ভারত বিভাজনের মতো ট্র্যাজেডির পর থেকে দেশে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর এত বড়, সুপরিকল্পিত এবং কর্তৃত্ববাদী প্রচেষ্টা সম্ভবত আগে কখনও হয়নি। অথচ দেশের সবচেয়ে বড় দুটি সম্প্রদায়কে একে অপরের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করাই হল রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং তাদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠাই দেশপ্রেমের প্রথম ধর্ম। প্রথম চ্যালেঞ্জ হল হিন্দুদেরকে হিন্দুধর্মের চেতনার সঙ্গে এবং মুসলমানদেরকে প্রকৃত ইসলামের সঙ্গে সংযুক্ত করা। এ নিয়ে লিখেছেন যোগেন্দ্র যাদব। আজ প্রথম কিস্তি।
হে আন্দোলনজীবী, এই ভারত জোড়ো যাত্রা’-র নামে কী শুরু হয়েছে? আপনি কোন ভারতকে সংযুক্ত করবেন? আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না যে জাতি নিজেই একত্রিত হচ্ছে। তাহলে দেশকে নতুন করে এক করতে চাওয়ার কী আছে?” আমি যখন থেকে ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’-য় যুক্ত হওয়ার কথা জনসমক্ষে ঘোষণা করেছিলাম, তখন থেকেই আমাকে এরকম অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সামনে আসা এই প্রশ্নগুলি বেশিরভাগই তীক্ষ্ণ, এমনকি অনেকক্ষেত্রে গালিগালাজেও পরিপূর্ণ। এই যাত্রার ঘোষণা কংগ্রেস দলের পক্ষ থেকে করা হলেও দেশের সাম্প্রতিক গণ-আন্দোলনের একটি বড় অংশ এবং দেশের নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এই কর্মসূচিকে স্বাগত জানিয়েছেন। অন্যদিকে, এই যাত্রাকে যে সব গণ-আন্দোলন ও জন-সংগঠন সমর্থন জানিয়েছে, তাদের তরফে এর সমান্তরালে ‘ঘৃণা ছাড়ুন, দেশ জুড়ুন’ শীর্ষক আরেকটি কর্মসূচির ঘোষণা করা হয়েছে। এটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয় যে এই মতাদর্শগতভাবে ভিন্নভিন্ন কণ্ঠস্বর থেকে দেশকে যুক্ত করার (‘ভারত জোড়ো’) সুর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। কিন্তু এই ব্যাপারে অনেকেই নানারকম অর্থ হাজির করছেন! এক প্রবীণ গান্ধিবাদী আমায় বললেন, “হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্য আপনারা ভারতব্যাপী এই পদযাত্রার ডাক দিয়েছেন, তাই না? এটা খুবই প্রয়োজনীয়।” আমি কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে উত্তর দিলাম, “না শুধুই এটা নয়, তবে এই ভাবনাটাও যাত্রার মধ্যে অবশ্যই থাকবে। কিন্তু মূল বিষয়টা অন্য।” যদিও অনস্বীকার্য যে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য দৃঢ় করা এই মুহূর্তে ভারত মায়ের আহ্বান। ভারত বিভাজনের মতো ট্র্যাজেডির পর থেকে দেশে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর এত বড়, সুপরিকল্পিত এবং কর্তৃত্ববাদী প্রচেষ্টা সম্ভবত আগে কখনও হয়নি। অথচ দেশের সবচেয়ে বড় দুটি সম্প্রদায়কে একে অপরের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করাই হল রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং তাদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠাই দেশপ্রেমের প্রথম ধর্ম।
কিন্তু আজ প্রথম চ্যালেঞ্জ হিন্দু-মুসলিমকে একত্রিত করা নয়। বরং প্রথম চ্যালেঞ্জ হল হিন্দুদেরকে হিন্দুধর্মের চেতনার সঙ্গে এবং মুসলমানদেরকে প্রকৃত ইসলামের সঙ্গে সংযুক্ত করা। স্বামী বিবেকানন্দের মতে, হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব এটা নয় যে তার নিজস্ব বিশ্বাসকে অন্যান্য ধর্মের উপরে চাপিয়ে দেয়, বরং এই ধর্ম বিশ্বের সমস্ত ধর্মের সত্যকে স্বীকার করে। কুরআন শরিফের মর্মবাণী কাফেরের মাথাকে তার শরীর থেকে আলাদা করা নয়, বরং প্রতিটি মানুষের শরীর ও মনের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের কথাই বলে পবিত্র এই ধর্মগ্রন্থ। প্রতিটি ধর্মের অনুসারীরা নিজ-নিজ ধর্মের সংকীর্ণ ব্যাখ্যা, ধর্মের ঠিকাদার ও ধর্মের নামে বিদ্বেষ ছড়ানো ব্যবসায়ীদের হাত থেকে মুক্ত না হলে দেশ কোনোভাবেই ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে না। তাই দেশকে একত্রে সংযুক্ত করা বা ‘ভারত জোড়ো’ ডাকের প্রথম ভাবনা এটাই যে ধর্মকে তার শিকড়ের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। ধর্মের ক্ষেত্রে যা প্রযোজ্য জাতিসত্তার ক্ষেত্রেও সেটাই। এমনকি প্রদেশ, ভাষা এবং মাটির ফারাকের ক্ষেত্রেও। ভারতকে যুক্ত করার অর্থ হল প্রাদেশিক ও ভাষিক ব্যবধান দূর করা। কিন্তু এটা করতে গিয়ে প্রাদেশিক পরিচয় ভুলে গিয়ে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিসর্জন দেওয়ার চেষ্টা করা হলে, তা মারাত্মক ভুল হবে। বিশেষ করে যখন উত্তর ভারতের হিন্দিভাষী লোকেরা দেশের বাকি অংশকে প্রাদেশিকতা ত্যাগ করে ভাষাগত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে বলে, তখন তাদের চেহারায় ভাষা ও সংস্কৃতির আধিপত্যবাদ প্রকট হয়ে ওঠে। ভারতকে সংযুক্ত করতে হলে প্রথমে হিন্দিভাষীদের এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে যে তারা দেশের মালিক এবং বাকিরা ভাড়াটে। এই যাত্রার ক্ষেত্রে একটি সুন্দর বিষয় হল, হিন্দির চেয়ে অনেক প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ তামিল ভাষা ও সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা জানাতে এই যাত্রাটির সূচনা কন্যাকুমারী থেকে করা হচ্ছে। একইভাবে, জাতপাতের বৈষম্য দূর করার অর্থ এই নয় যে জাতপাত বিষয়টিকে আমরা চোখ দিয়ে দেখব না, বা আমাদের নামের সঙ্গে পদবির ব্যবহার বন্ধ করে দেব। মনে রাখা দরকার, দেশে নিজেদের জাতপাত না জানার সৌভাগ্য শুধুমাত্র উচ্চবর্ণের শহুরে মানুষদের মধ্যে রয়েছে। নাম থেকে বর্ণনির্দেশক চিহ্ন মুছে ফেললেই জাতপাতের সমস্যা মেটে না। এই সমস্যা সমাধানের উপায় হতে পারে আমাদের সমাজে আজও জাতপাতের ভিত্তিতে রয়ে যাওয়া অস্পৃশ্যতা, বঞ্চনা ও বৈষম্যের অবসান ঘটানো। অর্থাৎ জাতপাতে উচ্চ-নিচ ফারাক তথা বর্ণবিভাজন ধ্বংস করা। ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করার অর্থ বর্ণব্যবস্থাকে নির্মূল করা।
লেখক ‘স্বরাজ ইন্ডিয়া’র প্রতিষ্ঠাতা।
অনুবাদ: অতনু সিংহ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct