আপনজন ডেস্ক: রাজ্যের শিক্ষা মানচিত্রে আল আমীন মিশন এক উজ্জ্বল নাম। সংখ্যালঘু মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের মিলন ক্ষেত্র হিসেবে আল আমীন মিশনের জুড়ি নেই। আর সেই সব মেধাবীরা আল আমীন মিশনকে গৌরবান্বিত করে চলেছে। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক থেকে শুরু করে ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষা নিট-এ নজির সৃষ্টি করে চলেছে। তারই ভিত তৈরি হয় পঞ্চম শ্রেণি থেকে। তাই সংখ্যালঘু অভিভাবক-অভিভাবিকাদের এক বৃহদাংশ তাকিয়ে থাকেন আল আমীন মিশনের তাদের সন্তানদের ভর্তি করার জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষার দিকে। রবিবারই রাজ্যজুড়ে আল আমীন মিশনে সেই পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষা সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হল। আর পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় শুদু বেশি নয়, সর্বকালীন রেকর্ড সৃষ্টি করল। এবছর রাজ্যের বিভিন্ন জেলার ৬৮-টি পরীক্ষাকেন্দ্রের আয়োজন করেছিল আল আমীন মিশন। সেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় মোট ২৪৫২৫ জন পড়ুয়া ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে। তাদের মধ্যে ১৪৩৫৬ জন ছাত্র এবং ১০১৬৯ জন ছাত্রী । আল আমীন মিশনের ইতিহাসে এই সংখ্যা সর্বকালীন সর্বোচ্চ। গত বছর ৫১-টি পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রায় ১৬ হাজার ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষা দিয়েছিল। তবে, ইমামদের পরিবার থেকে বহু সংখ্যক এবং অন্যবারের চেয়ে বেশি এতিম ছাত্র-ছাত্রীও এবছরের পরীক্ষায় বসেছিল। ইমামদের ছেলে-মেয়ে এবং এতিমরা যাতে বেশি বেশি এই পরীক্ষায় বসতে পারে সেজন্য প্রথম থেকেই বিশেষ প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সাধারণ পরীক্ষার্থীর জন্য আবেদনপত্রের মূল্য ২৫০ টাকা হলেও ইমামদের সন্তান ও এতিমদের জন্য সেটি যথাক্রমে ১০০ ও ৫০ টাকা করা হয়। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা, পরীক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যা এবং আয়োজনের বিশালতায় এটিই মিশনের সবচেয়ে বড় প্রবেশিকা পরীক্ষা। মূখ্য কারণ রাজ্যের প্রায় প্রত্যেক জেলায় এক বা একাধিক বাংলা মাধ্যমের ৬৪-টি আবাসিক শাখায় কয়েক হাজার ছাত্র-ছাত্রীরা ভর্তির সুযোগ পেয়ে থাকে। এছাড়াও আরও একটি কারণ, চার দশক ধরে সংখ্যালঘু সমাজের ছাত্র-ছাত্রীর সাফল্য ও মেধার বিকাশে আল-আমীন মিশনের তুলনাহীন রেকর্ড। সদ্য প্রকাশিত ২০২২ সালের সর্বভারতীয় নিট-এর রেজাল্টও সে কথারই প্রতিধ্বনি করে। গত ৩৬ বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়ে নতুন কীর্তিমান গড়েছে মিশনের ছাত্র-ছাত্রীরা। পাঁচশোর বেশি পড়ুয়া সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেছে। ৬০০, ৫৯০, ৫৮০, ৫৭০, ৫৬০, ৫৫০ ও তার চেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে সফল হয়েছে যথাক্রমে ২৩১ জন, ৩০৯ জন, ৩৭৪ জন, ৪৩৩ জন, ৫০৫ জন ও ৫৫০ জন মিশনের ছাত্র-ছাত্রী। আল-আমীন মিশনের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সর্বোচ্চ সর্বভারতীয় র্যাঙ্ক ৪২৭ ( প্রাপ্ত নম্বর ৬৮৬) অর্জন করেছে কুশাঙ্কুর ভৌমিক। আবাসিক পড়ুয়াদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫৯৪তম স্থান অর্জন করেছে কোচবিহারের ইরফান হাবিব। তার প্রাপ্ত নম্বর ৬৮৫। ছাত্রীদের মধ্যে ৩৯১৫তম স্থান দখল করে শীর্ষে রয়েছে বীরভূমের ছাত্রী আখতারা পারভিন। আখতারার প্রাপ্ত নম্বর ৬৫৩। ছাত্র-ছাত্রীদের হস্টেলে রেখে তাদের মেধার বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে নিয়মতান্ত্রিক অনুশীলনে ধারাবাহিকভাবে সাফল্য পাচ্ছে মিশনের ছাত্র-ছাত্রীরা। স্বাধীনতা ও দেশভাগের পরবর্তীকালে যে হতাশা ও হীনমন্যতা গ্রাস করেছিল সংখ্যালঘু সমাজকে, শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে সেখান থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে বহু পরিবার ও সমাজ। সেকারনেই রাজ্যের একটি অসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য ছাত্র-ছাত্রীসহ অভিভাভবকদের এই আবেগ ও আকুতি। বেসরকারি ক্ষেত্র বাদ দিলেও সরকারি শিক্ষাক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধা দিন প্রতিদিন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাময় হয়ে উঠছে। আল-আমীনের ব্যবস্থাপনা ও বিশেষকরে শিক্ষার সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট বিভাগ পড়ুয়াদের মেধার বিকাশ ও সাফল্য সুনিশ্চিত করতে সবসময় সজাগ ও সচেষ্ট। সেকারনে এ-বছরের প্রবেশিকা পরীক্ষায় কিছু জরুরি পরিবর্তন গ্রহণ করা হয়েছে। মিশনের ভর্তি পরীক্ষার ইতিহাসে এই প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষা হচ্ছে দু-টি পর্বে। গতকাল ১৮ সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রথম অর্থাৎ প্রারম্ভিক বা প্রিলিম পর্বে সফল ছাত্র-ছাত্রীরাই আগামী ২৩ অক্টোবর ২০২২-এ অনুষ্ঠিতব্য দ্বিতীয় অর্থাৎ মুখ্য বা মেইন পর্বে পুনরায় বসার সুযোগ পাবে। মেইন পর্বের পরীক্ষায় প্রতিটি বিষয়ে কমপক্ষে ২০ শতাংশ নম্বরসহ প্রাপ্ত মোট নম্বরের ভিত্তিতে সফল ছাত্র-ছাত্রীরাই কেবলমাত্র কাউন্সেলিং-এর জন্য নির্বাচিত হবে। প্রথম পর্বের প্রবেশিকা পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হবে আগামী ১০ অক্টোবর। সফল ছাত্র-ছাত্রীদের এসএমএস করে ফল জানানো হবে। এছাড়াও মিশনের ওয়েবসাইট www.alameenmission.org থেকেও ফল জানা যাবে।
প্রবেশিকা পরীক্ষার পদ্ধতিগত পরিবর্তন নিয়ে সাধারণ সম্পাদক এম নুরুল ইসলাম জানান, আল-আমীন মিশন শুরু থেকেই মুখ্যত সুবিধাবঞ্চিত গ্রামীণ পরিবারের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের হস্টেলে রেখে দ্বিতীয় পিতামাতা হিসেবে তাদের মেধার লালনপালন করে আসছে। সেই ধারা এখনো সচল। কিন্তু বর্তমানে দেশ ও রাজ্যের শিক্ষানীতিতে বড়সড় পরিবর্তন ঘটেই চলছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, আগে রাজ্যস্তরের জয়েন্ট এন্ট্রান্সের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীরা মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পেত। কিন্তু এখন সেটি সর্বভারতীয় নিট-এর মাধ্যমে হচ্ছে। তিনি সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, মেডিকেলের প্রবেশিকা পরীক্ষায় আল-আমীনের প্রত্যেক বছরের ফল তার আগের বছরের সাফল্যকে ধারাবাহিকভাবে অতিক্রম করে রাজ্য ছাড়িয়ে দেশে এক অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছে। তিনি আরও বলেন, পিছিয়ে থাকা গোষ্ঠীর জন্য উন্নতির একমাত্র সোপান শুধু শিক্ষা নয় গুণমানসম্পন্ন শিক্ষার ধারাবাহিক অনুশীলন। সেকারণে আমরা মেধার প্রশ্নে এবছর থেকে দ্বিস্তরীয় প্রবেশিকা পরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। প্রসঙ্গক্রমে মিশনের নতুন শিক্ষা-প্রকল্পের উল্লেখ করেন তিনি। বহুদিন আগে থেকেই তাঁর ভাবনায় ছিল কেবলমাত্র এতিম শিশুদের জন্য এক শিক্ষাঙ্গন। কারণ পবিত্র কুরআনে এতিমদের প্রতি কেবল সদয় হওয়া নয়, তাদের জন্য সামাজিকস্তরে সুব্যবস্থা থাকার কথাও বলা হয়েছে। তাছাড়া এতিমদের প্রতি বিশেষ সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনে নির্দেশিত ও উৎসাহিত করতে মহানবী মুহাম্মদ(সা.) বলেছেন—‘‘ আমি ও এতিম প্রতিপালনকারী জান্নাতে এভাবে থাকব (তিনি তর্জনী ও মধ্য অঙ্গুলি দিয়ে ইঙ্গিত করেন। এবং এ দুটির মধ্যে তিনি সামান্য ফাঁক করেন)।’’ সেকারণে হৃদয় উৎসারিত ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধে নিজ জমিতেই তিনি গড়ে তুলছেন ‘শান্তিনীড়’। শোনা যাক তাঁর নিজ কথায় সে-কাহিনী : প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আল-আমীন মিশনের দৃষ্টিপরিধির মধ্যে ছিল এতিমরা। রাজ্যের পশ্চাদপদ সমাজের এতিম শিশুরা স্বাভাবিক কারণেই আরো পশ্চাদপদ এবং অবহেলিত। খাওয়া- পরাই যেখানে মুখ্য সমস্যা, শিক্ষা সেখানে অলীক রাজ্যে প্রবেশের মতো। কিন্তু অলীক বিষয়কে বাস্তবে রূপদানই আল-আমীনের কাজ। শুরুর দিন থেকেই সাধ্য-অনুযায়ী এতিম পড়ুয়াদের বিনা ফি বা খুব কম ফি-তে পড়ার বন্দোবস্তে মিশন সক্রিয়। প্রতি বছর প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস মার্কসে অনেকটাই ছাড় দিয়ে প্রায় শতাধিক এতিম পড়ুয়াকে ভর্তি নেওয়া হয় মিশনে। ইতিমধ্যে মিশনের হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে শতশত এতিম জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে মিশনের সমস্ত শাখা মিলে ৬২৭ জন এতিম ছাত্র-ছাত্রী পাঠরত আছে।
এতিম ছেলে-মেয়েদের জন্য নতুন পরিকল্পনা করেছে মিশন। দেখা গেছে, পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণিতে যে-সব এতিম পড়ুয়া আল-আমীনে পড়তে আসে, মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও অনেকে নানা সামাজিক আর পারিবারিক কারণে অনেকক্ষেত্রেই অন্যদের থেকে পিছিয়ে থাকে। এই ভাবনা থেকে এতিমদের বিশেষ পর্যবেক্ষণ সহ পাঠদানের উদ্দেশ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতেই ভর্তির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে—যাতে করে পঞ্চম শ্রেণি থেকে মিশনের বিভিন্ন শাখায় গিয়ে তারা বাকি সকলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সমানভাবে দক্ষ হয়ে ওঠে। এই উদ্দেশ্যে মিশনের খলতপুর ক্যাম্পাস সংলগ্ন আরও এক নতুন ক্যাম্পাসে একটি ছয়তলা ভবন নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে, যার নাম রাখা হয়েছে ‘শান্তিনীড়’। দু-শোর বেশি ছাত্র-ছাত্রী এই ভবনে থেকে অন্যান্য পড়ুয়াদের সঙ্গে আল-আমীন মডেল স্কুল খলতপুর-এ প্রশিক্ষিত হবে। বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের তত্ত্বাবধানে নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্পূর্ণ আধুনিক পদ্ধতিতে আনন্দের সঙ্গে তারা লেখাপড়া করবে, স্নেহ আন্তরিকতা আর মূল্যবোধের স্পর্শ নিয়ে। এতিম অর্থে পিতৃহীন। কিন্তু মাতৃহীন শিশুদের অসহায়তাও আমাদের অনেককে ভাবায়। সামাজিক কারণে এরাও এতিমেরই গোত্রভুক্ত। এছাড়া রয়েছে আরও বঞ্চিতরা, যারা পিতামাতাহীন। তাই, যাত্রাশুরুকালে এতিম ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে শিক্ষাক্ষেত্রে এরা সফল হতে পারে, সমাজের উচ্চতম স্থানে পৌঁছতে পারে। ভূমিকা নিতে পারে পরিবার সমাজ রাজ্য ও দেশের উন্নয়নে। গত ১০ আগস্ট থেকে শান্তিনীড়-এ ভর্তির জন্য অনলাইন ও অফলাইনে ফর্ম পূরণ শুরু হয়েছে। শেষ হবে ৩ অক্টোবর। ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের জানুয়ারি থেকে শান্তিনীড়ে তাদের আবাসিক পড়াশোনা শুরু হচ্ছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct