শুধু একাডেমিক ফলাফলকে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দিয়ে আমরা শুধু শিশু-কিশোরদের শৈশব-কৈশোরকেই হত্যা করছি না, তাদের এমন দুর্বিষহ জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছি যে তারা অনেক সময় তাল মেলাতে না পেরে নানা রকম অনাকাঙ্ক্ষিত বিচ্যুতিতে জড়িয়ে পড়ছে; এমনকি আত্মহননের দিকেও চলে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক এবং স্কুল-কলেজ প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে নানা কথা বলা হয় এবং তার অনেকটাই হয়তো সংগত। তাদের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে লিখেছেন রিজওয়ানুল ইসলাম। আজ প্রথম কিস্তি।
পত্র-পত্রিকা বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মা-বাবার প্রত্যাশানুরূপ ফলাফল না করায় মা-বাবা বা অন্যদের গঞ্জনার শিকার হয়ে শিশু-কিশোরদের আত্মহননের পথ বেছে নেওয়ার খবর পাওয়া যায়। শিশু-কিশোরদের অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এ পরিণতির পেছনে তথাকথিত ‘ফেল করা’ শিশু-কিশোরদের থেকে তাদের অভিভাবক এবং ক্ষেত্রবিশেষে স্কুল কর্তৃপক্ষের অবহেলা বা আগ্রাসী আচরণ বেশি দায়ী বলে ভাবা অসমীচীন হবে না। আমরা এমন একটা অসুস্থ সমাজে বাস করছি, যেখানে আমরা এক সর্বগ্রাসী সাফল্যের পেছনে প্রতিনিয়ত ছুটে চলেছি। আমরা যেকোনো মূল্যে ভালো ফলাফল অর্জনকেই অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে অস্তিত্বের তাগিদে কঠিন প্রতিযোগিতা থাকাটা অস্বাভাবিক বা অন্যায্য কিছু নয়। সাফল্যের জন্য যখন আমরা কোমলমতি শিশু-কিশোরদের প্রতি একধরনের বিক্রয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেওয়া মার্কেটিং ম্যানেজারের মতো আচরণ করি, তখন তা অবশ্যই অসুস্থ। শুধু একাডেমিক ফলাফলকে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দিয়ে আমরা শুধু শিশু-কিশোরদের শৈশব-কৈশোরকেই হত্যা করছি না, তাদের এমন দুর্বিষহ জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছি যে তারা অনেক সময় তাল মেলাতে না পেরে নানা রকম অনাকাঙ্ক্ষিত বিচ্যুতিতে জড়িয়ে পড়ছে; এমনকি আত্মহননের দিকেও চলে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক এবং স্কুল-কলেজ প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে নানা কথা বলা হয় এবং তার অনেকটাই হয়তো সংগত।
আজকাল অনেক শিক্ষাবিদই এটা বেশ জোরেশোরে বলছেন যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা অতিমাত্রায় পরীক্ষণনির্ভর হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শিশু-কিশোরদের জীবনের বৃহত্তর অংশ কাটে পরিবারের সঙ্গে, বিদ্যালয় থেকে দূরে এবং সে ক্ষেত্রে আমরা অভিভাবকেরা যে ভূমিকা রাখছি, তা নিয়ে তুলনামূলক অনেক কম আলোচনা হয়ে থাকে। ভালো একাডেমিক ফল অবশ্যই শিশু-কিশোরদের চেষ্টা, শিক্ষকদের ভালো পাঠদান এবং অভিভাবকদের যথার্থ তদারকের নির্দেশ করে। কিন্তু একাডেমিক ফলাফলের চেয়ে আরও অনেক বড় ব্যাপার হল, শিশু-কিশোরদের মানুষ হিসেবে সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা। আজ নিজের শৈশব-কৈশোরের কথা মনে পড়লে নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হয়। একাডেমিক ফলাফল মানুষের জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতার একমাত্র পরিচায়ক—তখনো মফস্বল শহরে এমন মরিয়া ভাব ছিল না। হয়তো এর কারণ ছিল, তখন অনেক অভিভাবক শিশুদের পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। কিন্তু যেসব শিক্ষার্থীর পড়াশোনার প্রতি প্রকৃত আগ্রহ ছিল, তাতে তাদের এমন কোনো ক্ষতি হতো বলে মনে হয় না। আর তাতে আমরা যে শুধু স্বাধীনভাবে শেখার চেষ্টা করতে পারতাম, তা-ই নয়, পাঠ্যপুস্তক ছাড়া পাঠক্রমবহির্ভূত কার্যকলাপ এবং যে ‘আউট বই’কে আজকাল অনেক অভিভাবক মূল্যবান সময়ের অপচয় হিসেবে বাঁকা চোখে দেখেন, সেগুলোয় আমরা অনেক সময় দিতে পারতাম। আমাদের শৈশব-কৈশোরে অন্তত মফস্বল শহরের স্কুলে খেলার মাঠ বলে কিছু একটা বস্তু ছিল, চাইলে আমরা খেলাধুলা করতে পারতাম। আমরা এমন নির্মমভাবে আমাদের শিশুদের বড় করছি যে স্কুল থেকে কোচিং আর কোচিং থেকে স্কুল—এই যেন তাদের জীবন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct