জাগো দা
আব্দুস সামাদ আনসারী
সন্ধ্যায় গরু ছাগলগুলো গোয়ালে বেঁধে জাগো দা বামুনপুকুর পাড়ে চলে যায় । মস্ত চাচার শরীরটা ঠিক যাচ্ছে না। এখন বাড়ির সব কাজকর্ম জাগো দা করে। রাত্রে আবার এসে কাজকর্ম সেরে দলিজে শুয়ে পড়ে। গত কয়েকদিন ধরে বাবা জাগোদাকে বকাবকি করছে। জমিতে এখনোও সার ছড়ানো হয় নি। এরপর বর্ষা এসে গেলে গরুর গাড়ির চাকা নরম মাটিতে ফেঁসে যাবে, সার ছড়াতে অসুবিধা হবে। জাগো দাকে বাবা সার ফেলার কথা বললে জাগো দা বলে – বর্ষা ঢুকার আগে ঠিক সার ফেলে দিব বড়মুনিব। বাবা একটু বিরক্ত হয়ে বলে- মস্ত থাকলে আমাকে এত চিন্তা করতে হতো না। সবার জমিতে সার ফেলা হয়ে গেল, কেবল আমাদেরই বাকি। তুই খালি খাস আর ঘুমাস। জাগো দা কিছু না বলে সোজা দলিজে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। পরের দিন সকালে বাবার চিৎকার শুনে আমার ঘুম ভেঙে গেল। উঠে শুনি, বাবা বলছে “আমাদের সার গাদা থেকে সব সার চুরি হয়ে গেছে”।
—কত করে জাগোকে বললাম সারগুলো জমিতে ছড়িয়ে দে, ছড়িয়ে দে, আমার কথা তার কানে যায় না। এখনও দেখ, কেমন বেলা ওঠা পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। গরুবাছুরগুলোকে খেতে দেবার নাম পর্যন্ত নাই। আমি মনে মনে ভাবলাম— এতবেলা পর্যন্ত তো জাগো দা কোনওদিন ঘুমায় না। শরীর-টরির খারাপ হল নাকি। সার গাদায় গিয়ে দেখি একটুও সার পড়ে নেই। মনে হচ্ছে একদম ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে নিয়ে গেছে। গোয়াল ঘরে ঢুকে দেখি গরু ছাগল গুলো দিব্বি খাবার খাচ্ছে। বলদ দুটোর গা চকচক করছে, আর গা থেকে দু এক ফোটা জল ঝরে পড়ছে, মনে হচ্ছে যেন এখুনি স্নান করিয়েছে। খামারে গিয়ে দেখি গরুর গাড়ির কাঠের চাকায় সার মাটি লেগে আছে। ব্যাপারটা আমি কিছুটা আঁচ করছিলাম। আমি একদৌড়ে আমাদের কাছের মাঠে গিয়ে দেখি আমাদের সব জমিতে সার ছড়ানো হয়েছে। আমার কাছে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হয়ে গেল। এ নিশ্চয়ই জাগো দার কাজ। ঘরে এসে বাবাকে ঘটনাটি বললাম। জাগো দা একরাতে আমাদের সমস্ত জমিতে সার ছড়িয়ে দিয়েছে। জাগো দার কাজে আজ বাবা খুব খুশী। জাগো দা এতক্ষণে ঘুম থেকে উঠে দাঁতন দিয়ে দাঁত মাজছে। চা-মুড়ি খেয়ে ঘাস কাটতে যাবে।
বাবা জাগো দাকে বলল—তুই এসব কাণ্ড করেছিস, আমাকে তো একটু বলতে পারতিস। আমি কি না কি ভাবছিলাম। যাকগে আজ দুপুরে তুই আমাদের ঘরে খাবি। কই গো আজ দুপুরে জাগোর জন্যও রান্না করো,— বাবা, মাকে বলল। এই বলে বাবা অফিসে চলে গেল। আজ বাবার অফিসে কোন অনুষ্ঠান আছে বোধ হয়। অনুষ্ঠানে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও বাবা খায় না, বাড়িতে খাবার নিয়ে চলে আসে। জাগো দা কাস্তে, দড়ি আর সার বস্তা নিয়ে ঘাস কাটতে বেরিয়েছে। আমাদের বাড়িতে আট-ন জনের রান্না হয়। বাড়ির সবার খাওয়া হয়ে গেছে। মা আর বাবা বাকি। ইতিমধ্যে জাগো দা ঘাস নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্নান করে এসে বারান্দায় বসেছে। মা খুব যত্ন করে জাগোদাকে খেতে দিয়েছে। দু- থালা ভাত শেষ। মা জাগোদাকে জিজ্ঞাসা করল— আর ভাত নিবি? জাগো বলল— একটু দাও। আরও একথালা ভাত প্রায় শেষ, এমন সময় বাবা অফিস থেকে ফিরে এসে মাকে বলল— অফিসে অনুষ্ঠান ছিল আমি একটু মাংস নিয়ে এসেছি, জাগোকে একটু দাও। মা একটু রেগে গিয়েই জাগোকে সব মাংসটা দিয়ে দিল।বাবা জাগোকে জিজ্ঞাসা করল— জাগো আর একটু ভাত নিবি? জাগো কিছু বলার আগেই মা বলল— আর ভাত নেই। জাগো একাই তিনজনের ভাত খেয়েছে। রান্না চাপিয়েছি তুমি একটু ঘুরে এসো তারপর তোমাকে খেতে দিচ্ছি। আমি মনে মনে বললাম ও তো আজ তিনজনের চেয়েও বেশি জনের কাজ একাই করেছে।
**লেখক দক্ষিণ ২৪ পরগনার মগরাহাট থানার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct