দেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে রাজনৈতিক দলগুলো নিছকই সংসদীয় রাজনীতিতে অংশ নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। সাধারণত, রাজনৈতিক দলগুলোর বেশিরভাগ নেতা-কর্মী হয় ক্ষমতা ভোগ করেন অথবা ক্ষমতার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন এবং ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করে যান। নির্বাচনী ব্যবস্থায় এই দুটি বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে দলের সব মনোযোগ ও শক্তি নির্বাচনের দিকেই নিবদ্ধ থাকে। এ নিয়ে লিখেছেন যোগেন্দ্র যাদব। আজ শেষ কিস্তি।
অন্যদিকে গণ-আন্দোলনকারী সংগঠন বা ফ্রন্টগুলোর শক্তি আছে, ধারণা আছে, প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আছে। কিন্তু তারা আজকের সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। সম্প্রতি কৃষক আন্দোলনের শক্তি গোটা দেশ প্রত্যক্ষ করেছে। দেশে এরকম আরো বেশ কয়েকটি গণ-আন্দোলনের ধারা সজীব রয়েছে যাদেরও একই রকম শক্তি। কিন্তু এগুলি তাদের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে দিল্লির বুকে একটই জোট কায়েম করতে এখনও অক্ষম। এর মধ্যে রয়েছে সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের আন্দোলন, বেকার যুবকদের আন্দোলন, নারীর ক্ষমতায়নের প্রচার, নমঃশূদ্র-দলিত, আদিবাসী এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর আন্দোলন, বা কণ্ঠরোধ করার মতো ইস্যুতে আন্দোলন। দেশের এমন কোনো অংশ নেই দেশের যেখানে এমন কোনো আন্দোলন নেই যেগুলো মানুষকে রাস্তায় সংঘবদ্ধ করছে না। এইসব জন-আন্দোলন নির্বাচনের থেকে দূরত্ব বজায় রাখে ঠিকই কিন্তু এগুলো তো অরাজনৈতিক নয়। এইসব গণ-আন্দোলনের মতাদর্শ, দেশ ও বিশ্বের প্রশ্নে তাদের অবস্থান এবং ক্ষমতাকে প্রতিরোধ করার শক্তি এগুলিকে গভীর থেকে গভীরতর রাজনৈতিক করে তোলে। কিন্তু এই তৃণমূলস্তরে এসব আন্দোলনের চরিত্র এমন যে তারা একটি ছোট এলাকা বা ছোট একটি অঞ্চলে সংগঠিত হয়, আর সে কারণেই তাই সংসদীয় রাজনীতির প্রশ্নে নির্বাচনী খেলায় এগুলোর কোনো প্রত্যক্ষ প্রভাব থাকে না।দেশের রাজনীতিতে এই দ্বিচারিতা কিন্তু নতুন কিছু নয়। আশির দশক থেকে ভারতীয় রাজনীতির পণ্ডিতরা ‘অদলীয় রাজনীতি’র ধারা চিহ্নিত করতে শুরু করেন। কিন্তু আজ সেই পরিস্থিতি বদলেছে। এখনকার চ্যালেঞ্জ কেবল গণতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্যে অদলীয় রাজনীতির স্বায়ত্তশাসন রক্ষা করা নয়। সামগ্রিকভাবে গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে রক্ষা করাই আজ চ্যালেঞ্জ। এই অবস্থায় সংসদীয় বিরোধী দল ও রাজপথের বিরোধী দল অর্থাৎ গণ-আন্দোলনকারী সংগঠনসমূহের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে সত্যিকারের বিরোধী পক্ষ গঠন আমাদের চ্যালেঞ্জ। আজ আমাদের দেশ এক নজিরবিহীন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশের বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও বুদ্ধিজীবীরা এক বিবৃতিতে এই বিপদের কথা জনসম্মুখে পেশ করেন — “দেশের সাংবিধানিক মূল্যবোধ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করা হচ্ছে। ভারতের নিজস্ব ধর্মবোধ সুপরিকল্পিত আক্রমণের সম্মুখীন হচ্ছে। আমাদের প্রজাতন্ত্রের উপর জঘন্য আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে। এর আগে কখনই ঘৃণা, বিভাজন ও বৈষম্যকে গোটা দেশে ছড়িয়ে দিয়ে দেশের ওপর এতটা নির্মম আঘাত নামিয়ে আনা হয়নি। এর আগে কখনও আমরা এভাবে এতটা গুপ্তচরবৃত্তি, অপপ্রচার ও মিথ্যের সম্মুখীন হইনি। গুটিকয়েক ব্যক্তি শাসক হিসাবে চরম বিশৃঙ্খল এক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করে জনগণকে চরম দুর্দশার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এরকম নির্মম শাসন আমরা আগে কখনও দেখিনি।” আজ আমাদের এমন একটি হাতিয়ার প্রয়োজন যা এই জাতীয় সংকট মোকাবেলা করতে সক্ষম।
প্রতিরোধের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেনি আমাদের দেশ। আমরা স্বাধীন ভারতেও গণতান্ত্রিক প্রতিরোধের কিছু উজ্জ্বল মুহূর্তও দেখছি কয়েক বছর ধরে। কৃষক আন্দোলন ছিল তারই প্রাণবন্ত উদাহরণ। এছাড়াও লাখো মানুষ তাঁদের নাগরিকত্ব অটুট রাখতে এবং সমানাধিকার সুনিশ্চিত করতে রাস্তায় নেমেছেন। বহু রাজনৈতিক নেতৃত্ব, রাজনৈতিক ও সমাজ কর্মী, সাংবাদিক, আইনজীবী, লেখক ও সাধারণ নাগরিক শাসকের হুমকি ও চোখরাঙানিকে পরোয়া করেননি, এমনকি জেলে যেতেও রাজি হয়েছেন এবং ক্ষমতার সামনে সত্য কথা বলার সাহস দেখিয়েছেন। আজ গণ-অভ্যুত্থানের এই শক্তিকে সেইসব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে যারা আমাদের সাংবিধানিক গণতন্ত্র রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ। সেজন্য আমি কৃষক আন্দোলনের পাশাপাশি অন্যান্য গণ-আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। আমি আমার দল ‘স্বরাজ ইন্ডিয়া’-র পাশাপাশি অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সমন্বয় তৈরির চেষ্টা করছি। সেই কারণেই আমি সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার দায়িত্ব থেকে আমাকে অব্যাহতি দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। কিন্তু এই লক্ষ্য একক ব্যক্তির দ্বারা অর্জন করা সম্ভব নয়। হাজার হাজার মানুষ যেভাবে পাগলের মতো দেশকে স্বাধীন করতে ঘরবাড়ি ছেড়েছিলেন, ঠিক সেভাবেই আজ দেশের এই দ্বিতীয় স্বাধীনতার লড়াইয়ে হাজারও ‘আন্দোলনজীবী’র কাছে এই লক্ষ্যে পৌঁছনোটাই বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ, আর এটাকেই জীবনের লক্ষ্য বানাতে হবে। (সমাপ্ত...)
লেখক ‘স্বরাজ ইন্ডিয়া’র প্রতিষ্ঠাতা।
অনুবাদ: অতনু সিংহ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct