা হারানোয় ক্যানিং বন্দর প্রকল্পটি পরিত্যক্ত হয় | ইটের তৈরী দ্বিতল এই অট্টালিকার লম্বা বারান্দা খিলান যুক্ত ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের প্রভাব পরিলখ্যিত | একতল থেকে দ্বিতল যাওয়ার একটি কাঠের সিঁড়ি ছিল| সাহেবের সেই নির্দেশে বন্দর তৈরীর কাজ অনেকটাই এগিয়েছিল| জঙ্গল কেটে তৈরী করা হল নয়া কোম্পানির সদর দফতর,জনপদ| লর্ড ক্যানিং ভারতবর্ষের শেষ গর্ভনর জেনারেল ও প্রথম ভাইসর ছিলেন | ১৮৫৬ থেকে ১৮৬২ এই সময় কালের প্রথম দু’বছর ভারতের গভর্নর জেনারেল এবং পরর চার বছর ভাইসরয় ছিলেন| চালর্স যোহান আর্ল ( লর্ড ক্যানিং) তৈরী হয় “পোর্ট ক্যানিং কোম্পানি” তারা মাতলা নদীর ধারের তৈরী করায় স্ট্রান্ড, হোটেল, কিছু বাড়ি | কিন্তু ১৮৬৭ সাল নাগাদ নদীর পথ পরিবর্তনে সে সব ভেঙে যায় | ইতিমধ্যে ১৮৬২ তে শিয়ালদহ দখ্যিন (ততকালীন বেলেঘাটা স্টেশন) থেকে ক্যানিং পর্যন্ত রেলপথ স্থাপন করে ইস্ট্ বেঙ্গল কোম্পানি রাষ্ট্রায়ত হয়| কীভাবে বাড়িটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ক্যানিংয়ের স্মৃতি ? পরে বিশেষজ্ঞ মহলের একাংশ জানিয়েছিলেন বাড়িটি ছিল “পোর্ট ক্যানিং কোম্পানি”র সদর দফতর| ১৮৭২ এ সংস্থা বন্ধ হয়ে যায় | নামমাত্র ওই বাড়ি সংলগ্ন জমি কিনে নেয় | সরকারি প্রতিনিধি হিসাবে দেখতে গিয়েছিলেন মহাকুমা তথ্য অফিসার, তিনি মন্তব্য করেন, “বাড়িটি তৈরীর সঠিক দিনখ্যন জানা না থাকলেও নথি দেখে অনুমান করা যায়, পৌনে দু’শ বছর আগে এটি তৈরী করা হয়েছিল| এত আকর্ষণীয় স্থাপত্যের বাড়ি সংরখ্যণ করে একটা পর্যটক কেন্দ্র করা যেতে পারে |” ক্যানিং সাহেব এবং লেডি ক্যানিং ওখানে গেলে সে বাড়িটিতে থাকতেন, সেটির অস্তত্বের বেশিরভাগটাই লোপ পেয়েছে |এটি ছিল লর্ড ক্যানিংয়ের নামাঙ্কিক সংস্থার সদর দফতর |চার্লস ক্যানিং ১৮৩৬ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউজ অব্ কমন্সের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৮৩৭ সালে তার মাতার মৃত্যুর পর তিনি হাউজ অব লর্ডসের সদস্য হন। তিনি ব্রিটিশ সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক অধীন সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৪৭-৪৯ সালে চার্লস ক্যানিং ব্রিটিশ রাজকীয় জাদুঘরের কমিশনে কাজ করেন। তিনি গ্রেট ব্রিটেনের পোষ্ট মাষ্টার জেনারেল হিসাবে কাজ করেন এবং তার প্রশাসনিক দক্ষতার পরিচয় দেন। ১৮৫৬ সালের ফ্রেব্রুয়ারিতে তিনি ভারতের গভর্নর-জেনারেল হিসাবে নিয়োজিত হন। ১৮৫৭ সালে ভারতে সিপাহী বিদ্রোহের সূচনা হয়। বিদ্রোহের আগে ক্যানিং এবং তার স্ত্রী ভারতের অধিবাসীদের উপর একটি চিত্র জরিপ করেন। শুরুতে এর উদ্দেশ্য ছিল ভারত সম্পর্কে তাদের নিজেদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করা। পরবর্তীতে ১৮৬৮ এবং ১৮৫৭ সালে পিপল অব ইন্ডিয়া নামে আটটি খন্ডের পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়। সিপাহী বিদ্রোহের সময় তার সাহসী ভূমিকার জন্য তিনি প্রশংসিত হন এবং ১৮৫৮ সালে ভারতের প্রথম ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় হিসাবে নিয়োজিত হন। ১৮৫৯ সালের এপ্রিল মাসে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উভয় কক্ষ থেকে সিপাহী বিদ্রোহের সময় তার অসামান্য অবদানের জন্য প্রশংসিত হন। একই সাথে তাকে অর্ডার অব বাথ উপাধী প্রদান করা হয়। একই বছর মে মাসে তাকে আর্ল উপাধি প্রদান করা হয়। এরপর তিনি আর্ল ক্যানিং নামে পরিচিত হন। অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্য তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। মৃত্যুর এক মাস আগে তাকে নাইট অব গার্টার উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ক্যানিংয়ের এই বাসভবন ক্যানিং স্টেশন থেকে মিনিট পনেরো হাঁটাপথ| প্রাচীন ভবনটির অবস্থা খুবই জীর্ণ | লোহার মূল ফটকটি বহুকাল আগে উধাও হয়ে গিয়েছে | পুরো দেওয়ালের বিভিন্ন অংশে ফাটল| বাড়ির তিন চারিদিকের বিভিন্ন জায়গায় বটবৃখ্য বাড়িয়ে চলেছে এই ফাটলের মাত্রা | উঁচু স্তম্ভগুলোর ইট খসে পড়েছে | বাড়ির দু’টি তল মিলিয়ে অন্তত পনেরটি ঘর | কড়ি খাটের ছাদের উচ্চতা অন্তত ১৫ ফুট| ভূগর্ভেও একটি তল আছে | একসময়ে সেটি ব্যবহৃত হত | বহুকাল ব্যবহৃত হয় না| বন্ধ করে রাখা হয়েছে একতলার বেশির ভাগ অংশ | সরকারি নথিতে ক্যানিংয়ের বাড়ি এবং সংলগ্ন জমি “ খাসমহল” হিসবে চিহ্নিত ছিল| এখন ক্যানিং ডাবু বা গোলাবাড়ি নামে পরিচিত | পশ্চমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন ২০০১ এর আইন অনুসারে, ২০১৮ সালে এটি ঐতিহাসিক ভবনের অন্তরভুক্ত হয়| তা সত্বেও বর্তমানে ক্যানিং হাউস এই প্রাচীন ভবনটির অবস্থা খুবই জীর্ণ,পুরু দেওয়ালের বিভিন্ন অংশে ফাটল, দেওয়ালের ইট্ খসে পড়েছে | ক্যনিং সাহেবের সেই পুরানো ঘর কীভাবে সংরখ্যন করবে ? তা বিবেচনাধীন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ মহল |
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct