হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত পারমাণবিক অস্ত্র ‘দুটি’ থেকে বেড়ে আজ কয়েক হাজারে পরিণত হয়েছে। বিশ্বে বর্তমানে প্রায় ১৩ হাজার পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত রয়েছে। এই বিপুলসংখ্যক পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত বিভিন্ন পরিস্থিতিকে যে কঠিন করে তুলছে, তা বলাই বাহুল্য। সম্প্রতি শীতল যুদ্ধের উত্তেজনার পারদ সর্বোচ্চ উচ্চতায় ওঠার পর থেকে আজ অবধি পারমাণবিক বিপর্যয়ের প্রশ্নে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বিশ্ব। এ নিয়ে লিখেছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডান। আজ শেষ কিস্তি।
এ কারণে বিগত ৩৫ বছর ধরে পারমাণবিক শক্তির পথে হাঁটেনি নিউজিল্যান্ড। একই সঙ্গে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্বের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে ওকালতি করে আসছি আমরা।এর অর্থ এই নয় যে, আমরা বাস্তব জগতের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট অনুধাবন করতে পারি না। অথবা আমাদের ভৌগোলিক অবস্হানের পরিপ্রেক্ষিতে পারমাণবিক পরীক্ষা ঘটানো হয় বলে আমরা এটি করছি, যা এরূপ অন্যান্য ভৌগোলিক এলাকার বাসিন্দারা করে না। কিংবা এর অর্থই এই নয় যে, আমাদের কাছে এটি একধরনের ‘বিলাসিতা’। প্রকৃতপক্ষে নিউজিল্যান্ডের বার্তা হলে, ‘পারমাণবিক অস্ত্রের মুখে আমরা কেউ নিরাপদ নই। একই সঙ্গে বিশ্বের কোনো স্হানই এর ঝুঁকি এড়াতে পারে না। কাজেই এখান থেকে ফেরত আসতে হবে, এটি বন্ধ হওয়াই উচিত’—এরূপ অভিব্যক্তি দেশের অধিকাংশ জনগণের। এই অবস্হায় নিউজিল্যান্ডের বক্তব্য হলো, ‘আমাদের শুধু এটি বিশ্বাস করতে হবে যে, এটি থামাতে একটি ভিন্ন উপায় খঁুজে বের করা, অর্থাত্ নতুন কোনো কার্যকর ব্যবস্হার অবতারণা করা অবশ্যই সম্ভব।’ একটি নিরাপদ ভবিষ্যতের পথ তৈরি করতে আমদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। এজন্য ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখা দরকার আমাদের। হিরোশিমা ও নাগাসাকি আমাদের কী শিক্ষা দিয়েছে, সেই বিভীষিকাময় ঘটনার শিক্ষা অনুধাবন করতে হবে। এবং এ ক্ষেত্রে বলতে হয়, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পরিচালিত পরীক্ষাগুলো এটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট যে, পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন ‘ঝুঁকি’ ছাড়া আর কিছুই নয়।
বহুপাক্ষিক পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে সম্মত হওয়ার চ্যালেঞ্জগুলো দুরূহ বলে মনে হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, এটি এমন কোনো কাজ নয়, যা অনির্দিষ্টকাল ধরে ফেলে রাখতে হবে। এই মুহূর্তে চুক্তটি বাস্তবায়ন করা কষ্টসাধ্য বটে। পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়বে। আরো গভীরভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ শর্তগুলো পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়ন করার প্রশ্নে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান সংশয় ও হতাশা কাজ করে। রাষ্ট্রগুলোর যুক্তি হলো, বৈশ্বিক নিরাপত্তার পরিবেশ এটিকে যথেষ্ট কঠিন করে তুলবে। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে চুক্তির প্রতি দেশগুলোর বিশ্বাস হারানোর একটি বাস্তব সম্ভাবনা রয়েছে। পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ অগ্রগতি ও পারমাণবিক অস্ত্রসামগ্রীর বিস্তার রোধ—উভয়কেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের অনেক কিছু করার আছে। কেউ কেউ বলতে পারেন, ‘বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্হিতি যে অবস্হায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তাতে নতুন করে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা অনিবার্য হয়ে পড়েছে। এবং একই সঙ্গে এটি পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ ও এর বিস্তার রোধের প্রচেষ্টাকে ক্ষুণ² করছে।’ কিন্তু তাদের সঙ্গে আমি একমত নই কোনোভাবেই। আমি এমন একটি যুক্তি মেনে নিতে পারি না, যা নিরাপত্তা ও অস্হিতিশীলতাকে সামনে এনে দাঁড় করিয়ে আমাদের কাজটি করতে বাধাগ্রস্ত করে। এমন দাবি আমার কাছে সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য হবে, যা বিশ্বকে নিরাপদ ও স্হিতিশীল করে তোলার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বস্ত্তত এমন সব ধারণা চুক্তির ইতিহাসকে মিথ্যা বলে প্রমাণ করে—এনপিটি বাস্তবায়নের লম্বা ইতিহাস এই শিক্ষা দেয় যে, বহুপাক্ষিক যুক্তিও অস্বাভাবিক নয় কোনোভাবেই। ভিন্ন মত, ভিন্ন পথ থাকতে পারে। এটি অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে একটি ‘সাহসী নেতৃত্ব’। পারমাণবিক স্তূপের শীর্ষ চূড়ার ওপর দাঁড়িয়ে আছি আমরা—এই ঝুঁকির বিষয় সামনে রেখে এর বিরুদ্ধে ‘বিশ্ব স্বীকৃতি’ আদায় অত্যন্ত জরুরি। এবং সর্বোপরি জরুরি হলো বিশ্বকে পারমাণবিক অস্ত্র থেকে মুক্ত করার জন্য গৃহীত প্রচেষ্টাগুলোর ধারাবাহিক অগ্রগতি। ভুলে গেলে চলবে না, ‘এটি কেবল সম্ভবই নয়, অতি জরুরি।’ (সমাপ্ত...)
লেখক নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী (দ্য গার্ডিয়ানের সৌজন্যে)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct