হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত পারমাণবিক অস্ত্র ‘দুটি’ থেকে বেড়ে আজ কয়েক হাজারে পরিণত হয়েছে। বিশ্বে বর্তমানে প্রায় ১৩ হাজার পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত রয়েছে। এই বিপুলসংখ্যক পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত বিভিন্ন পরিস্থিতিকে যে কঠিন করে তুলছে, তা বলাই বাহুল্য। সম্প্রতি শীতল যুদ্ধের উত্তেজনার পারদ সর্বোচ্চ উচ্চতায় ওঠার পর থেকে আজ অবধি পারমাণবিক বিপর্যয়ের প্রশ্নে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বিশ্ব। এ নিয়ে লিখেছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডান। আজ প্রথম কিস্তি।
১৯৪৫ সালে সশস্ত্র সংঘর্ষে প্রথম বারের মতো পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে দুটি পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়। ‘লিটল বয়’ ও ‘ফ্যাট ম্যান’ নামক দুটি পারমাণবিক বোমার আঘাতে এই অঞ্চলদ্বয়ে নিহত হয় ৩ লাখ ৫৫ হাজার মানুষ। পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ঘটনা বিশ্বে এটিই প্রথম। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত পারমাণবিক অস্ত্র ‘দুটি’ থেকে বেড়ে আজ কয়েক হাজারে পরিণত হয়েছে। বিশ্বে বর্তমানে প্রায় ১৩ হাজার পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত রয়েছে। এই বিপুলসংখ্যক পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত বিভিন্ন পরিস্থিতিকে যে কঠিন করে তুলছে, তা বলাই বাহুল্য।বিশ্বব্যাপী এখন হাজার হাজার পারমাণবিক অস্ত্র সংরক্ষিত রয়েছে যদিও; তবে এই সংখ্যা ১৯৮৫ সালে স্নায়ুযুদ্ধের সময়কালের ৬৩ হাজারের বেশি অস্ত্রের এক-চতুর্থাংশেরও কম। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ১৯৬১ সালে জাতিসংঘে যা বলেছিলেন, তা এখনো আগের মতোই জরুরি বার্তা। পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতা নিয়ে তিনি সে সময় উচ্চারণ করেছিলেন এক বিশেষ উক্তি—‘আমাদের নিঃশেষ করার আগেই এই অস্ত্রগুলো আমাদেরই ধ্বংস করে দিতে হবে।’
পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার ঠেকাতে ১৯৬৮ সালের ১ জুলাই ‘নিউক্লিয়ার প্রলিফারেশন ট্রিটিতে (পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধসংক্রান্ত চুক্তি)’ স্বাক্ষর করা শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র। ১৯৭০ সালে চুক্তিটি কার্যকর করা হয়। এই ট্রিটিকে সংক্ষেপে বলা হয় ‘এনপিটি’। কার্যকরের শুরু থেকেই তথা বিগত অর্ধশতক কালের বেশি সময় ধরে চুক্তিটি পারমাণবিক অস্ত্রের ঝুঁকি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। পারমাণবিক অস্ত্রের প্রায় ৮০ শতাংশ হ্রাসের পাশাপাশি পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর ওপরও একধরনের ‘ঢাকনা’ রাখতে অবদান রেখে চলেছে চুক্তিটি, যাতে করে দেশগুলোতে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ার সুযোগ না পায়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, অন্য যেকোনো অস্ত্রের সীমাবদ্ধতা কিংবা নিরস্ত্রীকরণ চুক্তির চেয়ে এনপিটি ট্রিটি অনুমোদন করেছে বেশির ভাগ দেশ। অর্থাৎ, বিশ্বের জন্য পারমাণবিক অস্ত্র যে কী মাত্রায় ঝুঁকি বহন করে, তা প্রতিটি দেশই ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারে। এই মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এনপিটিকে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ আমাদের সবাইকে সেটিই করা উচিত।শীতল যুদ্ধের উত্তেজনার পারদ সর্বোচ্চ উচ্চতায় ওঠার পর থেকে আজ অবধি পারমাণবিক বিপর্যয়ের প্রশ্নে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বিশ্ব। যে কোনো সময়ের চেয়ে আজকের ঝুঁকি বহুগুণ বেশি। পরাশক্তিগুলোর মধ্যকার ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা এবং অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে বিগত দুই দশকের ‘স্হবির অবস্হা’ পারমাণবিক ঝুঁকিকে কঠিন বাস্তবতায় এনে দাঁড় করিয়েছে। বর্তমানে ১৯১টি দেশ এনপিটি নবায়ন করার জন্য জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে কাজ করছে। আলোচনার অগ্রগতি হচ্ছে বটে, তবে মনে রাখতে হবে, এই আলোচনা এমন একটি সময়ে সংঘটিত হচ্ছে, যখন বিশ্বের মানুষের জন্য এটি যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি।
কোনোভাবেই এই সত্যকে উপেক্ষা করা যাবে না যে, পারমাণবিক বিপর্যয় সমগ্র বিশ্বের জন্য শুধু ‘বিশাল’ হুমকিই নয়; বরং তা ক্রমাগতভাবে বিশ্বব্যাপী ‘বড় ঝুঁকি’ তৈরি করেই চলেছে। যেমনটি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে বলতে শোনা গেছে, ‘কোনো সংঘাতের সময় অথবা চরম উত্তেজনা বিরাজকালে ‘পরিস্হিতির ভুল গণনার দ্বারা চালিত হয়ে ভুল করে’ পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করা যেতে পারে। এই অবস্হায় পারমাণবিক শক্তিধর দেশ তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যকে পারমাণবিক অতল গহ্বর থেকে সরে আসতে আহ্বান জানাচ্ছে নিউজিল্যান্ড। এবং একটি নতুন বহুপাক্ষিক পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ কাঠামো নিয়ে আলোচনায় বসার অনুরোধ জানাচ্ছে। বিশ্বের অন্যতম সেরা এই ভৌগোলিক অবস্হানে পারমাণবিক পরীক্ষা চালানো যুক্তিযুক্ত। কিন্তু তার পরও নিউজিল্যান্ড কেন এই সমস্যা সম্পর্কে এত উচ্চ স্বরে কথা বলছে? এই প্রশ্নের উত্তর বেশ সোজা। এটা সবার জনা যে, আমরা একটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় জাতি। কয়েক দশকের পারমাণবিক পরীক্ষার ‘ক্ষতচিহ্ন’ বহন করে চলেছে আমাদের এই অঞ্চল। এই অঞ্চলের মানুষ এবং ভূমি ও জল উভয় ক্ষেত্রেই এই দাগ সুস্পষ্ট। চরম ভীতি ছড়ানোর পাশাপাশি এটি আমাদের জন্য স্বভাবতই একটি উচ্চমাত্রার ঝুঁকি।
লেখক নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী (দ্য গার্ডিয়ানের সৌজন্যে)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct