জিলাপির জন্ম-জটিলতা
ফৈয়াজ আহমেদ
ভোজনরসিক মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সামনে একবার এক মিষ্টি রসবিশিষ্ট, গোলাকৃতি, চক্রাকার প্যাঁচবিশিষ্ট খাবার হাজির করা হয়। সেই মিষ্টি খেয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীর এতটাই বিমোহিত হয়ে যান যে, সেটির সাথে নিজের নাম জুড়ে দেন তিনি। মিষ্টিটির নাম হয় ‘জাহাঙ্গিরা’, আর সগর্বে সেটির সংযুক্তি ঘটে মুঘল বাদশাহদের খাদ্যতালিকায়। রাজকীয় এই মিষ্টিটিকে অবশ্য আমরা অন্য একটি নামে চিনি। তা হলো- জিলাপি। জিলাপির উদ্ভব যে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ই ঘটেছে, তা কিন্তু বলতে চাইছি না । কেননা, ‘অক্সফোর্ড কম্প্যানিয়ন টু ফুড’ বইয়ে দাবি করা হয়েছে, জিলাপির সবচেয়ে পুরনো লিখিত বর্ণনা নাকি পাওয়া যায় মুহম্মদ বিন হাসান আল বাগদাদীর লিখিত ত্রয়োদশ শতাব্দীর রান্নার বইতে। তবে পৃথিবীর বুকে জিলাপির অস্তিত্ব এর অনেক আগে থেকে মানব সভ্যতায় বিদ্যমান থাকাও অসম্ভব কিছু নয়। মধ্যপ্রাচ্যের খাদ্য বিষয়ক গবেষক ক্লডিয়া রডেনের দাবি, ত্রয়োদশ শতাব্দীর পূর্বেই মিশরের ইহুদিরা হানুক্কাহ পালনের জন্য তৈরি করত ‘জালাবিয়া’, যেটি কার্যত জিলাপিরই প্রাচীন রূপ বলে ধরা হয়। রমজান মাসের সাথেও জিলাপির যোগসূত্র অনেক আগে থেকেই। ইরানে ঐতিহ্যগতভাবেই ‘জুলবিয়া’ নামক মিষ্টি বিশেষ উপলক্ষ কিংবা রমজান মাসে তৈরি করে দরিদ্র-ভিক্ষুকদের মাঝে বিতরণ করা হত এমন প্রমান মেলে। এদিকে লেবাননে ‘জেলাবিয়া’ নামের একটি প্যাস্ট্রি পাওয়া যায়, যদিও সেটি বৃত্তাকার নয়, বরং আঙুলসদৃশ। তুরস্ক, গ্রিস, সাইপ্রাসেও জিলাপির আলাদা আলাদা সংস্করণ দেখতে পাওয়া যায়। তাই আমরা এটি ধারনা করতে পারি যে, জিলাপির উৎপত্তি মূলত পশ্চিম এশিয়ায়, এবং সেখান থেকেই মুসলিম বণিকদের হাত ধরে এটি ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করেছে। ভারতীয়দের খাদ্যাভ্যাসে তুর্কি, ফারসি, আরব ও মধ্য এশীয় প্রভাবের কথা কারো অজানা নয়। তাই এটিও মোটেই আশ্চর্যজনক বিষয় নয় যে বর্তমানে বাংলাদেশ কিংবা পশ্চিমবঙ্গ, দুই বাংলার সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় মিষ্টিটিরও আগমন ঠিক একইভাবে।
ঐতিহাসিক অ্যাংলো-ভারতীয় শব্দকোষ ‘হবসন-জবসন’-ও এ ধারণাকে আরো পাকাপোক্ত করে। সেখানে বলা হয়েছে, ভারতীয় শব্দ ‘জালেবি’ এসেছে আরবি শব্দ ‘জুলেবিয়া’ এবং ফারসি শব্দ ‘জুলবিয়া’ থেকে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ‘জালেবি’ শব্দ থেকেই পরবর্তী সময়ে ‘জিলাপি’ শব্দটি এসেছে। কিন্তু যে প্রশ্নটি সবথেকে বড়, সেটি হলো, ঠিক কবে নাগাদ জিলাপি দক্ষিণ এশিয়ায় এসে পৌঁছায়, এবং এতটা জনপ্রিয়তা লাভ করে? এ রহস্য উন্মোচনের কিছু সূত্র পাওয়া যায় ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ পরশুরাম কৃষ্ণ গোড়ের ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত ‘দ্য নিউ ইন্ডিয়ান অ্যান্টিকুয়ারি’ জার্নাল থেকে। সেখানে গোড়ে দাবি করেন, তিনি ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘গুণ্যগুণবোধিনী’ পুঁথিতে জিলাপির উল্লেখ পেয়েছেন। পয়ার ছন্দে লেখা সেই পুঁথিতে জিলাপি বানানোর জন্য কী লাগে আর কীভাবে বানাতে হয়, দুয়েরই বর্ণনা পাওয়া গিয়েছিল, যার সকল উপকরণ ও প্রক্রিয়ার সাথে বর্তমান সময়ের জিলাপির সাদৃশ্য বিদ্যমান। গোড়ে তার জার্নালে আরো যে চমকপ্রদ তথ্য জানিয়েছেন, তা হলো, ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে জৈন সাধু জিনসূর রচিত ‘প্রিয়ংকর-রূপকথা’ গ্রন্থে ধনী বণিকদের নিয়ে আয়োজিত একটি নৈশভোজের বর্ণনায় জিলাপির উল্লেখ ছিল। তখনকার দিনের ভারতে জিলাপি পরিচিত ছিল ‘কুণ্ডলিকা’ বা ‘জলবল্লিকা’ নামে। এরপর ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে রানী দীপাবাঈ-এর সভাকবি রঘুনাথ দক্ষিণ ভারতের খাবার নিয়ে ‘ভোজন কুতূহল’ নামক রন্ধন বিষয়ক যে ধ্রুপদী গ্রন্থ রচনা করেন, সেখানেও তিনি জিলাপি তৈরির পদ্ধতি উল্লেখ করেন।
সুতরাং আমরা একদম নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি যে, ভারতীয় উপমহাদেশে জিলাপির বয়স কম করে হলেও ৫০০ বছর তো হবেই। সম্ভবত মধ্যযুগে ফারসিভাষী তুর্কিরা ভারত আক্রমণ করার পরই কোনো একটা সময়ে জিলাপি চলে আসে এ অঞ্চলে। এবং বর্তমানে এখানেও, ঠিক পশ্চিম এশিয়ার মতোই, জিলাপির হরেক নাম রয়েছে। যেমন: জালেবি, জিলবি, জিলিপি, জিলেপি, জেলাপি, জেলাপির পাক, ইমরতি, জাহাঙ্গিরা ইত্যাদি। পশ্চিম এশিয়ায় উদ্ভূত আদি জিলাপির সাথে ভারতীয় উপমহাদেশের জিলাপির কিছু বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্যও কিন্তু রয়েছে। পশ্চিম এশিয়ার জালাবিয়াতে ময়দা, দুধ, দই দিয়ে একটু অন্যভাবে ফেটানো হতো। তার সাথে দেয়া হতো মধু ও গোলাপজলের সিরাপ। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে এসেই প্রথম জিলাপি হয়ে উঠেছে মুচমুচে, রঙিন এবং আঠালো। আবার বাংলাদেশেও জিলাপির কিছু নিজস্বতা গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো পুরান ঢাকার চকবাজারে উৎপন্ন জিলাপির এক ঐতিহ্যবাহী সংস্করণ, যার পরিচিতি ‘শাহী জিলাপি’ হিসেবে। কয়েক ইঞ্চি ব্যাস এবং এক, দেড়, দুই কিংবা আড়াই কেজি পর্যন্ত ওজনের এই বিশেষ জিলাপি ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেটসহ গোটা বাংলাদেশেই দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ‘শাহী’ শব্দটি দ্বারা রাজকীয় দ্রব্যাদি বোঝায়। ঢাকার নবাবদের শাহী রান্নাঘর থেকে এ জিলাপির সৃষ্টি। নবাবরা এটি তাদের পারিবারিক অনুষ্ঠানে খেতেন এবং এখান থেকেই এ জিলাপির ধারণা এসেছে। কয়েক দশক আগে পুরান ঢাকায় এটির বাণিজ্যিক প্রচলন শুরু হয়। এখন বিয়ে কিংবা অন্যান্য পারিবারিক অনুষ্ঠানে রসনাবিলাসের অন্যতম প্রধান উপকরণ বিশালাকার ও সুস্বাদু এই জিলাপি। আর রমজান মাসের ইফতার হিসেবেও ক্রেতাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু এটি। জিলাপি বর্তমানে বাংলার গণমানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। কূটবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মনকে যেমন এখানে জিলাপির প্যাঁচের রূপকে তুলে ধরা হয়, তেমনই হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধানে জিলাপির তুলনা দেয়া হয়েছে নারীর মোহনীয় খোঁপার সঙ্গেও। জিলাপি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, মান-অভিমানও নেহাত কম হয় না এদেশে। মোটা জিলাপি নাকি সরু লিকলিকে জিলাপি বেশি ভালো খেতে, এ নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হতেই পারে খাদ্য রসিকদের মধ্যে। তবে জিলাপি নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি যতই হোক, যতই চারিদিকে নিত্যনতুন মিষ্টান্ন বা ডেজার্টের আগমন ঘটুক, তবু জিলাপির আবেদন হয়তো কোনোদিনই কমবে না। কারণ এখনো মেলায় গেলে, কিংবা রাস্তার পাশে গরম গরম জিলাপি দেখলে জিভে জল চলে আসে, জিলাপিতে একেকটি কামড় দেয়ামাত্র স্নায়ুকোষগুলোতে বিশেষ ভালোলাগার উপলব্ধি ছড়িয়ে পড়ে। জিলাপি আমাদের স্মৃতিমেদুরতাকেও উসকে দেয়, মনে পড়িয়ে দেয় ছোটবেলায় জিলাপি খেতে গিয়ে রসে মাখামাখি হওয়া কিংবা গ্রামের মেলাতে প্রতিবছর জিলাপি খাওয়ার দিনগুলি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct