যেকোনও গণহত্যামূলক আক্রমণের উদ্দেশ্য হল রাষ্ট্রত্ব নির্মূল করা। রাষ্ট্রের পরিচয় মুছে ফেলা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, আক্রমণের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণ তো হয়-ই না, বরং ঘটে উলটোটা। যেমনটা দেখা যাচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধে। রাশিয়ার সেনা অভিযানের ফলে ইউক্রেনে ‘ডি-রাশিয়াফিকেশন’ (ডি-রাশিয়াফিকেশন হল রুশ প্রভাব অপসারণ করার প্রক্রিয়া। ইউক্রেনে রাশিয়ার নাম-নিশানা মুছে ফেলতে ডি-রাশিয়াফিকেশন শুরু হয়ে গেছে। তা নিয়ে লিখেছেন তারাস কুজিও। আজ শেষ কিস্তি।
বলা বাহুল্য, রাশিয়ার আক্রমণ তথা ইউক্রেনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ ইউক্রেনের সঙ্গে দেশটির অতীত সম্পর্ককে আমূল পরিবর্তন করেছে। এই সম্পর্ক অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিক শীতল ও তিক্ত। যুদ্ধের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দুই প্রতিবেশী দেশ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। দুই দেশের সম্পর্কের বিভাজন প্রশস্ত থেকে প্রশস্ততর হচ্ছে দিনে দিনে। দুই-তৃৃতীয়াংশ রাশিয়ান যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে যাওয়া নিয়ে আক্ষেপ করে, সেখানে মাত্র ১১ শতাংশ ইউক্রেনীয়র এ বিষয়ে কম-বেশি আগ্রহ রয়েছে। একইভাবে ৮৪ শতাংশ ইউক্রেনীয় জোসেফ স্ট্যালিনের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে, যখন বেশির ভাগ রাশিয়ান এই সোভিয়েত একনায়কের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে আজও।
বিংশ শতাব্দীতে ইউক্রেনে যে মুক্তি আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে, তা আজ এক বড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেনীয় স্বাধীনতার প্রথম দশকগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদী দলগুলোর ইস্যুতে জনমত বেশ খানিকটা বিভক্ত ছিল। ২০১৪ সালের ইউরোমাইদান বিপ্লবের পর জনমত বাস্তবিক অর্থে পরিবর্তিত হতে শুরু করে। সেই সময়কালে ওইউএন (ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীদের সংগঠন) এবং ইউপিএ (ইউক্রেনীয় বিদ্রোহী সেনাবাহিনী)-এর প্রতি ইউক্রেনীয় জনগণের ইতিবাচক মনোভাবের হার ছিল ৪১ শতাংশ। অথচ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রুশ বাহিনী ইউক্রেনে আক্রমণের পর দলগুলোর প্রতি ইউক্রেনবাসীর সমর্থনের এই হার গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৮১ শতাংশে। অর্থাত্, ইউক্রেনীয়রা নিজ দেশের দলগুলোকে সমর্থন দিচ্ছে এবং একই সঙ্গে রাশিয়ার প্রতি তাদের বিমুখতা বেড়েছে এবং এই মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার প্রবণতা ক্রমবর্ধিষ্ণু। মোটাদাগে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, ইউক্রেনীয়রা এখন ‘ক্রেমলিন’ ও ‘সাধারণ রাশিয়ান’-এর মধ্যে পার্থক্য করতে নারাজ। তারা এখন উভয়কেই একই দৃষ্টিতে দেখে থাকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া ও পূর্ব ইউক্রেন আক্রমণ করে বসলে বেশির ভাগ ইউক্রেনীয় রাশিয়ার নেতৃৃত্বকে দায়ী করেছিল; তারা এতে সাধারণ রাশিয়ানদের জড়ায়নি। কিন্তু এখনকার চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। ক্রেমলিন ও রাশিয়ার সাধারণ জনগণ উভয়কেই বর্তমান আক্রমণের জন্য দায়ী করছে ইউক্রেনীয়রা। এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, রাশিয়ানদের সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব পোষণকারী ইউক্রেনীয়র সংখ্যা ২০১৮ সালের ৪৭ শতাংশ থেকে কমে আজ তা মাত্র ৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এটা আশ্চর্যজনক যে, আক্রমণের প্রথম ছয় মাসে বেশির ভাগ বেসামরিক নাগরিক আক্রমণের শিকার হয়েছে। দেশের দক্ষিণ ও পূর্বে রাশিয়ানভাষী ইউক্রেনীয়রা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে বেশি। বলা হয়, এসব অঞ্চলের মানুষকে রক্ষা করে চলেছেন বলে পুতিন দাবি করেন। যদিও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। শুধু মারিউপোলেই হত্যা করা হয়েছে কয়েক হাজার মানুষকে। এছাড়া ইউক্রেনের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চল এবং এমন কয়েক ডজন শহর-গ্রামে রাশিয়ার সেনাবাহিনী নির্বিচার গুলি চালিয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে, যেসব এলাকাকে ক্রেমলিন আখ্যায়িত করে থাকে ‘ঐতিহাসিক রাশিয়ান ভূমি’ হিসেবে। এই হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা বিবেচনা করে একে ‘গণহত্যা’ হিসেবে অবিহিত করেছে ইউক্রেনীয়রা। ৮৯ শতাংশ ইউক্রেনীয়র বিশ্বাস, ক্রেমলিন ইউক্রেনে ‘গণহত্যা’ চালাচ্ছে। প্রায় ১০ জন ইউক্রেনীয়র মধ্যে ৯ জন মনে করেন যে, ইউক্রেন রাষ্ট্র ও ইউক্রেনের জাতীয় পরিচয় নির্মূল করাই রাশিয়ার উদ্দেশ্য। আর ১০ জনের ৫ জন মনে করেন, রাশিয়া ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করতে মরিয়া।
এই সমস্ত সমীক্ষা, পরিসংখ্যান স্পষ্ট ধারণা দেয় যে, ইউক্রেনবাসীর মনে রাশিয়ার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব অবশিষ্ট নেই আর। ইউক্রেনীয়দের মনে রাশিয়ার অস্তিত্ব আজ এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এর সঙ্গে ত্বরান্বিত হচ্ছে ডি-রাশিয়াফিকেশন। দেশ জুড়ে দৃঢ় ধারণা রয়েছে যে, একটি চূড়ান্ত বিজয় ছাড়া ইউক্রেন কখনোই নিরাপদ হবে না। প্রায় অর্ধেক ইউক্রেনীয় বিশ্বাস করে, রাশিয়ার সঙ্গে কখনোই তাদের পুনর্মিলন হতে পারে না। ইউক্রেন যুদ্ধ কত দিন স্থায়ী হবে তা বলা মুশকিল। তবে এটি ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, চূড়ান্ত ফলাফল হবে, ডি-রাশিয়াফিকেশন বেড়ে জন্ম নেবে ‘ইউরোপীয় ইউক্রেন’। ভ্লাদিমির পুতিন ঠিক এটাই ঠেকানোর জন্য এতটা মরিয়া। রাশিয়ান স্বৈরশাসকের আক্রমণ-গণহত্যা আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসে এক মারাত্মক ভুল—এতে কোনো সন্দেহ নেই। দিন যত গড়াবে, এটি তত বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। (সমাপ্ত...)
লেখক ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব কিইভ মোহাইলা একাডেমির অধ্যাপক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct