আদর্শগতভাবে যুদ্ধের অন্তর্নিহিত কারণ বা বিবদমান পক্ষের পার্থক্যগুলো যখন ভেতর থেকে সমাধান করা হয়, তখন যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু বাস্তবে এটি খুব কমই ঘটে। তাই প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধগুলো তখনই শেষ হয়, যখন এক পক্ষ সর্বার্থে জয়লাভ করে। কিন্তু আধুনিক যুদ্ধ-পরিস্থিতি তৈরি করা বহুমাত্রিক এবং অনেক বেশি স্থিতিস্থাপক। বিশেষ করে যখন বহিরাগত পৃষ্ঠপোষকেরা বিভিন্ন দিক থেকে বিবদমানদের সহায়তায় এগিয়ে আসে, তখন যুদ্ধ থামানো কঠিন হয়ে পড়ে। এ নিয়ে লিখেছেন মুকেশ কপিলা।
গত ২১ সেপ্টেম্বর ছিল রাষ্ট্রসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস। ‘যুদ্ধের কবল থেকে’ বিশ্বকে বাঁচানোর জন্য ১৯৪৫ সালে যে সনদ স্বাক্ষরিত হয়, এই দিবস আমাদের সেই মহৎ সনদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই সনদের মধ্য দিয়ে রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক এবং নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকটি প্রজন্মের মধ্যে এই বিশ্বাস তৈরি হয়েছে যে যুদ্ধ সব সময়ই খারাপ, শান্তি সব সময়ই প্রশ্নাতীতভাবে ভালো এবং শান্তির জয় সব সময়ই অবধারিত। যুদ্ধ বেআইনি নয়। জাতিসংঘের সনদে আগ্রাসনের অপরাধ মোকাবিলার অনুমতি রয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের অধীনে ‘ন্যায় যুদ্ধের’ ধারণাটিও বিদ্যমান। অনেক সময় যুদ্ধও প্রয়োজনীয় হতে পারে, তবে সে যুদ্ধকে প্রকৃতপক্ষেই নৈতিক যুদ্ধ হতে হয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অনেক জায়গাতেই গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে শেষ করা সম্ভব হয়েছে।একই সঙ্গে আমাদের শান্তি প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিকতার ‘ট্র্যাক রেকর্ড’ সন্তোষজনক নয়। শান্তি সনদে স্বাক্ষর করার পর ৫০ বছর কেটে গেলেও বিগত এই অর্ধশতাব্দীতেই কিছু কিছু সশস্ত্র সংঘাত পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে—এ কথা ভাবা কঠিন। তার বদলে তারা ভেতরে–ভেতরে টগবগ করছে এবং বিস্ফোরিত হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ফিলিস্তিন বা কাশ্মীরের ঐতিহাসিক সংঘাত অথবা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ লড়াই কিংবা মাগরেব ও সাহেলের বিদ্রোহের কথা ভাবুন। অনেক দেশের সরকার তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ে ব্যস্ত। যেমন পাকিস্তান উপজাতীয় এলাকায় অস্থিরতার মোকাবিলা করছে। দক্ষিণ সুদান মোকাবিলা করছে জাতিগত সহিংসতা।আন্তর্জাতিক পরিসরে রাষ্ট্রসংঘ কোটি কোটি ডলার ব্যয় করেছে এবং কয়েকটি দেশে হাজার হাজার শান্তিরক্ষী মোতায়েন করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং আসিয়ানের মতো আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে জাতিসংঘের কয়েক ডজন দূত সংঘাতরত অঞ্চলগুলোতে নিয়োজিত রয়েছে।কিছু প্রচেষ্টা পরাশক্তিগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব দ্বারা অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হয়। সংঘাত থামানোর জন্য লাঠি ও গাজর দেখানো তত্ত্ব হিসেবে সংঘাতরত পক্ষগুলোকে নিষেধাজ্ঞার ভয় এবং সহায়তার প্রলোভন দুটিই দেখানো হয়ে থাকে।কিন্তু শান্তি ধরে রাখার সু-অনুশীলিত এ পদ্ধতি খুব কমই কাজে লাগে। এটি সহিংসতার উত্তাপের ওপর একটি অস্থায়ী ঢাকনার মতো। কারণ, চাপে পড়ে সংঘাতের নায়কেরা হয়তো কোনো কাগজে শান্তি মেনে নেওয়ার কথা বলে সই করেন; কিন্তু অনিবার্যভাবেই তাঁরা পুনরায় সংঘবদ্ধ হওয়ার সুযোগ নেন। তারপর আবার যুদ্ধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। পুনরায় ‘শান্তি চুক্তি’ না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলতে থাকে। এ চক্র এভাবে চলতেই থাকে।
এর চেয়েও খারাপ বিষয় হলো, শান্তির অকাল হস্তক্ষেপ অনেক সময় সংঘাতকে দীর্ঘায়িত করে, যেমনটি বসনিয়া–হার্জেগোভিনা এবং কোরীয় উপদ্বীপে হয়েছিল। কারণ, দ্বন্দ্ব তখনই শেষ হয়, যখন উভয় পক্ষই তা করার জন্য সর্বান্তঃকরণে প্রস্তুত হয়।আদর্শগতভাবে যুদ্ধের অন্তর্নিহিত কারণ বা বিবদমান পক্ষের পার্থক্যগুলো যখন ভেতর থেকে সমাধান করা হয়, তখন যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু বাস্তবে এটি খুব কমই ঘটে। তাই প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধগুলো তখনই শেষ হয়, যখন এক পক্ষ সর্বার্থে জয়লাভ করে। এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথা ভাবা যেতে পারে।কিন্তু আধুনিক যুদ্ধ-পরিস্থিতি তৈরি করা বহুমাত্রিক এবং অনেক বেশি স্থিতিস্থাপক। বিশেষ করে যখন বহিরাগত পৃষ্ঠপোষকেরা বিভিন্ন দিক থেকে বিবদমানদের সহায়তায় এগিয়ে আসে, তখন যুদ্ধ থামানো কঠিন হয়ে পড়ে।পরিহাসের বিষয়, যদিও আমরা যুদ্ধ সম্পর্কে অনেক কিছু জানি, কিন্তু আমরা শান্তি স্থাপনে আজও সাবলীল হয়ে উঠতে পারিনি। কাউকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া সহজ, কিন্তু অনেক বিজয়ী এ পুরস্কার নেওয়ার পর বিব্রত হন; যখন দেখেন তাঁর চেষ্টা শান্তি ফেরাতে কাজ করছে না। এর অন্যতম উদাহরণ হলেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এবং ইথিওপিয়ার প্রেসিডেন্ট আবি আহমেদ।
এ কারণেই, সমস্ত শান্তি শেষ পর্যন্ত অস্থায়ী থেকে যায় এবং একবার একটি সমাজ সহিংসতার স্বাদ গ্রহণ করলে সেটি চিরকালই তা আঁকড়ে ধরে থাকে। বিশেষ করে যখন হলিউড, বলিউড এবং নেটফ্লিক্সের মিথ-নির্মাতারা ইতিহাসের স্মারকে পরিণত হয়, তখন সংঘাতের কথা মানুষের মন থেকে মোছা অসম্ভব হয়ে পড়ে।অতএব, আমাদের বিস্মিত হওয়া উচিত নয় যে কয়েক দশক ধরে অবিরাম সশস্ত্র সংঘাত জমে উঠেছে। বিশ্বে এখন প্রায় ১৭০টি বিভিন্ন ধরনের সংঘাত চলছে।২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে মৃত্যুর হারের তুলনায় গত বছর যুদ্ধে সরাসরি মারা যাওয়া সংখ্যা প্রায় তিন গুণ বেড়ে ১ লাখ ২০ হাজার জনে দাঁড়িয়েছে। এ ধরনের পরিসংখ্যান যুদ্ধের মানবিক খরচের একটি আংশিক খতিয়ান। কারণ, পরিসংখ্যানে যুদ্ধের পরোক্ষ ফলাফলগুলোকে অবমূল্যায়ন করে।সামনের দিকে তাকালে বোঝা যাবে, নতুন ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা এবং জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারি, সম্পদ আহরণের প্রতিযোগিতা এবং অকার্যকর বিশ্বায়নের কারণে আরও দ্বন্দ্ব দেখা দেবে। এ দ্বন্দ্ব থেকে বড় সংঘাত হতে পারে। (লেখক ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct