দেশে কিছুকাল ধরে সরকার দখলের যে একমুখী স্রোত বহমান, আচমকাই তা ঘুরিয়ে দিল বিহার। প্রবীণ নীতীশ কুমার ও নবীন তেজস্বী যাদবের নিঃশব্দ বিপ্লব প্রবল প্রতাপান্বিত বিজেপিকে হতবাক করে দিয়েছে। এতটাই যে পালাবদল নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা নির্বাক! বিরোধীরা এই পালাবদলে কতটা উৎফুল্ল ও আশান্বিত, তার প্রমাণ, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সবাই নতুন সরকারকে নিঃশর্ত সমর্থনের কথা জানিয়েছে। লিখেছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ শেষ কিস্তি।
বিজেপির মতো এত ঠাসবুনট একটা দল নীতীশের মতো এমন পরিচিত ‘জোটবদলুর’ রাজনৈতিক চাল বুঝতে ব্যর্থ কেন হলো? এ প্রশ্নের জুতসই উত্তর কোনো মহলে নেই। যেমন নেই অমিত শাহর নেতৃত্বে বিহারে ‘অপারেশন লোটাস’ কেন ব্যর্থ সেই হেঁয়ালির জবাব। আসাম, মণিপুর, গোয়া, পাঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্রে দল ভাঙানোর খেলায় বিজেপির টিকি কেউ ছুঁতে পারেনি। ঝাড়খন্ড ও বিহারের ব্যর্থতার কারণ কি তাহলে আত্মতুষ্টি? উত্তর যা-ই হোক, নীতীশের রংবদল ও বিহারে বিজেপির ক্ষমতা হারানো বিরোধীকুলের মরা গাঙে বান ডাকার সমতুল্য। হঠাৎই একটা চনমনে ভাব ফুটেছে বিরোধী শিবিরে। নতুনভাবে আলোচিত হচ্ছে নতুন জোটবদ্ধতার সম্ভাবনা ও তাগিদ। সেই তাগিদ সবাই সমান অনুভব করছে মনে করাটা হবে সত্যের অপলাপ। দেশের বিরোধীকুল বহুরূপী। বিজেপির সন্তুষ্টির কারণও তা। কংগ্রেস, আরজেডি, বামপন্থীদের মতো কিছু দলের বিজেপি বিরোধিতা খাদহীন। ওয়াইএসআর কংগ্রেস, বহুজন সমাজ পার্টির মতো দল তদন্তের ভয়ে বিজেপির আধিপত্য মেনে নিয়েছে। ওডিশার বিজু জনতা দল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগেই। রাজ্যের বাইরে রাজনীতির শরিক হতে ঘোর অনীহা নবীন পট্টনায়কের। তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে এআইএডিএমকের নোঙর বরাবর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ডিএমকের বিরোধী শিবিরে। এখন তারা বিজেপির ঘর করছে। উত্তর প্রদেশে সমাজবাদী পার্টি কোণঠাসা। বিরোধী জোটে শামিল হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু অদ্ভুত দোলাচলে তৃণমূল কংগ্রেস ও আম আদমি পার্টি। বিজেপিবিরোধিতা নিয়ে এ দুই দল নিজেদের প্রশ্নের ঊর্ধ্বে তুলতে ব্যর্থ। রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের ভূমিকা সেই সন্দেহ বাড়িয়ে দিয়েছে। বিজেপিবিরোধিতার কথা মুখে বললেও এ দুই দলের কংগ্রেস বিরোধিতা গোয়া, উত্তরাখন্ড, হরিয়ানা, মণিপুর, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরার নির্বাচনে বিজেপির সহায়ক হয়েছে। বিজেপির আধিপত্য ও কর্তৃত্ববাদের কাছে নিঃশর্ত সমর্পণের মাধ্যমে ঝঞ্ঝাট এড়ানো নাকি বিরোধিতার মাত্রা চড়িয়ে জোটবদ্ধ হওয়া, এ দুই কঠিন পছন্দের মধ্যে বিরোধীদের যেকোনো একটি বেছে নেওয়ার মধ্যেই ঝুলে রয়েছে ভারতীয় রাজনীতির ভাগ্য। নীতীশের বিজেপি ত্যাগ সেই ভাগ্য নির্ধারণে কতটা নির্ণায়ক হতে পারে, এখন থেকেই শুরু হয়েছে সে জল্পনা।
নীতীশ কি ইউপিএ জোটে যোগ দেবেন? কংগ্রেসও কি শারদ পাওয়ার বা নীতীশের মতো কাউকে জোটের নেতৃত্ব তুলে দেওয়ার মতো ঔদার্য দেখাতে পারবে? এ দুই সম্ভাবনা বাস্তব হলে কংগ্রেসের আধিপত্য মানতে যারা নারাজ, তাদের কাছে টানা সহজ হতে পারে। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে এখন থেকেই এসব ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’র বহর বাড়তে শুরু করেছে। এ বছরের শেষে গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশের ভোট। সামনের বছর ভোট মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, ত্রিপুরা, তেলেঙ্গানা, মিজোরাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড ও কর্ণাটকে। এসব ভোটের ফলাফলের ওপর বিরোধী ঐক্যও অনেকাংশে নির্ভরশীল। কারণ, ছয় বড় রাজ্যে বিজেপির সরাসরি মোকাবিলা কংগ্রেসের সঙ্গে। সবচেয়ে বড় ‘যদি’, লোকসভা ভোট পর্যন্ত বিহারের এ জোট অটুট ও মসৃণ থাকবে কি না। যদি থাকে, তাহলে বিজেপির ভ্রু কুঞ্চনের যথেষ্ট কারণ আছে। লালু ও নীতীশের একজোট হওয়ার পাশাপাশি কংগ্রেস ও বামপন্থীদের সাহচর্য ভোটের পাটিগণিতে বিজেপিকে নিঃসন্দেহে পেছনে ফেলবে। কিন্তু রসায়ন? প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির আকর্ষণ গত দুই লোকসভা নির্বাচনে অপ্রতিরোধ্য ছিল। তৃতীয়বারও সেই ম্যাজিক অটুট থাকবে কি? রসায়ন ঠিক থাকলে পাটিগণিত রসাতলে যেতে পারে। গতবার মোদির রসায়নের সঙ্গে নীতীশ ও রামবিলাস পাসোয়ানের পাটিগণিত বিহারের ৪০টি লোকসভার আসনের ৩৯টি বিজেপিকে দিয়েছিল। একটি মাত্র আসন পেয়েছিল কংগ্রেস।(সমাপ্ত...)
সৌজন্যে: প্র. আ.
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct