যেকোনও গণহত্যামূলক আক্রমণের উদ্দেশ্য হল রাষ্ট্রত্ব নির্মূল করা। রাষ্ট্রের পরিচয় মুছে ফেলা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, আক্রমণের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণ তো হয়-ই না, বরং ঘটে উলটোটা। যেমনটা দেখা যাচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধে। রাশিয়ার সেনা অভিযানের ফলে ইউক্রেনে ‘ডি-রাশিয়াফিকেশন’ (ডি-রাশিয়াফিকেশন হল রুশ প্রভাব অপসারণ করার প্রক্রিয়া। ইউক্রেনে রাশিয়ার নাম-নিশানা মুছে ফেলতে ডি-রাশিয়াফিকেশন শুরু হয়ে গেছে। তা নিয়ে লিখেছেন তারাস কুজিও। আজ প্রথম কিস্তি।
যে কোনও গণহত্যামূলক আক্রমণের উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্রত্ব নির্মূল করা। রাষ্ট্রের পরিচয় মুছে ফেলা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, আক্রমণের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণ তো হয়-ই না, বরং ঘটে উলটোটা। যেমনটা দেখা যাচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধে। রাশিয়ার সেনা অভিযানের ফলে ইউক্রেনে ‘ডি-রাশিয়াফিকেশন’ (ডি-রাশিয়াফিকেশন হলো রুশ প্রভাব অপসারণ করার প্রক্রিয়া। ইউক্রেনে রাশিয়ার নাম-নিশানা মুছে ফেলতে ঔপনিবেশিক অতীতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন ফলক, চিহ্ন, আবক্ষ, প্যানেল, স্মৃতিস্তম্ভ ইত্যাদি সরিয়ে ফেলা বা মুছে দেওয়াই ডি-রাশিয়াফিকেশন নামে অবিহিত) আরো চাঙ্গা হয়েছে। ডি-রাশিয়াফিকেশনের পালে হাওয়া লেগেছে ইউক্রেনে। আগ্রাসন শুরুর অর্ধবার্ষিক পার হয়েছে ইতিমধ্যে। ছয় মাসের বেশি এই সময়কালে ডি-রাশিয়াফিকেশনের প্রশ্নে ইউক্রেনীয়দের সমর্থন সত্যিকার অর্থে দেশব্যাপী একটি সার্বজনীন বিষয়ে পরিণত হয়েছে। শতবর্ষের রাশিয়াফিকেশনের (রাশিয়াকরণ—ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধির প্রক্রিয়া) আকাঙ্ক্ষা উলটে দিচ্ছে পুতিনের যুদ্ধ। যুদ্ধের দামামা ধূলিস্যাত্ করছে ভ্লাদিমির পুতিনের ‘নতুন করে রাশিয়ান সাম্রাজ্য গড়ে তোলার স্বপ্ন’।
পুতিনের অপরাধমূলক যুদ্ধ বাস্তবিক অর্থে ঐতিহাসিক প্রভাব ফেলছে ইউক্রেনীয় সমাজে। ইউক্রেনীয়দের ব্যাপকভাবে একত্রিত করছে এই যুদ্ধ। রাশিয়ার আক্রমণের কারণে লক্ষাধিক ইউক্রেনীয় দেশের পশ্চিমে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সেখানে অনেকেই আশ্রয় পেয়েছে কিংবা কেউ কেউ পাড়ি জমিয়েছে ইইউতে (ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন)। সর্বত্রই তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অবস্থান করছে। এই বিষয়টি থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান করা ইউক্রেনীয়রা এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন। এর মাধ্যমে পারস্পারিক সংহতি ও জাতীয় ঐক্যের যে অনুভূতি জেগে উঠছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিককালের অসংখ্য জরিপ-মতামত এই ইঙ্গিত দেয় যে, জাতীয় পরিচয়, ভাষা, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক এবং ভবিষ্যত্ ভূরাজনৈতিক লক্ষ্যের প্রশ্নে সব অঞ্চলের ইউক্রেনীয় এক অভিন্ন বন্ধনে আবদ্ধ। আর সব থেকে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, জাতীয় ইস্যুতে ইউক্রেনীয়রা এখন সবচেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ। জাতীয় সংহতি দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রোথিত হওয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল দেশের সামরিক বাহিনীর আন্তরিক প্রচেষ্টা। এই বাহিনী হাজার হাজার ইউক্রেনীয়কে সংগঠিত করার কাজ করেছে। এর মধ্যে আছেন পূর্ব ও দক্ষিণের বহু নাগরিক, যারা ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনীর হয়ে ফ্রন্টলাইনে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। একইভাবে দেশ জুড়ে রয়েছে ইউক্রেনের বৃহৎ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। এই যে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ একসঙ্গে যুদ্ধ করছেন, এক কাতারে শামিল হয়েছেন—ইউক্রেনের ইতিহাসে এ এক অনন্য ঘটনা। বিভিন্ন পেশার ও ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের নানা ধরনের লোকজনকে প্রথমবারের মতো একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ করে দিয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ। এর মাধ্যমে এক শামিয়ানার নিচে একাত্ম হয়েছেন ইউক্রেনীয়রা।
রুশ আক্রমণ ইউক্রেনের ভাষাগত ডি-রাশিয়াফিকেশনকেও ত্বরান্বিত করেছে। ক্রমবর্ধমান সামরিক আগ্রাসনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে রাশিয়ান ভাষার বিষয়টিও। দেশের সরকারি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ‘ইউক্রেনীয় (ইউক্রেনের ভাষা)’কে সমর্থনকারী ইউক্রেনীয়দের সংখ্যা বেড়েছে। এই হার বেড়ে হয়েছে ৮৬ শতাংশ। একই সঙ্গে সামনে এসেছে জাতিগত পুনঃপরিচয়ের প্রশ্ন। এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৯২ শতাংশ ইউক্রেনীয় জাতিগতভাবে নিজেদের ইউক্রেনীয় হিসেবে মনে করে। এই পরিসংখ্যান অনুসারে, এটা পর্তুগাল ও পোল্যান্ডের পরে ইউরোপের তৃৃতীয় সর্বাধিক সমজাতীয় দেশের কাতারে দাঁড় করাবে ইউক্রেনকে। একই সমীক্ষায় দেখা যায়, বর্তমানে ইউক্রেনীয় জনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ জাতিগতভাবে রাশিয়ান। এই সংখ্যা ১৯৮৯ সালের সোভিয়েত আদমশুমারির সময় ছিল ২২ শতাংশ। এবং ১৭ শতাংশ ছিল ২০০১ সালের ইউক্রেনীয় আদমশুমারির সময়। অর্থাত্, ইউক্রেনে জাতিগত রাশিয়ান অনুপাতের ক্রমাবনতি উল্লেখযোগ্যভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। অযাচিত যুদ্ধ কিংবা বলপ্রয়োগ বা অবৈধ আগ্রাসন জাতিগত আইডেনটিটিকে নিম্নমুখী করে তোলার ক্ষেত্রে যে কী পরিমাণ প্রভাব বিস্তার করতে পারে, ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
লেখক ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব কিইভ মোহাইলা একাডেমির অধ্যাপক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct