ভারত-চেতনায় মুহাম্মদ সা.-এর কথা ভোলেননি রবীন্দ্রনাথ
ড. রমজান আলি
সময়কালটি ছিল বন্দেমাতরম্ নিয়ে অতি-ভক্তির কাল। বিভেদের বিষবাষ্পে, সম্প্রদায়গত মানসিকতায় একের মৃত্যুতে অন্যের হাতে রক্ত। সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ মানুষের মনে প্রকৃত ভারতীয়ত্ব রচনা করতে পারেনি। ‘ভারতপথিক রামমোহন’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন--“ধর্মের সংস্কারকে সংকীর্ণ করিলে তাহা চির শৃঙ্খলার মতো মানুষকে চাপিয়া ধরে।” ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথের যে প্রত্যক্ষ-অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তার প্রতিফলন উপন্যাসে পড়াটা অস্বাভাবিক নয়। সেই জাতীয়ভাব উন্মাদনার প্রতিমূর্তি ‘গোরা’ উপন্যাসটি। ব্যক্তিগতভাবে রবীন্দ্রনাথ কখনোই উগ্র-জাতীয়তাবাদের সমর্থক ছিলেন না। সেই চিন্তন বা অভিপ্রায় শেষ পর্যন্ত তাঁর উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র গোরাকে উগ্র স্বাদেশিকতা থেকে অভিজ্ঞতালব্ধ জাতীয়তাবাদী ভাবনায় পৌঁছে শেষে সর্বধর্মের মিলনতীর্থ ভারতবর্ষের স্বরূপটিকে অনুভব করিয়েছেন। সর্বধর্মের মিলনতীর্থ ভারতভূমির স্বরূপ সন্ধানে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ‘গোরা’ উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল ১৩১৪ বঙ্গাব্দের ভাদ্র থেকে শুরু করে ১৩১৬ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাস পর্যন্ত। ঈশ্বর গুপ্তের মতো অনেকেই সিপাহী বিদ্রোহকে ঠিক মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারেননি। রবীন্দ্র-উপন্যাসে গোরার জন্মকে কেন্দ্র করে সিপাহী বিদ্রোহের উল্লেখ থাকলেও উপন্যাসটি শুরু হয়েছে প্রকাশের ২৫-৩০ বছর আগেকার ঘটনাকে নিয়ে। কেন্দ্রিয় চরিত্র গোরা কলেজের পাঠ শেষ করেছে। উনিশ শতকের শেষভাগে তখন স্বদেশপ্রেম ও হিন্দু জাতীয়তাবাদ এক হয়ে গেছে। বিশেষ করে আশির দশকে সমাজে ধর্মকে কেন্দ্র করে অভ্যন্তরীণ সংঘাত চলছে। যেখানে ব্রাহ্ম ও ব্রাহ্মপন্থী হিন্দু এবং রক্ষণশীল হিন্দুদের মধ্যে চাপান-উতর। গোরা তার পিতা কৃষ্ণদয়ালের পথ অনুসরণ করে সংকীর্ণতার আদর্শে ভারতীয়ত্ব অনুসন্ধানে ব্যাপৃত। বন্ধু বিনয় ব্রাহ্ম-মেয়ে ললিতাকে বিয়ে করতে বদ্ধপরিকর হলে, গোরা বিলাপ করে বলেছে—“হায়, আমার দেশ কোথায় ! দেশ কি কেবল একলা আমার কাছে।” দেশ কি এবং কেন ? এই প্রশ্নে গোরার তৎকালীন স্বদেশভাবনা শুরু হয়েছিল। জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে গোরার বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে--‘স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে’ এবং ‘বিংশতি কোটি মানবের বাস’ ইত্যাদি। ডাকাবুকো মনোভাব নিয়েই শুরু হয় তার ব্রিটিশ বিরোধিতা। ‘হিন্দু প্যাট্রিযট’ পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কল্পনার ভারতবর্ষ তখন তারও ভারতবর্ষ। “একটি সত্য ভারতবর্ষ আছে-- পরিপূর্ণ ভারতবর্ষ। সেখানে স্থিতি না হলে আমরা কী বুদ্ধিতে কী হৃদয় যথার্থ প্রাণরসটা টেনে নিতে পারব না।” সংকীর্ণতার এই পরিক্রমায় গোরা বলে-“কেবল হিন্দুয়ানী উদ্ধার করিবার জন্য অবতার হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছি। আমি কেবল মূর্তিমান শাস্ত্রের বচন।”
খ্রিষ্টান বিরোধী ও ব্রাহ্ম বিরোধী মনোভাব নিয়েই গোরার লেখালেখি শুরু। ‘হিন্দুহিতৈষী সভা’ এবং ‘হিন্দুয়িজম’ নামে গ্রন্থ তার এই মনোভাবের সাক্ষ্য বহন করে। দেশপ্রেমের শপথ নিতে গিয়ে সে উচ্চারণ করে--‘যে দেশে জন্মিয়াছি সে দেশের আচার বিশ্বাস শাস্ত্র ও সমাজের জন্য পরের ও নিজের কাছে কিছুমাত্র সংকুচিত হইয়া থাকিব না।” শপথ নিয়ে গঙ্গা-স্নান করে সে সন্ধ্যাহ্নিক শুরু করেছে, টিকি রেখেছে, খাওয়া নিয়ে ছোঁয়াছুঁয়ির বাছ-বিচার করেছে। রাজনারায়ণ বসুর বক্তৃতা কিংবা নবগোপাল মিত্র হিন্দুমেলা তাকে উদ্বুদ্ধ করে। দেশ অনুসন্ধানে গোরার দৃষ্টিভঙ্গি তখন সংকীর্ণতায় আচ্ছন্ন। একটা আদর্শে বিশ্বাস রেখে শুধু প্রচারধর্মী হলেই তো চলবে না, কারণ বাস্তবের সঙ্গে তার যোজন পরিমাণ দুরুত্ব। তাই রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের ভারত পরিক্রমার আদর্শ নিয়ে গোরাকেও গ্রাম ভারতবর্ষের পথে হাঁটিয়েছেন। উপন্যাসের ১৭ নম্বর পরিচ্ছেদে নন্দের মৃত্যুতে গোরা অনুভব করেছিল প্রকৃত শিক্ষার অভাবে সংস্কার কিভাবে গ্রামীণ। মানুষকে গ্রাস করেছে। ধনুষ্টংকার হলে নন্দকে হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে ঝাড়ফুঁক করায় অকালে তার মৃত্যু ঘটে। ২৬ সংখ্যক পরিচ্ছেদে চরঘোষপুরে মুসলমান প্রজাদের উপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কথা বর্ণিত হয়েছে। দলবলসহ গোরা সেখানে কুয়োতে জল খেতে গিয়ে তারা দেখে হিন্দু নাপিত, মুসলমান ফরু সরদারের ছেলে তমিজকে স্নান করাচ্ছে। ছোঁয়াছুঁয়ির সংস্কারে অবিনাশ অন্যদের নিয়ে পালিয়ে গেলেও গোরা রমাপতিকে নিয়ে ফিরে এসে নাপিতের মুখে শুনেছে সেই ঐশী বাণী--“ঠাকুর আমরা বলি হরি, ওরা বলে আল্লা, কোনো তফাৎ নেই।” আবার ঝাঁকাওয়ালা মুসলমান ইংরেজ অত্যাচারের প্রতিবাদ না করে শুধু আল্লার উপর নির্ভরশীল হলে গোরা তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে- “মুহাম্মদ প্রতিবাদ করতেন” তখন গোরার অনুভব-“গ্রামের কোন আপদ-বিপদ হইলে মুসলমানেরা যেমন নিবিড়ভাবে পরস্পরেরপাশে আসিয়া সমবেত হয় হিন্দুরা এমন হয় না।” এবার গোরার উপলব্ধি—“ব্রাহ্মণকে অনেকের মঙ্গল করিতে হইবে... আমি ভারতবর্ষের সেই ব্রাহ্মণ।”
গ্রাম পরিক্রমার বাস্তব অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ গোরার প্রকৃত ভারতীয়ত্বে উপনীত হওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল একটা ধাক্কার। অসুস্থ পিতা কৃষ্ণদয়াল নিজের মৃত্যুর কথা ভেবে গোরার জন্মরহস্য উদ্ঘাটন করলেন। রক্ত সূত্রে গোরা ভারতীয় নয়, আসলে সে আইরিশ সন্তান। সিপাহী বিদ্রোহের সময় তার পিতা মারা গেছে। আর তাকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে তার মা। গোরা অনুভব করলো, তার আর শুচিতা বাঁচানোর প্রয়োজন নেই। এক ধাক্কায় সে এই সত্যে উপনীত হলো- “আমি আজ ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু মুসলমান খ্রিষ্টান কোনো সমাজের কোনো বিরোধ নেই আজ এই ভারতবর্ষের সকলের জাত আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন।” ব্রাহ্ম পরেশবাবুর কাছে গিয়ে সে বলেছে-“আপনি আমাকে আজ সেই দেবতার মন্ত্র দিন, যিনি হিন্দু মুসলমান খ্রিষ্টান ব্রাহ্ম সকলেরই—যার মন্দিরের দ্বার কোনো জাতির কাছে কোনো ব্যক্তির কাছে কোনদিন অবরুদ্ধ হয় না। যিনি কেবলই হিন্দু দেবতা নন, যিনি ভারতবর্ষের দেবতা।” উল্লেখ্য যে এরপরই ১৩৭১ বঙ্গাব্দের ১৯ আষাঢ় রবীন্দ্রনাথ লিখলেন তার সেই বিখ্যাত ‘মাতৃ অভিষেক’ কবিতাটি জানাম বেঁধে ‘ভারততীর্থ’ যেখানে গোরার চেতনা নিয়ে বলা হয়েছে—“হে মোর চিত্ত, পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে/এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।” গোরার অন্তর তখনো পূর্ণ হতে একটু বাকি ছিল। কারণ তাকে লালন-পালন করেছে যে মা আনন্দময়ী, তাকেই সে এতদিন চিনতে পারেনি। বাড়ি ফিরে এসে মায়ের পায়ের কাছে সে এই আবেদন জানিয়েছে যে লছমিয়ার হাতে জল খেতে তার আর বাধা নেই। আর উচ্চারণ করেছে সেই চরম সত্যটি—“যে মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলুম তিনি আমার ঘরের মধ্যে এসে বসেছিলেন। তোমার জাত নেই, বিচার নেই, ঘৃণা নেই শুধু তুমি কল্যাণের প্রতিমা, তুমি আমার ভারতবর্ষ।” প্রকৃত ভারতীয় ঐতিহ্য চেতনায় উপনীত হয়ে তখন সে বলে ওঠে—“আজ আমি সত্যকার সেবার অধিকারী হয়েছি।” তখনই তো রাষ্ট্রসীমা অতিক্রম করে, মানুষের মনে প্রাণে শান্তি আসে। ইসলাম তো সেই শান্তির ধর্ম। বিভেদহীন সমাজের কথাই বলে এসেছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct