সাক্ষাতের আলাপ
কেতকী মির্জা
হঠাৎ গাড়িতে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক দেওয়াতে ; প্রচন্ড জোরে ঝাঁকুনি খায় আলাপ। খুব মনোযোগ সহকারে খবরের কাগজের পাতায় চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিল সে ; মাথাটা বেশ ঝিমঝিম করে উঠেছিল। সম্বিত ফিরতেই গাড়ির ফ্রন্ট গ্লাসে দেখল, সামনে রাস্তায় মানুষ জনের জটলা। “ আরে কি ব্যাপার ! কি হলো দেবু ? সামনে এতো লোকজনের ভিড় কেন ? দেখো তো একটু। “ গাড়ির ড্রাইভার দেবু ড্রাইভিং সিটের থেকে নেমে খবর নেবার জন্যে ভীড়ের দিকে এগিয়ে গেল, এবং খবর নিয়ে ফিরে এসে বলল, -- “ একজন ভিখিরি বৃদ্ধা মাথা ঘুরে পড়ে গেছে রাস্তায় ; সে জন্যই ওখানে এতো ভীড় জমেছে। অবশ্য সে রকমের ভারি কিছু চোট লাগেনি। তবে হাঁটু এবং হাত দুটো অল্প একটু ছড়ে গেছে ; আর সেখান থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। আলাপ নিজে নেমে গিয়ে ; বৃদ্ধাকে নিজের গাড়ি করে কাছেই একটা বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে এলো। পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে ; রিসেপশনে জমা দিয়ে বলল , “ ডাক্তারবাবু কে শিগগির কল করুন। এই বৃদ্ধার ভালো করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। ড্রেসিং ওষুধ পত্র যা দেওয়ার প্রয়োজন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করুন। ডাক্তারবাবু কে দেখিয়ে তাড়াতাড়ি চিকিৎসার বন্দোবস্ত করুন। এরপর ডাইভার কে বলল ; আমি রিক্সা নিয়ে চলে যাচ্ছি ফ্যাক্টরিতে। তুমি ওনাকে ডাক্তার দেখানো হলে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে তারপর এসো কেমন ? “ আজকালকার দিনে এরকমের মানবিক মানুষ ; খুব একটা চোখে পড়ে না। সিঁড়ি দিয়ে নাববার সময় ; দেখা হয়ে যায় ডাক্তার সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে । ডাক্তার বাবুকে দেখে ; আলাপের মন আনন্দে ভরে যায়। কলেজের সেই মিউ মিউ করা ছেলেটিকে আজকে কত স্মার্ট আর হ্যান্ডসাম লাগছে। বিদেশ থেকে এম ডি করে এসেছে, এবং এখন অনেক নামকরা ডাক্তার হয়েছে আর প্রতিষ্ঠিত। আলাপও কিন্তু আগের মতোই হ্যান্ডসাম ও স্মার্ট আছে, শুধু মুখটা কেমন উদাস ভাবের, আর শুকনো মলিন দেখাচ্ছে। এভাবে উভয়ে উভয়েরই মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে কত কিছুই না ভেবে নেয় মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। অনেক দিন পর, এভাবে অকস্মাৎ দেখা হওয়াতে, খুশির ঝলক দেখা দেয় দুজনেরই চোখে মুখে। আরে আলাপ কি ব্যাপার , এখানে কেন কেউ ভর্তি আছে নাকি? আলাপের মুখে সমস্ত বিস্তারিত শুনে অবাক সাখাওয়াত। তারপর পিঠ চাপড়ে বলল,-- “ বাহ্ তুই তো দেখছি সেই আগের মতোই আছিস, ঠিক সেই কলেজ লাইফের মতই দিলদারিয়া ভাবটাকে বাঁচিয়ে রেখেছিস। হুবহু অবিকল ঐ ভাবটাই এখনো পর্যন্ত ধরে রেখেছিস। “ তারপরও ওরা একই সঙ্গেই দু’জনেই, বেশ জোরেই হো হো করে হেসে উঠল। আলাপ বললে, সাক্ষাৎ, তুই আগে তাড়াতাড়ি মহিলার চিকিৎসা করিয়ে দে ভাই, আজকে আমার অনেক লেট্ হয়ে গেছে।” কলেজে পড়াকালীন সময়ে সাখাওয়াত সব বন্ধুবান্ধবের কাছেই সাক্ষাৎ নামেই ও পরিচিত ছিল। এবং, সব্বাই ওই নামেই ওকে ডাকতো। এক ঝলকে আলাপের কলেজ জীবনের সব কথা স্মৃতি পটের স্মৃতিসৌধে ঘোরাফেরা করতে লাগলো। এবং, বেশ উদাসীন হয়েও পড়েছিল। হঠাৎ সম্বিত ফিরতেই আলাপ বললে,--
“ পরে একদিন বেশ টুটিয়ে গল্প করা যাবে, কেমন ! আয়, একদিন আমার বাড়িতে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে।” উৎফুল্ল সাক্ষাৎ , একটা কার্ডে নাম লিখে আলাপের হাতে তুলে দিল। সামনে বুধবার আমাদের বিবাহবার্ষিকী আছে। অবশ্যই আসবি কিন্তু সপরিবারে, কেমন। সলজ্জ ম্রিয়মান হয়ে ঘাড় নেড়ে দ্রুত চলে গেল আলাপ । নিজের অফিসে এসে ; ঢকঢক করে এক গ্লাস জল খেল। ইদানিং বুকের মধ্যে যেন একটা মোচড়ানো টনটনে ব্যথা অনুভব করে ও প্রায়ই। যার জন্য বাড়ির সকলের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে , ঘরবেঁধে সযত্নে ফুলের মতো করে সাজিয়ে রেখেছে, যাতে কোনো রকমের আঘাতে ভেঙে খানখান ; হয়ে না যায়। সেই ফুল একদিন কাঁটায় পরিণত হয়ে ; আমার হৃদয়কে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে , চলে গেল অন্যের ফুলদানিতে। সাত বছরের ছোট্ট মেয়ে ; তাকে কিনা বাবা মায়ের কাছে না রেখে, হোস্টেলে রাখতে হয়েছে ! হায় রে পোড়া কপাল! বেশি লোক সমাগম আনন্দ উচ্ছ্বাস এসব আর কোনো কিছুই কেমন যেন ভালো লাগে না আর, ঐ আগে মতো। সাক্ষাতের আমন্ত্রণে কিন্তু ; আনন্দ খুশি ও মনের প্রবল ইচ্ছাতেই এলো তার বাড়িতে। তাকে দেখেই বলে উঠলো, “ আরে আলাপ একা এলি যে ? রৌশনি , মেয়ে ওদের কে সঙ্গে নিয়ে এলি না কেন ? “ আলাপের উজ্জ্বল মুখটা শুকিয়ে একেবারেই পাংশুবর্ণের হয়ে গেল। একটুখানি চুপ থেকে ; হতাশা কান্ত এক বুক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, --- “ আমি ভীষণ একা হয়ে গেছিরে। একাকিত্বের দহনজ্বালায় নিমজ্জমান অন্ধকারে আমি জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি। পার্টির শেষে আমার সব কথা আজ শোনাব তোদের। এই সুন্দর পরিবেশ যাতে নষ্ট না হয়ে পড়ে ; যার জন্যেই নিজেকে একটু আনন্দ হৈহুল্লোর মধ্যে ব্যস্ত রাখল আলাপ। খাওয়া দাওয়া সাঙ্গ করে অতিথিরা যে যার মতো করে একেএকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাওয়ার পর , বন্ধুর কাছে ; তার ব্যাক্তিগত জীবনের সব কথা বিস্তারিত জানতে চাইল সাক্ষাৎ । কোন দ্বিধা না রেখে নিজের বুকটা হাল্কা করতে, আলাপ ; প্রাণ খুলে সবকিছু এক নিঃশ্বাসে দীর্ঘশ্বাস পড়া উথালি পাথালি বুকে, ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল। “ জানিস, আমার অফিসের বস এর , জন্মদিনের পার্টিতে , রৌশনি আর আমাদের আদরের মেয়ে রিনি কে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম, আর, কালো রঙের জাড়দৌসী শাড়িতে সেদিন ঝলমল করছে রৌশনির অপূর্ব রূপ। ও সত্যি সত্যিই সুন্দরী ও বেশ রূপসীও। লোলুপ দৃষ্টিতে আমার দুশ্চরিত্র লম্পট অফিস বস! যেন চেটে পুটে খেতে লাগলো। ওর কুদৃষ্টি আমার চোখ এড়িয়ে ফাঁকি দিয়ে যেতে পারেনি। রাগে পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলতে শুরু করেছে আমার, মেয়েকে হাত ধরে টেনে তুললাম , তারপর ওকে বললাম, চল আমরা বাড়ি ফিরে যায়। এতবড় বিশাল অনুষ্ঠানে সামিল হতে পারেনি কোন দিনই ; তাই মা মেয়ে দুজনেই খুব তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিল সেই উগ্র উন্মাদনা জড়ানো বিকৃত সমাজের অনুষ্ঠান। আমার এরকম আচরণে খুবই রুষ্ট হলো রৌশনি। ও হঠাৎ আমায় বলে উঠলো,-- তোমার তো সবটাতেই বাড়াবাড়ি , এতো লোকের মাঝে, এভাবে চলে আসা কি ঠিক হয়নি মোটেও। খুব ভদ্রতার পরিচয় দিলে মনে করছ তাই না! একেবারে রাগে গজগজ করতে থাকে। রাতের বেলা আর কথা না বাড়িয়ে, যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়ি । এর কিছুদিন পর , আমি বাথরুমে স্নান সেরে বেরুতেই রৌশনি জানালো, অফিস থেকে ফোন এসেছিল, তোমার বসের , ওকে অনেক খুশি দেখাচ্ছিল। কি ব্যাপার , এত উৎফুল্ল কেন শুনি। জানো তোমার বস আমাকে চাকরি দেবে বলেছেন, এবং তাঁরই অফিসে। হঠাৎ একথা বলল কেন ? তুমি কি তাকে চাকরির কথা বলেছিলে নাকি ? হ্যাঁ, মানে কথায় কথায় একবার বলছিলাম, আর কি। ভীষণ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল ওকে, এবং কেমন যেন অস্বাভাবিক দেখাচ্ছিলো। এবং, ভীষণ আমতা আমতা করছে ! চোখের সামনে সেই সন্ধ্যার ঘটনা ভেসে ওঠে তার চোখে মুখে। বারেবারেই ক্ষণেক্ষণেই বলতে বলতেই কেমন অস্থির হয়ে উঠছিল। একটু থেমে আবার বহু কষ্টে বলতে শুরু করল। “ আমার ভিতরে তখন আগুন জ্বলতে শুরু হয়েছে , গলা একটু উঁচু করেই বললাম , তোমার চাকরি করার কি দরকার আছে ? এত অর্থ পিপাসু কেন তুমি। ও ঝাঁঝ দেখিয়ে ওঠে, এবং ওউ বলে উঠলো, “ ওই কটা টাকাই কি হবে আমাদের, এতদিন চাকরি করছ , এখনো তো একটা গাড়িও কিনতে পারলে না। সেই মান্ধাতার আমলের বাইক নিয়ে তো সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। এই তো সেদিন পারভীনের বর একটা ঝাঁ চকচকে গাড়ি কিনে ; সপরিবারে পুরী থেকে ঘুরে এলো। একটু বিলাসিতা করতেও কি , তোমার ইচ্ছে করেনা ? আমি ওর অভিমান বুঝতে পেরে , জরিয়ে ধরে আদরের সঙ্গে বলি, না ; তা পারিনি একথা সত্য, কিন্তু সততার সাথে মাথা উঁচু করে জীবন যাপন তো করছি, এটাই বা কম কিসের ? আমি শুধু এটুকুই জানি, আমার রৌশনি কাছে থাকলে ; আর কিছুই দরকার পড়বে না বুঝলে সোনা ! চারিদিক রৌশনাই হয়ে আছে ; আমার এই ছোট্ট সংসারে রৌশনির ছটায়। ও তখন একটু নরম হয়ে বলে, বেশ তারপর, সে না হয় মানলাম। কিন্তু রিনিকে একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করতে হবে। ওর ভবিষ্যত আছে ; পড়াশোনা এসবের জন্য তো অনেক টাকা পয়সার প্রয়োজন তুমি তো ভালো করেই জানো ; আর মেয়েমানুষ বলে ; বাড়িতে বসে বসে শুধু স্বামীর রোজগারে খাবো ! আমার উপরে কোনো ভরসা নেই তোমার ? আরে না গো ; সেটা নয় , তোমার কথার যুক্তি আমি মানছি। কিন্তু আমি না ঠিক তোমাকে ফুলের মতো করে সাজিয়ে রাখতে চাই । কোনো আঘাতে যেন এই ফুলের সৌন্দর্যে আঘাত না লাগে, কোন রকমের বিচ্যুতি না ঘটে। খানিকটা হেসে বলে উঠলো রৌশনি ; ---- আমাকে তোমার মনের মাঝে সাজিয়ে রেখো চিরদিন , তাহলেই আমি খুশি আর কিছু চাই না। প্রতিনিয়ত এভাবেই ভালোবাসার সাগরে ; স্নান করে আসছিলাম আমরা সংসার জীবনে । কিন্তু ওর ধনসম্পত্তির লোভ ক্রমশ ; উত্তরাত্তর বাড়তেই থাকলো। লোভের বশবর্তী হয়ে বসের প্রেমজালে ধরা দিল ; একদিন সে চলে গেল ওর সঙ্গে ; স্বামী কন্যা রেখে বাড়ি ছেড়ে, আমাকে একা করে দিয়ে। অনেক বুঝিয়ে ছিলাম রাজি হয়নি , ডিভোর্স চাইলো ! আমি ওর হাতে পায়ে ধরে কাদঁলাম। এবং নয়ের পাতার পর
বললাম,--- মেয়ের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। শুনলো না ও কিছুতেই ; ঠিক কে যেন ওকে যাদু করেছে। ও আমার কথার কোনো গুরুত্বই দিলো না। ওর কাছে যেন আমি কেউই নয়। বস এর কাছে এসে ওকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ভিক্ষা চাইলাম ; সে বলল , ---- দেখো আলাপ , তোমার বৌ যখন একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে , আর সে তোমার কাছে থাকবে না। আমি ছেড়ে দিলেও সে ; অন্য কারোর সঙ্গে আবারও সম্পর্ক স্থাপন করবে। কারণ রৌশনি প্রচুর ধনসম্পত্তির আর বড়োলোক হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। ওর অর্থ পিপাসু লোভী মন ওকে এখন আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। আর, ওর যা রূপ যৌবন, তাতে ও যে কোন পুরুষকেই রূপের জালে আবদ্ধ করে ফেলতেও পাড়বে। আর তুমি কিছুতেই এই মুহূর্তে ওকে ধরে রাখতে পারবে না। তার থেকে তোমার বৌয়ের সঙ্গে ডিভোর্স নিয়ে নেওয়াটাই আমি ভালো মনে করি।” এবং, তখন প্রচন্ড রাগে উত্তেজিত হয়ে বসের সার্টের কলার চেপে ধরি, এবং চিৎকার করে উঠি এবং বলি, ‘’ কুত্তা শালা হারামীর বাচ্চা তোকে শেষ করে ফেলব ‘’ আমার হাত ছাড়িয়ে বলেছিল,“ শান্ত হও, বাড়ি গিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবনা চিন্তা করে দেখো। “ ফিরে এলাম বাড়ি। এবং, মাথায় যেন চড়্ চড়্ করে আস্ত আকাশটা ভেঙ্গে পড়ল , অবশেষে নিরুপায় হয়ে ডিভোর্সের সিদ্ধান্তই নিতে হল আমাকে। লোকজনদের বিভিন্ন টিপ্পনী কানে আসে। বৃন্ত থেকে খসে পড়া ; শুকনো ফুলের মত মনে হলো নিজেকে। মেয়ের কথা চিন্তা করে তাকে বুকে চেপে ধরে শক্ত হলাম। আমার অবস্থা দেখে , সহৃদয় আমার এক কলিগ, নাম সুমন ব্যানার্জি। সে মেয়েকে হোস্টেলে থাকার সমস্ত রকমের ব্যাবস্থা করে দিল। এবার হাড়ে হাড়ে বুঝলাম গাড়ি, বাড়ি, ধন দৌলত এর কাছে, আমার আকন্ঠ নিষ্প্রাণ অকৃত্রিম ভালোবাসার দাম অতি তুচ্ছ , এবং নগণ্য। তাই লোকজনের চক্ষু এড়াতে অফিসের চাকরি ছেড়ে ; নিজের বসত বাড়িটি বিক্রি করে দিয়ে এই শহরে এসে , ছোট একটি ব্যাগের দোকান করেছি। রোজগারের নেশায় পাগল হয়েছি আমিও। নিজের সম্পূর্ণ একার উদ্দ্যমে, পরিশ্রমে, সততার মধ্য দিয়ে , খুব দ্রুত উন্নতিও করেছি। এবং, বড় ব্যাগের কারখানা করে , এখন আমি প্রতিষ্ঠিত, এবং এক্সপোর্ট বিজনেস ম্যান। ‘’ আলাপ এন্টারপ্রাইজ প্রাইভেট লিমিটেড ‘’ এর কর্ণধার। সাক্ষাত ও তার স্ত্রী হেনা , ঘটনা শুনে অবাক বিস্ময়ে হতবাক। মুখে কোন কথা সরে না কারোর, ঘর যেন নিঃশব্দে ভরে গেছে, এবং থমথম করছে। হেনা বলে, উঠলো আপনি আবার বিয়ে করে সংসারী হচ্ছেন না কেন! ওকে চুপ করিয়ে দিয়ে ; আলাপ আবার বলে উঠলো,ঘটনা এখনও শেষ হয়নি। পরিস্থিতি খুবই জটিল পর্যায়ে দিকে চলে গেছে। ও সুমন ব্যানার্জির কাছ থেকে ঠিকানা জোগাড় করে , স্কুলে গিয়ে দেখা করেছে মেয়ের সাথে। মেয়ে দুঃখে অভিমানে, দেখাও করতে চায়নি প্রথমে , কিন্তু ; প্রিন্সিপাল ম্যাম এর কথায় দেখা করেছে। বন্ধু বলে উঠলো, ---- তোর ওইটুক্ মেয়ে কত কষ্টই না পেল বলতো আলাপ! কাতর কণ্ঠে সাক্ষাত বলে ওঠে, হ্যাঁ রে ভাই , আর যাই হোক মেয়ে আমার খুব বুদ্ধিমতি। ও বলে মাকে চাই না আমি। তুমিই আমার বাবা , তুমিই আমার মা। যে এতো ভালো মানুষ আমার বাবাকে কষ্ট দেয়, আমি তাকে ভালোবাসি না। আমি তখন তাকে বলি, আহারে ছোট্ট সোনা কতই না মনে মনে কষ্ট পাচ্ছিস তুই, ভাবলেও চোখে জল আসে। চোখের জল মোছে হেনা। তারপর শোন , সুমন এসে একদিন বলল ; রৌশনি খুব কষ্টে আছে । ওকে বস বিয়ে করার প্রলোভন দেখিয়ে , সব কিছু লুঠ করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে রাস্তায়। ভুলের অনুশোচনায় অন্তরে বাহিরে, এখন ওকে কুরে কুরে খাচ্ছে। লজ্জায় ঘৃণায় রৌশনি আত্মঘাতী হতে যাচ্ছিল একদিন রেললাইনে। কতকগুলি লোক ধরে ফেলে তাকে বাঁচায়। আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে ; রাজি হইনি কিছুতেই , কিন্তু সুমন কাকুতিমিনতি করায় রাজি না হয়ে পারিনি। ওকে দেখে আমার ভিতরের যত ক্ষোভ , ঘৃণা সব হওয়ায় মিলিয়ে গেল, এক নিমিষে। প্রচুর কষ্ট পাচ্ছিলাম আমি ভিতরে বাহিরে। অন্তরতম ভিতরের মনটা যেন আতশবাজির মত ফেটে যাচ্ছিল একেবারে। ক্ষমা চাওয়া ছাড়া একটা কথাও আমার সামনে বলতে পারেনি সেদিন রৌশনি। শুধুই অঝোরে ফুটে ফুটে কাঁদছিল, আর চোখ মুছছিল। সুমন বলল ;--- ক্ষমা করে দিয়ে ; আবার ফিরিয়ে নাও বন্ধু তোমার কাছে। মানুষ মাত্রই ভুল করে , ও নিজের ভিতরে ভিতরে বোধের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে একটা সময়ে ভীষণভাবে অনুতপ্ত হয়ে পড়ে নিজের কৃতকর্মের জন্য। আর তখনই তো প্রয়োজন হয় ক্ষমা শব্দটির। দেখবে তুমি তখন আবার ভীষণ সুখী হয়ে উঠবে, এবং, সংসারটা আবার ভীষণ সুখময় হয়ে উঠবে নিশ্চয়ই। আমি একেবারেই এই সত্য অনুভব করতে পারছি। তখন হেনা বলে উঠলো, সেই ভালো, আপনি তাই-ই করুন। অন্ততপক্ষে ছোট্ট মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে, আপনি ওকে ক্ষমা করে দিন। ভুল হলে ক্ষমা করা যায়, যে তার ভালোবাসা ত্যাগ করে ; নিজের গর্ভের সন্তানের মায়া মমতাকে বিসর্জন দিয়ে , পরপুরুষের সাথে বাস করে , সেটা ভুল নয়, সেটা হলো পাপ। আর, সেই পাপের জন্য আমি ক্ষমা করার কে ? এটা সম্পূর্ণ ঈশ্বরের হাতে, যা করার ঈশ্বরই করবেন। তাছাড়া শরিয়তের বিধান অনুযায়ী, যদি রৌশনি যার হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিল , যদি সে বিয়ে করার পর তালাক দিত, তাহলে আমি না হয় ! মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে , আবার নতুন করে ওকে নিকাহ্ করার চিন্তা করতে পারতাম । কিন্তু তাও তো করেনি ! সাক্ষাত বলে ওঠে ; এতো ভারি উভয় সঙ্কোটে পড়া গেল । তাহলে কি করবি ভাবছিস ? তোরাই বল ভাই আমি কি করতে পারি ! অঝোরে কাঁদতে থাকে আলাপ। একটাই উপায় কোন সজ্জন সহৃদয় ব্যক্তি যদি নাম মাত্র বিয়ে করে তালাক দেয় ; তাহলে আবার তুই ঘুরিয়ে বিয়ে করতে পারিস তাই না ? কিন্তু এটা তো বিশাল ঝামেলার ব্যাপার আছে । কাকে আর সেরকম পাওয়া যাবে বল ? বলে আলাপের মুখের দিকে ; তাকিয়ে রইলো সাক্ষাত। সবাই চুপচাপ নিথর নিস্তব্ধ নিস্পন্দ, ঘরটাতে যেন কালবৈশাখীর উষ্ণ বাতাস ঝাপটা দিয়ে যাচ্ছে থেকে থেকে , বাজ পড়ছে কড়্ কড়াৎ রবে, কিন্তু, বৃষ্টির দেখা নেই। একটা গুমোট আবহাওয়া তৈরি হয়ে গিয়েছে ঘরময়। আলাপ এক ঝটকায় উঠে পড়ে, এবং হতাশার সুরে বলে উঠলো, ঠিক আছে ভাই আমাকে ক্ষমা করিস তোরা। আমি নিজের মনের জ্বালায় , এতটাই মূহ্যমান হয়ে পড়েছি যে, আমি একবারও খেয়ালই করিনি, আজ তোদের আনন্দের দিন, বিবাহবার্ষিকী। আজকের এমন সুন্দর তোদের দিনটাকে আমি আমার জীবনের দুঃখময় কথা শুনিয়ে ভারাক্রান্ত করে দিলাম। আজ বাড়ি যাই, অনেক রাত হলো, গুড নাইট। হেনা ঘুমালে ? না গো ঘুম আসছে না। আমারও চোখে ঘুম আসছে না কিছুতেই। কলেজ লাইফ থেকে দেখেছি, আলাপ কে, ওর বাড়িতেও আমাদের সব্বাইকার অবাধ যাতায়াত ছিল। খালামা ; মানে আলাপের মাও খুব নরম কোমল হৃদয়ের মহীয়সী মহিলা ছিলেন। গরীব দুঃখী মানুষের সেবা করতেন। তাঁর সব গুণগুলোই ছেলে আলাপের মধ্যে আমরা দেখেছি। ঠিক সেইরকমই অবিকল হুবহু ওর মায়ের মতনই। কোন মানুষের বিপদে আপদে ; দুঃখ কষ্টে, একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ত, এখনো ঠিক ঐ রকমটিই আছে। যে মানুষ টা সারাজীবন সকলের উপকার করে গেল ; সে আজ ভয়ংকর পরিস্থিতির স্বীকার। যার মোকাবিলা করার সাধ্য বা সাহস কারোর নেই । এর জন্য একমাত্র ওর বউই দায়ী একথা সত্য, আর ওরা তো নিজেরা পছন্দ করেই বিয়ে করেছে। বদের গোড়া মেয়ে ; না হলে কিনা ঘর সংসার ছেড়ে ; পরপুরুষের কাছে কখনও চলে যেতে পারে। আচ্ছা সাক্ষাত তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো ? হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন ; কোনো সংশয় আছে ? আরে না না তাই বলছি ! সাখাওয়াত হেনা কে বক্ষবন্ধনে নিয়ে মাথা রাখে বুকে। হেন তখন কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো, “ আজ যদি আলাপের পাশে আমরা দাঁড়াতে না পারি ,সাক্ষাতের দ্রুত জিজ্ঞাসা, যেমন, উপায় ? হাত দুটো ধরে ফেলে হেনা ! একমাত্র আমারাই পারি ওর সমস্যার সমাধান করতে। যদিও খুব কঠিন কাজ , তুমি আবার ভুল বুঝোনা যেন আমাকে। আমিও একটি সন্তানের মা। সন্তানের কষ্ট সহ্য করতে পারা ভীষণ কষ্টদায়ক ব্যাপার গো, কোন ছোটখাটো মামুলি ব্যাপার নয়। তাই ওদের সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে ; অনেক ভেবেই আমি তোমাকে বলছি । তুমি রৌশনিকে নিকাহ্ করে , তালাক দিয়ে দাও। চার মাস দশ দিন পর ; আলাপের সঙ্গে নিকাহ্ পড়িয়ে দাও । ব্যস সমস্যার সমাধান । চুপিচুপি শুধু তিন জনে জানবো ; তাহলে কেউ টের পাবে না। তুমি আপত্তি কোরোনা সোনামণি। সাক্ষাত মনে মনে কুর্নিশ না করে পারলো না নিজের স্ত্রী কে। কত বড় উদার ও মহৎ মনের হলে , তবেই একজন নারী তার হৃদয়ের সর্বস্বকে অন্য নারীর হাতে তুলে দিতে পারে। ওগো রহস্যাবৃতা প্রেম ভালবাসায় ভরা দুঃসাহসী সুন্দরী নারী , তোমার মধ্যেই প্রকৃতির সৃষ্টিতত্ত্বের আসল গোপন সত্য লুকিয়ে রয়েছে। তোমাকে হাজারও সালাম। সাখাওয়াত হেনা সুন্দর ঔদার্যে ভরা মনটির আবার নূতন ভাবে আবিষ্কার করে, হেনা মুখ চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিল। হেনার কাজলে রাঙানো চোখ দুটো মুছে দিল। তারপর দিন ধার্য করে করে অতি গোপনে কাজী ও সাক্ষী ডেকে নিকাহ্ পড়ানো হলো। রৌশনি এবং সাখাওয়াত এর আবার নূতন করে চলার পথ রচিত হলো। আলাপ শুধু ভাবে আর ভাবতেই থাকে, হেনা যে আলাপের এতবড় উপকার করবে তা তার ভাবতেও অবাক লাগছে। আলাপের মন হেনার উপর কৃতজ্ঞতায় ভরে ভরে গেল। সাক্ষাত কিন্তু নিজেকে ঠিক মত মানিয়ে নিতে পারছে না। বউ এর ঠেলায় পড়ে ; একঘরে রৌশনির সঙ্গে বিছানায় আসতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু বুকের ভিতরটা কেমন জানি , হাহাকার করে উঠছে হেনার জন্য। নিজের বুকে পাথর চাপা দিয়ে, হেনাও কি তাহলে লুকিয়ে বিশাল লবণাক্ত সমুদ্র বক্ষে ফেলছে অশ্রুজল ? ভাবতে ভাবতেই বুকের মধ্যে একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করতে লাগলো। ভীষণ পিপাসার্ত বুকে ক্ষীণ কণ্ঠে, --- “ পানি পানি পানি “ শব্দ উচ্চারণ করল। খেলও বেশ খানিকটা। কিন্তু ব্যথা থেকে প্রচন্ড যন্ত্রণা বেড়েই চলেছে ; কোন রকমেই যন্ত্রণার উপশম হচ্ছে না ওষুধেও। হঠাৎ করে হৃদপিন্ডের স্পন্দন থেমে গিয়ে ; শরীরটা নিথর নিস্তব্ধ স্পন্দনহীন হয়ে পড়ল। রৌশনির বিকট আর্তনাদে ; রাত্রি জাগরণ করা হেনা ছুটে আসে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। বুকফাটা আর্তনাদ করে , কপাল চাপড়াতে থাকে বারেবারেই, নিজেকে দায়ী করে। একি হয়ে গেল আমার জীবনে ...! আমি তো কিছু গোনাহ করিনি। মানুষের বিপদের দিনে পাশে দাঁড়িয়ে শুধু মাত্র একটা ছোট্ট উপকার করতে চেয়েছিলাম, সেটাই কি আমার অপরাধ, পরওয়ারদেগার ! রৌশনি ভাষা হারিয়ে; অপরাধীরমতো পলকহীন শুকনো চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। দুজন নারীই একসঙ্গে বিধবা হয়ে; এভাবেই চার মাস দশ দিন পর, হেনা মন কে পাথরের মতো শক্ত করে , আলাপের সঙ্গে রৌশনির নিকাহ্ ব্যবস্থা করল অতি নিঃশব্দে গোপনে। আলাপের মন আজ উদভ্রান্ত ; প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে হারিয়ে নিজেকে আজ ভীষণ নিঃস্ব সর্বস্বান্ত মনে হয় তার। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে নিকাহ্ আসরে উপস্থিত হলো। নিকাহ্ কবুল হওয়ার আগেই উঠে পড়ে রৌশনি , তাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হেনার পা দুখানি জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলে, আজ আমার পাপের বোঝা তোমার কাঁধে চাপিয়ে , বয়ে বেড়াতে দিয়ে আমি কোন দিন নিজে খুশি থাকব না বোন । নিকাহ্ যদি করতেই হয়, আজ থেকে আমরা দুজনেই শরিয়তের বিধান অনুযায়ী ; দুই বোনে সুখে দুঃখের ভাগিদার হয়ে একসঙ্গেই থাকব। আর আমার মেয়েও একটা ছোট্ট ভাই পাবে তোমার মাসুম ছেলেও ফিরে পাবে তার আব্বুকে। হেনা রৌশনিকে বুকের মধ্যে টেনে নেয়। বুকের মধ্যে জমে থাকা পাথরের বরফটা; উষ্ণতায় একটু একটু করে ,গলে আবার ঝর্ণা হয়ে ঝরতে থাকে। ভোরের পাখির কলতানে ঘুম ভেঙে চেয়ে থাকে নূতন আকাশ; চোখের পাতায়। পুবের আকাশে নূতন সূর্যোদয়ের আলোকচ্ছটায়, জ্যোতির জল হয়ে ওঠে পৃথিবীর মাটি, প্রেমে ভালোবাসায় , মানবিক মানবতায়...।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct