শুধু একাডেমিক ফলাফলকে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দিয়ে আমরা শুধু শিশু-কিশোরদের শৈশব-কৈশোরকেই হত্যা করছি না, তাদের এমন দুর্বিষহ জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছি যে তারা অনেক সময় তাল মেলাতে না পেরে নানা রকম অনাকাঙ্ক্ষিত বিচ্যুতিতে জড়িয়ে পড়ছে; এমনকি আত্মহননের দিকেও চলে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক এবং স্কুল-কলেজ প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে নানা কথা বলা হয় এবং তার অনেকটাই হয়তো সংগত। তাদের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে লিখেছেন রিজওয়ানুল ইসলাম। আজ শেষ কিস্তি।
শহরের মধ্যে ইনডোর কিছু ক্ষণিক বিনোদন ছাড়া শহুরে শিশু-কিশোরদের বিনোদনের সুযোগ নেই বললেই চলে। নিকো পার্ক শহর থেকে দূরে। স্বল্প কয়েকটি শিশূ পার্ক তাকলেও তা যথেষ্ট নয়। এভাবে আমরা শুধু তাদের আত্মকেন্দ্রিক করে গড়ে তুলছি কি না, এমনকি অনেক সময় তাদের চিন্তা-ভাবনাকে অত্যন্ত সীমিত পরিসরে বেঁধে ফেলছি কি না, তা নিয়ে মনস্তত্ত্ববিদেরা গবেষণা করতে পারেন। শিশু-কিশোরদের ভালো স্কুলে পড়া বা তাদের ভালো একাডেমিক ফল অর্জন করা অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবকদের জন্য মর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ শিশু-কিশোরদের বৃহত্তর পরিসরে একাডেমিক বিকাশ নিশ্চিত করার জন্য ভালো ফল করার চেয়ে তাদের মধ্যে জানার ইচ্ছা এবং প্রশ্ন করার অভ্যাস গড়ে তোলাটা অনেক বেশি প্রয়োজন, সেটা হয়তো অনেক শিক্ষাবিদই বলবেন।
জীবনের সব একাডেমিক পরীক্ষায় ভালো ফল করা অবশ্যই কৃতিত্বের ব্যাপার। কিন্তু সব সময় প্রথম হতে হবে বা অভিভাবকের মনের মতো ফলাফল করতেই হবে, এটা সুস্থ জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না। যেকোনো মূল্যে ভালো একাডেমিক ফল অর্জন করার জন্য অনেক অভিভাবক ছাত্র-ছাত্রীদের অসুস্থতার অজুহাতে স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে কোচিংয়ে পাঠিয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে উৎসাহিত করেন, এমন অভিযোগও শোনা যায়। এই সাময়িক সাফল্যের জন্য মিথ্যাচারকে উৎসাহ বা প্রশ্রয় দিয়ে আমরা অভিভাবকেরা শিশু-কিশোরদের কী শেখাচ্ছি, তা আমরা বুঝলে শুধু শিশু-কিশোরদের নয়, দেশ ও জাতিরও মঙ্গল হতো। এসব শিশু-কিশোর বড় হয়ে তাদের পেশাগত জীবনে সাফল্যের জন্য নানা রকম শর্টকাট পন্থা অনুসরণ না করলেই বরং তা অস্বাভাবিক হবে। যাঁরা সমাজ চালান, যাঁরা পৃথিবীতে মহান পরিবর্তন আনেন, আমরা যাঁদের আদর্শ হিসেবে মানি, তাঁদের অনেকেরই একাডেমিক ফলাফল তথৈবচ, তাতে তাঁরা কোনোভাবেই ছোট হন না। যে শিশু ভালো ছবি আঁকতে পারে, যার মৌলিক সৃজনশীল লেখার হাত রয়েছে, খেলার প্রতি যার আগ্রহ রয়েছে, তাকে পড়াশোনায় অতিরিক্ত জোর করে ভালো কোনো ফল পাওয়া দুরূহ। ভালো একাডেমিক ফলের মাধ্যমে হয়তো আজকের শিশু-কিশোররা আগামী দিনে সফল বা ক্ষমতাশালী পেশাজীবী হবে। কিন্তু এটাই জীবনের লক্ষ্য হওয়া সমীচীন নয়, বিশেষ করে তাদের ক্ষেত্রে, যারা এটা চায় না। মা-বাবাকে খুশি করার জন্য চিকিৎসা বা প্রকৌশলবিদ্যা পড়া ছেলেমেয়ের সংখ্যাও একেবারে নগণ্য নয়। এমনকি আলাপচারিতায় অনেক ছাত্রছাত্রীর মুখে শুনতে পাই, তাঁরা আইন পড়ছেন, কারণ, তাঁদের মা-বাবা চেয়েছেন। নিজের জীবনের অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণের জন্য ছেলেমেয়েদের প্ররোচিত করা, যা কখনো কখনো কিনা বাধ্য করার পর্যায়ে চলে যায়, তা কতটা সমীচীন, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। (সমাপ্ত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct