সুব্রত রায়, কলকাতা, আপনজন: সিঙ্গুরকে অতীত করে বাংলায় আবার বিনিয়োগ করছে টাটা গোষ্ঠী। বাড়বে কর্মসংস্থান। সোমবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে রাজ্য সরকারের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে জোরের সঙ্গে ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে সোমবার প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত প্রায় ১১ হাজার জন তরুণ-তরুণীর হাতে চাকরির নিয়োগপত্র তুলে দেন মমতা। রাজ্য সরকারের ‘উৎকর্ষ বাংলা’ প্রকল্পের মাধ্যমে যাঁরা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, তাঁদের হাতে এই নিয়োগপত্র তুলে দেওয়া হয়। সেই কর্মসূচি থেকেই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘টাটারা জলপাইগুড়ির রানিনগরে ইউনিট করছে। ৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে।’’প্রসঙ্গত, সিঙ্গুরে ন্যানো গাড়ি তৈরির কারখানার জন্য জমি নিয়েছিল টাটা সংস্থা। রাজ্যে তৎকালীন বাম সরকারের বিরুদ্ধে কৃষকদের জমি জোর করে অধিগ্রহণের অভিযোগ তুলে ২০০৭ সালে আন্দোলনে নেমেছিলেন মমতা। দীর্ঘ দিন অনশন করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর অনমনীয়তার জন্যই কারখানা নির্মাণ মাঝপথে বন্ধ রেখে সিঙ্গুর ছেড়ে চলে যায় টাটা সংস্থা। গুজরাতের সানন্দে কারখানা গড়ে। যদিও পরবর্তী কালে ন্যানো গাড়ির চাহিদা না থাকায় সেই কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়।এ বার সেই টাটা সংস্থাই ফের রাজ্যে বিনিয়োগ করছে। যদিও সংস্থা এ রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাদের নিয়ে কোনও ছুঁতমার্গ রাখেননি মমতা। বার বার দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থাকে বিনিয়োগের জন্য আবেদন জানিয়েছেন। তাদের মধ্যে ছিল টাটা সংস্থাও। তিনি স্পষ্টই বলেছেন, রাজ্যে শিল্প আনতে তিনি সব রকম পদক্ষেপ করতে তৈরি। সোমবার সেই প্রসঙ্গ ধরেই মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, কৃষির উন্নয়ন তাঁর প্রথম লক্ষ্য হলে শিল্পোন্নয়ন দ্বিতীয় লক্ষ্য। মমতার কথায়, ‘‘৩৪ বছর ধরে এ রাজ্যে শিল্প তছনছ করা হয়েছে। এ বার আমার লক্ষ্য সেই শিল্প।’’মেয়েদের কর্মসংস্থানও যে গুরুত্বপূর্ণ তাঁর কাছে, সে কথাও বলেছেন মমতা। তাঁর কথায়, ‘‘রাজ্যে গত এক বছরে ৪৫ হাজার মেয়ে চাকরি পেয়েছেন। মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছেন দ্রুত। প্রশিক্ষণ এবং অন্য সমস্ত বিভাগের মধ্যে সমন্বয় এনে‘উৎকর্ষ বাংলা’ প্রকল্প করেছিলাম। নামের সঙ্গে কাজ মিলিয়ে বাংলা সত্যিই ‘উৎকর্ষ বাংলা’ হয়ে দেখিয়েছে।’’সোমবার যাঁদের হাতে নিয়োগপত্র তুলে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী তাঁরা কোন জেলার কত জন, সেই পরিসংখ্যানও তুলে ধরেছেন।
ইতিমধ্যে অনেকেই ইমেলে নিয়োগপত্র পেয়ে গিয়েছেন, যাঁরা পাননি, তাঁদের হাতে সোমবারই তুলে দেওয়া হবে। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, নিজেদের জেলায় ফেরার সময় ‘উৎকর্ষ বাংলা’ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত ওই প্রার্থীদের হাতে নিয়োগপত্র তুলে দেবেন নোডাল আধিকারিকরা। এর পর আরও খড়্গপুর, মু্র্শিদাবাদ এবং শিলিগুড়ি— এই তিনটি জেলায় আরও ৩০ হাজার প্রশিক্ষিতের হাতে নিয়োগপত্র তুলে দেওয়া হবে।এর পর মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন কেন প্রশিক্ষণের উপরে জোর দিচ্ছেন তিনি। বলেন, ‘‘স্কিলে জোর দিচ্ছি, কারণ সবই এখন অনলাইনে করতে হয়। খাবার খাবে, তাও অনলাইনে অর্ডার করতে হয়। অনেকে রান্না করে অনলাইনে সরবরাহ করেন। তা করেও প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে।’’ রাজ্যে একে একে কর্মসংস্থানের খতিয়ান তুলে ধরেন। বলেন, ‘‘সেফ ট্যুরিজম চালু করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এক জনকে ঘর, শৌচালয় করে দিচ্ছি। পর্যটক রেখে তাঁরা রোজগার করছেন। বাচ্চাদের স্কুলের পোশাক দর্জি, মেয়েদের বরাত দেওয়া হয়। বছরে প্রায় আড়াই কোটি স্কুলের পোশাক লাগে। এর ফলে কত মানুষের কর্মসংস্থান হয়। তাঁতিদের অর্ডার দিয়েছি পুজো, ইদের জামা। তাঁদেরও কর্মসংস্থান হচ্ছে।’’মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘এই করে গোটা ভারতের মধ্যে বাংলায় ৪০ শতাংশ কর্মসংস্থান বেড়েছে। যেখানে ভারতে ৪৬ শতাংশ কর্মসংস্থান কমেছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রে এক কোটি ৩৬ লক্ষ লোক কাজ করেন। ৯০ লক্ষ শিল্প করেছি, কেউ টের পাননি। চর্মশিল্পে পাঁচ লক্ষ মানুষ কাজ করেন।’’ তার পরেই তিনি কটাক্ষ করেন বিরোধীদের। তুলে আনেন দেওচা পাঁচামি খনি প্রসঙ্গ। তাঁর কথায়, ‘‘কিছু সংবাদমাধ্যম রয়েছে, পার্টি রয়েছে, ভাল জিনিস দেখায় না। যদি দেখাত, অনেক ছেলে অনেক কাজ পেতেন। দেওচা পাঁচামি হচ্ছে। কিছু লোক চান না, রোজ গন্ডগোল করছে। জায়গা দিচ্ছি, চাকরি দিচ্ছি, তার পরেও গন্ডগোল করছেন। ওটা হলে এক লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে।’’ কেন্দ্রকে আরও এক হাত নিয়ে মমতা বলেন, ‘‘যাঁরা দিল্লিতে শাসকদল, তাঁরাই চান না কর্মসংস্থান হোক। উন্নয়ন বলে কিছু নেই।কেন শিল্প বাইরে যাবে। নিজের দেশেই থাকবে। রেল, সেল, কোল বিক্রি হচ্ছে। ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ কে দেখবে?’’ যাঁরা চাকরির জন্য ভিন্রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন, তাঁদেরও বাংলায় থেকে যাওয়ার অনুরোধ করেন মমতা। বলেন, ‘‘এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে যাঁরা বাইরে যাচ্ছেন, যান, কিন্তু বেশি দিন থাকবেন না। চলে আসুন। নিজের বাড়িতে শাক ভাত খাওয়াতেও আনন্দ। দু্র্গাপুজো, ইদ পালন করবেন। আনন্দে থাকবেন। সেটাও দরকার।’’
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct