পণ্ডিতমশাই
শংকর সাহা
সেদিন অফিস থেকে ফিরে চিঠিটি লিখতে গিয়ে হঠাত অর্নিবাণের মনে পড়ে তার স্কুল জীবনের কথা । সেই স্কুল,টিফিনের সময় দাঁড়িয়ে বরফ খাওয়া,মাস্টার মশাইকে দেখতে পেলেই ভয়ে তা লুকিয়ে রাখা আরও কতশত স্মৃতি। আজ অর্নিবাণ চিঠি লিখছে তারই স্কুলের অঙ্কের মাস্টার মশাই ভবতোষ বাবুকে নিয়ে। বড় উদার মনের মানুষ ছিলেন ভবতোষ বাবু। জীবনে কত ছাত্রই না তিনি পড়িয়েছেন। তাদের মানুষ করেছেন। যেন গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করা। কতো জটিল অঙ্ক অনায়াসে তিনি করে দিতেন।যখন ব্ল্যাকবোর্ডে তিনি অঙ্ক করতেন তখন মনে হতো পৃথিবীর সব অঙ্কই যেন তিনি নিজেই আবিষ্কার করেছেন। মনে পড়ে সেদিন স্কুলে তিনি অঙ্ক পরীক্ষা নেবেন। ব্ল্যাকবোর্ডে কোয়েশ্চেন লিখবার আগে তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, “মন দিয়ে শোনো ছাত্রেরা, আজ পরীক্ষায় অঙ্কেতে ভালো নম্বর না পেলে তাকে বাইরে গিয়ে একশো বার কানধরে থাকতে হবে” কথাটি শোনার পরে সকলের বুকে একটু একটু ভয়ে হতে থাকে।
পরীক্ষা শেষের পরেরদিন ছিল খাতা দেবার পালা। সকলের বুক ধড়ফড় করছে । এমন সময় পাশ থেকে সুমন বলে ওঠে, “ জানিস অর্নিবাণ, স্যর খুব রেগে আছেন। “ সুমনের কথা শুনে আরও ভয় কাজ করে অর্নিবাণের মধ্যে। হঠাত চেয়ারে বসে ভবতোষ বাবু অর্নিবাণকে ডাকলেন। খাতা দিতেই দেখা গেল সে কম নাম্বার পেয়েছে। শিক্ষকমহাশয় তাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। তখন লজ্জায় তার মাথা হেঁট। ক্লাশ শেষে সবাই বেরিয়ে গেলে ভবতোষবাবু তাকে ডাকলেন, “ দেখো অর্নিবাণ লেখাপড়াটা ভালো করে কোরো। জীবনে অঙ্ক কোনোদিন কঠিন হয়না। ভালো করে করলে তা সহজই লাগে। আসলে জেনে রেখো আমাদের জীবনটাই একটা অঙ্ক। যেন দুই আর দুই মিলে চার হয় কখনো তা ছয় হয়না।“ শিক্ষকের সেই দার্শনিক সুলভ কথা সেদিন অর্নিবাণ বুঝতে পারেনি।সময়ের কালক্রমে আজ অর্নিবাণ প্রতিষ্ঠিত একজন গেজেটেড অফিসার। কর্মময় জীবনে এসে কোনোদিন অন্যায়ের সাথে অপোষ করেনি অর্নিবাণ। কর্তব্যকর্মে দায়িত্বশীলতার জন্যে অফিসের অন্যান্য সহকর্মীরা তাকে হিংসে করতে থাকে। তার বিরূদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ আসে। উপর থেকে অর্নিবাণের দূরে ট্রান্সফারের অর্ডার আসে। আজ অর্নিবাণ কিছুটা বিধ্বস্ত। আজ বড়ই মনে পড়ছে সেই অঙ্কের মাস্টার মশাইয়ের কথা। মাস্টার মশাইকে চিঠিটি লিখতে লিখতে হঠাতদূর কোণে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। চোখটি অশ্রূসজল.!
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct