আরোগ্য নিকেতনের খোঁজে
অশোক কুমার হালদার
সুবীর বাবু একজন কেন্দ্রীয় সরকারের সরকারী কর্মচারী। তিনি রেলওয়েতে আধিকারীক পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন শুরু থেকেই। সরকারী নিয়ম অনুযায়ী এক স্থানে দীর্ঘ দিন চাকুরীরত অবস্থায় অবস্থান করতে পারেন না, তাই চাকুরির ঠিকানা ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু ভারত সরকারের ভারতীয় রেলওয়ে বিভাগের একজন উর্দ্ধস্থান কর্মচারী ছিলেন সুবীর বাবু। দুই থেকে পাঁচ বছর অন্তর অন্তর চাকুরীর ক্ষেত্রের স্থান বদল হয়। জরুরী দিক থেকে বিশেষ লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য এই যে, ভারতীয় সেনা বিভাগের গুরুত্ব, নিয়ম অনুবর্তিতা এবং আদর্শগত সেবা দেশ এবং জাতীর উদ্দেশ্য সর্বদায় সজাগ এবং তৈরি থাকতে হয় ঠিক যেন সজাগ করিবার ঘড়ির মতো। সর্বদায় ডাকলে হাজির এই রকম প্রস্তুতি থাকে সেনা বাহিনীরদের মধ্যে। সাধারণ সেনা থেকে শুরু করে সমস্ত আধিকারীকগণ এবং এমনকী রোগ নিরাময় বিভাগে যারা যুক্ত রয়েছেন, তার সর্বদায় সেবায় নিয়োজিত এবং প্রস্তুত থাকেন এমনভাবে যে মুহুর্তেই ডাকা হোক না কেন, একজন সাধারণ সেনাকর্মী থেকে শুরু করে সকল শ্রেণীর আধিকারীক পর্যন্ত সর্বদা প্রস্তুত হয়ে থাকেন দেশের সেবা ও জাতীর সেবার জন্য। সুবীর বাবু যখন প্রথম রেলওয়ে চাকুরীতে যোগদান করেন সেদিন থেকে এই শিক্ষা পেয়েছেন এবং আরো জেনেছেন যে ভারতীয় রেলওয়েতে কর্মচারীদের দায়িত্ব এবং জাতীর উদ্দেশ্যে নিয়োজিত সকল কর্মচারীদের সর্বদা জাতীর সেবা কার্যে নিয়োজিত থাকতে হবে এবং সদা সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ আইন শৃঙ্খলা কর্ম তৎপরতা সাবধানতা, যাত্রী সুরক্ষা এবং সময় অনুবর্তিতা যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখাশোনা করতে হবে। সেনা বাহিনীর যেমন গুরুত্ব রয়েছে যেমন দেশমাতৃকার সেবা কার্যে প্রথম স্থান, তেমনি ভারতীয় রেলওয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে জাতীর সেবা কার্যে নিযুক্ত। ইহাতে কোন সন্দেহ নেই। সুবীর বাবু তার সহকর্মী বন্ধু অচিন্ত বাবুকে এই কথাগুলি বলছেন অফিসের ঘরে বসে। অচিন্ত সেন খড়গপুরে ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার। রেলওয়েতে যে সমস্ত কর্মচারী প্রথমে আধিকারিক পদে নিযুক্ত হন, তাদের খড়গপুরে শিক্ষনবিশ হিসাবে শিক্ষা নিতে হয়, শিক্ষার শেষে রেলওয়ের প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন ডিভিশনে পাঠিয়ে দেন আধিকারীক হিসাবে কর্ম সম্পাদন করার জন্য। অচিন্ত বাবু বলছেন ভাই সুবীর আমাদের রেলওয়ে কর্ম পদ্ধতি খুব দায়িত্বপূর্ণ এবং সমষ্টিবাচক কাজ। একে অন্যের পরিপূরক।অচিন্তের এই কথা শুনে সুবীর বাবু বলছেন যে একটা গাড়ি প্রস্তুত করতে সকল শ্রেণীর কর্মচারীর সহায়তার প্রয়োজন হয়, তারপর গাড়িটি মাল পরিবহন বা যাত্রী পরিবহনের জন্য প্রস্তুত হয়। তারপর সেই গাড়ি চালনোর জন্য চালকের প্রয়োজন হয় এবং গার্ডেরও প্রয়োজন এযেন একজন শল্য চিকিৎসকের জরুরী বিভাগে রোগী অপারেশনের জন্য সমবেত সহায়কদের সাহায্য নেওয়ার মতো এক অবস্থা মাত্র। এই কথা শোনার পর অচিন্ত বাবু বলছেন যে আমাদের এক চালক সুবল দাস তার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ে রয়েছেন, তাই সুবল ছুটির আবেদন করেছেন স্ত্রী চিকিৎসার জন্য দক্ষিণ ভারতে যাবেন আরোগ্য নিকেতনের খোঁজে।
যাতে করে স্ত্রীর সুচিকিৎসা করা যায় এবং সুবলের স্ত্রী আরোগ্য লাভ করেন। বর্তমানকালে দেখা যাচ্ছে যে উত্তর ভারত এবং পূর্ণ ভারতে থেকে বহু যাত্রী রেলওয়ে ট্রেনে করে দক্ষিণ ভারতের দিকে চলেছেন আরোগ্য লাভের খোঁজে। সুবীর বাবু এবার অচিন্ত বাবুকে বলেছেন ভাই অচিন্ত তুমি কী একবার চালক সুবলের কাছে থেকে খোঁজ নিয়ে জেনেছ যে তার স্ত্রীকে কেন রেলওয়ে চিকিৎসা কেন্দ্রে বিনা খরচে চিকিৎসা করাচ্ছেন না কেন? অচিন্ত এবার এই কথা শুনে, সুবীরকে বলছেন ভাই আমি খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছি চালক সুবলের কাছে থেকে যে আপনার স্ত্রীকে আমাদের রেলওয়ে চিকিৎসা কেন্দ্রে থেকে কেন চিকিৎসা করাচ্ছেন না? চালক সুবল বলেছেন স্যার, রেলওয়ে চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে চিকিৎসা করিয়ে রোগীর কোন উন্নতি হয় না। বরং রোগী দিনের পরদিন আরো খারাপ দিকে চলে যাচ্ছে। রেলওয়ে চিকিৎসকের চিকিৎসায় রোগীর কোন উন্নতি হয়নি, ধীরে ধীরে অবনতির দিকে রোগী এগিয়ে চলেছে। তবে হ্যাঁ রেলওয়ে চিকিৎসকগণ বলেছেন যে রোগী কোন দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন তাই রোগীকে দক্ষিণ ভারতে ভালো চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে উপদেশ দিয়েছেন। আরও চিকিৎসকগণ বলেছেন যে রোগী কর্কট রোগের হয়তো শিকার হয়েছেন। তাই চালক সুবল বলেছেন যে দক্ষিণ ভারতে গিয়ে ভালো আরোগ্য নিকেতনের খোঁজ করে দেখবো। রোগীর চিকিৎসার ভালো আরোগ্য কেন্দ্র খোঁজ পেলে সেখানে রোগীর চিকিৎসা করার জন্য স্যার। সুবল আরো বলেছেন যে স্যার যখন চালক হিসাবে আমি রেলগাড়ি চালনার দায়িত্ব নিয়ে যখন শত, শত যাত্রী নিয়ে নিয়ে ট্রেন চালাই তখন আমার দায়িত্ব থাকে যে সব যাত্রীগণ রেলগাড়িতে রয়েছেন, তাদের নির্দিষ্ট গনত্ব্যস্থলে সুরক্ষিত ভাবে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব একজন চালকের উপরে থাকে। তেমনি আবার কর্মের অবসানে ঘরে ফেরার পড়ে, ঘর পরিবারের দায়িত্ব ও দেখতে একজন গৃহীর মতো। কারণ ঘর ও পুত্র কন্যার দায়িত্ব যেমন স্ত্রীকে দেখতে হয়। আর অন্যদিকে স্বামীর দায়িত্ব রয়েছে স্ত্রী, পুত্র কন্যা এবং পিতা ও মাতাকে সেবা করা। ইহা সামাজিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব কোন ভাবেই অস্বীকার করা যায় না। তাই স্ত্রীর যদি রোগে আক্রান্ত হয়, সেই ক্ষেত্রে স্বামীর দায়িত্ব অনেক গুণে বেড়ে যায়। আর রোগ কখন কার হবে, সেটা কেউ বলতে পারে না। যে রোগই হোক সাধারণ রোগ বা দুরারোগ্য রোগ সব ক্ষেত্রেই রোগীকে চিকিৎসা করাতে হবে। চিকিৎসা ছাড়া আরোগ্য হওয়া বা পাওয়া সম্ভবপর নয়। শরীর থাকলে রোগ, ব্যাধি আসা অস্বাভাবিক নয়। চালক সুবল অফিসে এসে বড় বাবুকে বলছেন যে আমি আমার সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চাই, সাহেবের চেম্বারে। আপনি আমাকে অনুমতি দেন দেখা করার। বড়বাবু চালক সুবলকে বলছেন কীরণে দেখা করবেন? সুবল বলছেন ছুটির ব্যপারে সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে হবে? বড়বাবু তখন অফিসের পিত্তন অধীরকে ডেকে বলছেন, অধীর এদিকে এসো। অধীর বলছেন বলুন স্যার। তুমি এই চিরকুট নিয়ে সাহেবের টেবিলে দিয়ে এসো আর সাহেবকে মুখে বলবে যে চালক সুবল আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই জরুরী কাজের জন্য। তবে হ্যাঁ রেলের অফিসে এখন নিয়ম রয়েছে কর্মচারী সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হয়। ইচ্ছা করলেও কর্মচারী সাহেবের বিনা অনুমতিতে সাহেবের সঙ্গে দেখা বা সাক্ষাৎ করা যায় না। এই দেখা করার জন্য বড়বাবু সাহেবের অনুমতির ব্যবস্থা করে দেন। এই নিয়ম সকল কর্মচারীর জন্যই রয়েছে। কিছুক্ষণ পরে বড় সাহেবের ঘর থেকে বেরিয়ে বড় বাবুর কাছে এসো বলছিল। একটু বসতে হবে, তবেই দেখা পাওয়া যাবে সাহেবের সঙ্গে। পিত্তন অধীরের কথা শুনে চালক সুবল আধিকারীকের সঙ্গে দেখা করার জন্য বসে রয়েছেন। কিছুক্ষণ বাদে সাহেবের ঘরে বেল বাজিয়ে সাহেব পিত্তন অধীরকে ডাকলেন। সেই মত অধীর সাহেরের ঘরে ঢুকে বেড়িয়ে চালক সুবলকে বললেন আপনি যান ঘরে সাহেবের সঙ্গে দেখা করুন।
সাহেবের ঘরে ঢোকার পরে চালক সুবল বাবু সাহেবকে প্রণাম করলেন? সাহেব তখন বললেন সুবলকে বসুন। সুবল এইবার সাহেবকে বললেন যে স্যার আমি একমাস আগে একখানি দরখাস্ত দিয়েছি আমাদের শেডের বড় বাবুকে উনি বলেছেন তোমার ছুটির দরখাস্ত আমি অফিসের পিত্তনের মাধ্যমে বড় সাহেবের কাছে পৌঁচ্ছে দেব। তুমি সেই অনুযায়ী অফিসে গিয়ে বড় সাহেবের সঙ্গে দেখা করে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলে নিয়ো ছুটির ব্যাপারে। কারণ তোমার ছুটি একমাত্র বড় সাহেব মঞ্জুর করতে পারেন। আর আজ আমি সেই কারণেই অনুমতি নিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য এসেছি স্যার। বড় সাহেব চালক সুবল বাবুকে বলছেন যে তোমার ছুটির ব্যপারে তোমার পাঠানো দরখাস্ত আমি পেয়েছি এবং জেনেছি যে তোমার স্ত্রী অসুস্থ রয়েছেন, তুমি রেলওয়ের চিকিৎসকদের পরামর্শ মতো এবং রোগীর আরোগ্যের জন্য রেলওয়ের বাহিরে গিয়ে চিকিৎসা করাতে চাও এই তো? হ্যাঁ স্যার রেলওয়ে চিকিৎসালয়ে রোগী চিকিৎসা করিয়ে রোগীর রোগের কোন উপশম পাওয়া যায়নি। রোগী এখন খাওয়াদাওয়া সে রকম খেতে পারছে না। খাওয়াদাওয়া এক রকম বন্ধ প্রায়। আর ডাক্তারবাবুদের দেওয়া ওষুধ খেয়েও কোন রকম প্রতিকার রোগী পাচ্ছে না। প্রাসঙ্গিক কারণেই আমি স্থির করেছি যে রোগীর ভালো চিকিৎসার জন্য দক্ষিণ ভারতে কোন আরোগ্য নিকেতনে নিয়ে গিয়ে ভালোভাবে চিকিৎসা করাব ভাবছি। তাই স্যার এই ছুটির আবেদন করেছি যাতে আমি ছুটি পাই এবং স্ত্রীর সুচিকিৎসা করাতে পারি। স্বামী হিসাবে ইহা একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা, যেটা কখনই উপেক্ষা করা যায় না। আর হ্যাঁ স্যার একজন চালক হিসাবে বেশিরভাগ সময়ই বাহিরে থাকতে হয়। স্যার আপনি শুধু আমার বড় সাহেব নয়, আপনি এই রেলওয়ের চালক পরিবারের একজন প্রধান আধিকারীক এবং অন্নদাতাও বটে, ঠিক যেন পিতার মতো। পিতা যেমন তার পরিবারের পুত্র, কন্যাদের দেখভাল করেন, সুখে দুঃখে সমব্যর্থী দুঃখ ভাগ করে নেন, ঠিক তেমনি স্যার আপনি আমার এবং আমার পরিবারের অন্যদাতা পরিবারের দুঃখের দিনে আপনি পিতার মতো নিয়মের ধারা বজায় রাখবেন এই আশা আমরা আপনার কাছে রাখতে পারি মানবতার খাতিরে। এই কথা শুনে বড় সাহেব চালক সুবলকে বললেন যে আপনার কাছে চিকিৎসা করানোর প্রয়োজনীয় টাকা পয়সা আধিকারীদের ফান্ড থেকে আপনার স্ত্রীর চিকিৎসা খরচের জন্য টাকা নিয়ে যাবেন। বড় সাহেবের মুখে থেকে এই কথা শুনে চালক সুবলের চোখে জল আসার মতো এক অবস্থা। এই অবস্থায় সুবলকে দেখে বড় সাহের আরো বললেন যে তুমি রেলগাড়িতে সিট সংরক্ষণ পেয়েছো তো। চালক সুবল মাথা নাড়িয়ে বললেন হ্যাঁ স্যার। আরও বললেন স্যার এখন আমার সঞ্চয়ে যেটা জোগার রয়েছে সেটা নিয়েই যাত্রা করব ভাবছি। আর প্রয়োজন হলে, আপনার কাছে খবর পাঠাবো। এই কথা বলে সাহেবের ঘর থেকে চালক সুবল বেরিয়ে পড়লেন উদ্দেশ্যে আরোগ্য নিকেতনের খোঁজ স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct