মালয়েশিয়ায় হঠাৎ করেই নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. নাজিব রাজাককে দুর্নীতির মামলায় জেলে পাঠানোর পর শাসক দল আমনুর পক্ষ থেকে তীব্র চাপ সৃষ্টি হয়েছে দ্রুত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য। তা না হলে আমনুর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুবকে বরখাস্ত করার হুমকিও দেয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিরোধী পাকাতান হারাপান জোটের প্রধান আনোয়ার ইব্রাহিম নির্বাচনে যেতে প্রস্তুত বলে ঘোষণা করেছেন। এ নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ শেষ কিস্তি।
এর মধ্যে হঠাৎ করেই পরিস্থিতি উল্টো দিকে মোড় নিতে শুরু করেছে। আমনুর কেন্দ্রীয় কমিটি ও বিভাগীয় প্রধানদের বিশেষ সভায় দলের প্রেসিডেন্ট আহমদ জাহিদ আবারও সংসদ ভেঙে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে সাধারণ নির্বাচনের পথ সুগম হয়। জাহিদ বলেছেন যে বর্তমান বাস্তবতা একটি অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ইসমাইল সাবরিকে ক্ষমতা ধরে রাখতে বিরোধীদের সাথে একটি চুক্তির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে বলে দেশের অর্থনীতিকে ক্রমবর্ধমান অনিশ্চিত অবস্থায় পড়েছে। এর মধ্যে অবশ্য অনেক খেলা চলছে। ডা: মাহাথির মোহাম্মদ চাইছেন ইউনাইটেড আমনু তৈরি করে আবার সেই দলে ফিরে আসতে অন্যদের নিয়ে। মহিউদ্দিন ইয়াসিনও একই ভাবনার মধ্যে রয়েছেন। এ ব্যাপারে কোনো সমঝোতা হলে মহিউদ্দিনের প্রাপ্তি হয়তো তেমন কিছু থাকবে না। তবে মাহাথির পুত্র মুখরিজ মাহাথির নবগঠিত দলে গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে পারেন। তবে আমনুর নতুন নেতারা পুরনোদের ফিরিয়ে এনে ঝামেলা সৃষ্টি করতে চান না। ফলে এ প্রয়াস কতদূর সামনে এগোবে বলা মুশকিল। অন্য দিকে নাজিবের অনুগতরা আবারো সংগঠিত হতে শুরু করেছেন। জায়েদ হামিদী বলেছেন, নাজিবের অন্যান্য মামলায় দল তার পক্ষে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী ও তার অনুগতদের জন্য এই চাপ ক্রমেই বাড়তে পারে। এ ছাড়া সরকারের অন্যতম শরিক পাস প্রধান আবদুল হাদি আওয়াং ও তার দলের সদস্যরা চলমান সব দুর্নীতির মামলা শেষ করে তারপর নির্বাচন দেবার দাবি জানাচ্ছেন।
আনোয়ারের ভাগ্য কোন পথে
মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে এক ভাগ্যবিড়ম্বিত ব্যক্তি হলেন আনোয়ার ইব্রাহিম। মাহাথির প্রধানমন্ত্রী থাকাকালেই উপপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে তাকে কক্ষপথ থেকে অতলগহ্বরে ফেলে দেন মাহাথির। এরপর জেল জুলুম পার হয়ে এক দীর্ঘ সময় পাড়ি দিতে হয় তাকে। নিজে জেলে থেকে স্ত্রীকে দিয়ে নতুন দল সংগঠিত করে সেই দলকে দেশের অন্যতম বৃহৎ দলে পরিণত করেন। শেষ পর্যন্ত তার জোট বিগত নির্বাচনে জয়ও পায়। কিন্তু ডা: মাহাথির আবারো তার প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করেন। দ্বিতীয় দফা ওয়াদা খেলাপের পরও মাহাথির আরো একবার আনোয়ারের সমর্র্থন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আনোয়ার আর তাকে বিশ্বাস করতে পারেননি। এখনকার মালয়েশিয়ার বিরোধী দলের নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হবার ক্ষেত্রে হ্যাটট্রিক করেছেন। সরকার আকস্মিকভাবে নতুন নির্বাচন ঘোষণা দিলেও তিনি কতটা ভালো করবেন তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। আনোয়ার ইব্রাহিম তার দেশে অত্যন্ত দূরদর্শী রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত। অনেকে এমনও মনে করেন তিনি রাষ্ট্রের নেতৃত্ব পেলে দেশকে অনেকদূর এগিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু তিনি সংখ্যাগুরু মালয়দের একটি বড় অংশের আস্থা অর্জন করতে পারছেন না। বিশেষ করে মালয় প্রধান ডিপ স্টেটের সদস্যরা তাকে সমর্থন করছেন না।
মালয়েশিয়া একটি বহু জাতিগোষ্ঠীর দেশ। দেশটির অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ ২৭ ভাগ চায়নিজ জাতিগোষ্ঠীর হাতেই রয়েছে মূলত। ৬০ ভাগ মালয় দেশটি রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। দেশটির সব সুলতানই হলেন মালে। দেশটি নিরাপত্তাবাহিনীর সব অংশই মালয় নিয়ন্ত্রিত। মালয়েশিয়ার ডিপ স্টেট বা গভীর ক্ষমতা বলয়ের প্রায় সবাই মালে। ৩৮ সদস্যের যে নিরাপত্তা পরিষদ রয়েছে তারাই মূলত নির্ধারণ করেন কারা সরকার গঠন করবে। তাদের গরিষ্ঠ অংশ মনে করে আনোয়ার ইব্রাহিম সরকার গঠন করলে চীনা জাতিগোষ্ঠীর প্রভাব বাড়বে। পাকাতান হারাপান জোট ২০১৮ সালে যখন সরকার গঠন করে তখন চীনা ও ভারতীয় জাতিগোষ্ঠীর সবচেয়ে বেশি সদস্য মন্ত্রিত্ব লাভ করেন। ডিএপি নেতা লিম গুয়াং য়েং হন অর্থমন্ত্রী। মহিউদ্দিন ইয়াসিন যখন অভ্যুত্থান করেন তখন এই যুক্তিটিই প্রধান ছিল যে, আনোয়ার প্রধানমন্ত্রী হলে চীনা প্রভাব আরো বাড়বে। এই জাতিবাদী ভাবধারাকে উসকে দিতে ভূমিকা রাখেন তিন ব্যক্তি। তাদের একজন হলেন ডা: মাহাথির মোহাম্মদ, অন্যজন আনোয়ারের দলেরই এক সময়কার দ্বিতীয় শক্তিধর নেতা আজমিন আলী আর তৃতীয় জন হলেন ইসলামী দল পাস প্রধান আব্দুল হাদি আওয়াং। পরবর্তী সময়ে প্রাসাদ রাজনীতিতে মাহাথির ছিটকে পড়লেও বাকি দু’জনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থেকে যায়। কিছুকাল ধরে অবশ্য আজমিন আলী নতুন কোনো প্রকল্পের জন্য চুপচাপ রয়েছেন বলে মনে করা হয়। তার ঘনিষ্ঠ আরেক নেত্রী জুরাইদা তার সাথে মতবিরোধ করে একটি ছোট দলে যোগ দিয়েছেন। নতুন যে রাজনৈতিক মেরুকরণ হতে চলেছে তার পুরো রূপ এখনো স্পষ্ট হয়নি। তবে নির্বাচনের আগে বড় ধরনের মেরুকরণ ঘটতে পারে। এই মেরুকরণে আনোয়ার কোনো ম্যাজিক দেখাতে না পারলে তিনি কতটা সফল হবেন তাতে সংশয় রয়েছে। মাহাথির আজমিন চীনা প্রধান ডিএপির সাথে যোগাযোগ বজায় রেখেছেন। আমনুর বিক্ষুব্ধ অংশ মাহাথির, বারসাতু আর ডিএপি মিলে নতুন কোনো জোট হলে নির্বাচনে একটি ভিন্ন চেহারা আসতে পারে। (সমাপ্ত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct