ভারত বিভাজনের মতো ট্র্যাজেডির পর থেকে দেশে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর এত বড়, সুপরিকল্পিত এবং কর্তৃত্ববাদী প্রচেষ্টা সম্ভবত আগে কখনও হয়নি। অথচ দেশের সবচেয়ে বড় দুটি সম্প্রদায়কে একে অপরের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করাই হল রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং তাদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠাই দেশপ্রেমের প্রথম ধর্ম। প্রথম চ্যালেঞ্জ হল হিন্দুদেরকে হিন্দুধর্মের চেতনার সঙ্গে এবং মুসলমানদেরকে প্রকৃত ইসলামের সঙ্গে সংযুক্ত করা। এ নিয়ে লিখেছেন যোগেন্দ্র যাদব। আজ শেষ কিস্তি।
ভারত জোড়ো যাত্রা’ শুধুমাত্র একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হতে পারে না। দেশের সবথেকে নিচুতলার মানুষের সুখ-দুঃখকে না ছুঁতে পারলে ‘ভারত জোড়ো’ কেবলমাত্র একটা স্লোগান হয়েই থেকে যাবে। এটাও আমরা মাথায় রাখছি যে, ‘ভারত জোড়ো’-কে বাস্তবে প্রয়োগ করতে হলে আমাদের একটি রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে। সেটা হল দেশের মানুষের রোজগার সংক্রান্ত পরিসংখ্যান। গত ২ বছরে দেশের ৯৭ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে, কিন্তু একই সময়ে মুকেশ আম্বানির সম্পদ বেড়েছে ৩ গুণ এবং আদানির সাম্রাজ্য ১৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, দেশের বিত্তশালীদের মধ্যে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে শামিল হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। গত কয়েক বছরে লাখ লাখ ভারতীয় নাগরিকত্ব ছেড়ে দিয়ে বিদেশে বসত গড়েছে। এইসব ধনী ভারতীয়রা আজকাল দেশের বাইরে বিনিয়োগ করছে। এছাড়া ‘হাম দো হামারে দো’, এটাই তো এই সরকারের অর্থনৈতিক নীতি। মোদি-শাহের এই আদানি-আম্বানিমুখী অর্থনীতিতে দেশ দু’ভাগ হয়ে যাচ্ছে। এই অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জ না করে ভারত জোড়ার স্বপ্ন দেখাও বৃথা। নজিরবিহীন বেকারত্ব, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি এবং সাধারণ মানুষের দুর্দশার এই সময়ে ভারত ঐক্যবদ্ধ করার অর্থ হবে লুঠেরা-ডাকাতাদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করে শ্রমজীবী-কৃষিজীবী মানুষকে অর্থনীতির কেন্দ্রেস্থলে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। গর্বকে কর্মের সঙ্গে যুক্ত করা।
ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করার সংকল্পের থেকে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে দূরে রাখা সম্ভব নয়। এই কর্মসূচির সাফল্য নির্ভর করছে রাজনৈতিক দল ও গণ-আন্দোলনের সম্পৃক্ততার ওপর। কিন্তু এই বিষয়টিকে আমাদের প্রজাতন্ত্রের বুনিয়াদি কাঠামোর সঙ্গেও সংযুক্ত করতে হবে। ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে, আমাদের গণতন্ত্র যত দিন গেছে ততই ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। জনগণের ওপর রাষ্ট্রের আধিপত্য বৃদ্ধি পেয়েছে। গত কয়েক বছরে গণতন্ত্র থেকে ‘গণ’ অর্থাৎ ‘মানুষ’ সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। কিংবা আপনি বলতে পারেন দেশের মানুষ শুধু ভিড়ে রূপান্তরিত হচ্ছে। আর সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলো কেবলমাত্র পরিণত হচ্ছে কাগজের টুকরোতে। জুলুমশাহি সরকারের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করছেন, আওয়াজ তুলছেন, তাঁদের জেলে ঢোকানো হচ্ছে। রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন-পীড়নের জন্য পুলিশ-প্রশাসনের পাশাপাশি এখন সিবিআই, ইডি এবং আয়কর দফতরও পিছিয়ে নেই।
সাধারণ মানুষের কথা না হয় বাদ দিন, এখন তো দেখা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদেরও কোনো মর্যাদাই নেই। কোন রাজ্যে কার সরকার গঠিত হবে, তা ঠিক করা হয় দিল্লির দরবারে! মৌলিক অধিকার রক্ষায় আপনি আদালতের দ্বারস্থ হতেও পারবেন না, কেননা বিচারব্যবস্থার দরজাও প্রায় বন্ধ। এমন পরিস্থিতিতে, ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করার অর্থ হতে পারে, ‘লোক’কে (মানুষ) ‘তন্ত্র’-র (ব্যবস্থা) সঙ্গে আর ‘গণ’(জন)কে রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত করা। যাতে লোকতন্ত্র বা গণতন্ত্র আর গণরাষ্ট্র পূর্ণবিকশিত হতে পারে। এখন ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রার একটি মাত্র রেজোলিউশন হতে পারে। ওরা খণ্ড-খণ্ড করে ভাগ করবে আর আমরা রঙধনু জুড়ব। তাই ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র প্রচারে স্লোগান হতে পারে, “ওরা ভাঙবে, আমরা জুড়ব” (ওহ তোড়েঙ্গে, হাম জোড়েঙ্গে)। সুন্দর ভবিষ্যতের সঙ্গে ভারতকে সংযুক্ত করা গেলে সেটাই ‘ভারত জোড়ো’র অর্থবহ সাফল্য হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। (সমাপ্ত...)
লেখক ‘স্বরাজ ইন্ডিয়া’র প্রতিষ্ঠাতা।
অনুবাদ: অতনু সিংহ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct