তার নাম ‘আলতাফ’, জলপাইগুড়ি জেলার কোনও এক গ্রামে। সে একাই রেল লাইনের ধারে একটা ঝুপড়িতে রাতে থাকে আর সারা দিন ফেরি করে বেড়ায়। এখানে তার নিজের আত্মীয় কেউ নেই, এমনকি নিজের গ্রামেরও কেউ থাকে না। সংখ্যায় কম হলেও আমার মতো কিছু অমানুষ পুলিশ আছি, যারা এই জাতীয় অসহায় মানুষ পেলে থানায় ফিরে, একটা কেস দিয়ে ছেলেটিকে কোর্টে চালান করলাম। বিচারাধীন বন্দি হিসাবে কোর্ট তাকে জেলে পাঠাল। সত্য ঘটনা, নাম কাল্পনিক হলেও তা নিয়ে লিখেছেন সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কোনও এক রেস্টূরেন্টে বসে, দুই বৃদ্ধ চা আর টোস্ট খেতে খেতে নিজেদের মধ্যে গল্প করছিলেন। একজন নিজের বুকের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলছিলেন, একটা সময় ছিল, যখন এই পুলিশ অফিসার শচীন ঘোষ নাম শুনে লোকে ভয়ে কাঁপত ,আর আজ পাশের বাড়ির লোক তুচ্ছ কারণে তাঁকে শাঁসিয়ে যায়,ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস? বুঝতে পারলাম যে, ওই বৃদ্ধের নাম শচীন ঘোষ এবং তিনি অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার। একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে শচীনবাবু আবার শুরু করলেন, ভালো কাজ দেখাতে আর নিজের চাকরির রেকর্ড ভালো করার জন্য কত যে পাপ কাজ করেছি ,ভাবলে নিজের প্রতি নিজের ধিক্কার এসে যায়। তখন কলকাতার কাছের কোনও এক থানার আমি বড়বাবু। একবার একটা খুন হবার খবর পেয়ে, আরও তিনজন পুলিশ স্টাফকে নিয়ে সাথে সাথে স্পটে ছুটলাম। শুনলাম, কিছুটা আগেই মার্ডারটা হয়েছে। দেখলাম, লাশ পড়ে আছে, তাকে ঘিরে বহু মানুষের ভিড়। তাদের নানা কয়ারি (প্রশ্ন) করতে লাগলাম, তারাও যথাসাধ্য উত্তর দিতে লাগল। স্থানীয় লোকের কাছ থেকে ৩-৪ টে চেয়ার চেয়ে নিয়ে, সেগুলোতে বসে আমার সাথে থাকা পুলিশরা সেইসব স্টেটমেন্টগুলো লিখতে থাকল। শুধু খুন হওয়া লোকটার দিকে আঙুল দেখিয়ে একজন ২৫–২৬ বছরের যুবককে যখন প্রশ্ন করলাম যে, তুই কতদিন এই লোকটাকে চিনিস, তখন সে বলল, ’স্যার,আমার বাড়ি এখানে নয়,আমি কিছুই বলতে পারব না’। এবারে তাকে ঝাঁঝিয়ে বলে উঠলাম ‘তাহলে হারামজাদা,এখানে দাঁড়িয়েছিস কেন, কি করিস তুই ’? ছেলেটা বলল,’স্যার আমি সামান্য ফেরিওয়ালা,ভিড় দেখে দাঁড়িয়েছি’। ছেলেটাকে দেখতে ছিল একটু বোকা, বোকা।ওর একটা হাত খপাৎ করে চেপে ধরে নিয়ে,ওকে বললাম, কিছু কথা আছে,গাড়িতে চল।প্রথমে সে যেতে চাইছিল না, পরে ‘তোর কোনও ভয় নেই, শুধু দু-একটা প্রশ্ন তোকে করব’,বলে এক প্রকার জোর করেই তাকে নিয়ে গাড়ির দিকে যেতে থাকলাম।ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা কথা কানে এল, ‘আসল লোককেই পাকড়াও করেছে রে, ইয়াসিন’। আরেকজন বলল, ‘এই হচ্ছেন দারোগা শচীন ঘোষ, নিজে স্পটে এলে একটা হিল্লে হবেই’। লোকটাকে নিয়ে গাড়িতে ওঠালাম। একজন পুলিশ স্টাফকে ডেকে নিয়ে, গাড়িতে বসে লোকটাকে পাহারা দিতে বললাম, যেন পালিয়ে না যায়।আবার ডেড- বডির কাছে ফিরে গিয়ে ওখানকার কাজ মিটিয়ে, ওখানে থাকা আর দুজন পুলিশ স্টাফকে নিয়ে গাড়িতে ফিরে গিয়ে,গাড়ি ছাড়তে বললাম। চলন্ত গাড়িতে ছেলেটাকে নানা প্রশ্ন করতে থাকলাম। শুনলাম, তার নাম ‘আলতাফ’, বাড়ি ওখান থেকে বহু দূরে, জলপাইগুড়ি জেলার কোনও এক গ্রামে। এখানে সে একাই রেল লাইনের ধারে একটা ঝুপড়িতে রাতে থাকে আর সারা দিন ফেরি করে বেড়ায়। এখানে তার নিজের আত্মীয় কেউ নেই এমনকি নিজের গ্রাম এবং আশেপাশের গ্রামেরও কেউ থাকে না। সংখ্যায় কম হলেও আমার মত কিছু অমানুষ পুলিশ আছি, যারা এই জাতীয় অসহায় মানুষ পেলে, তাকে মুরগি বানাবার চেষ্টা করি। থানায় ফিরে,একটা কেস দিয়ে ছেলেটিকে কোর্টে চালান করলাম। বিচারাধীন বন্দি হিসাবে কোর্ট তাকে জেলে পাঠাল।
এসব ক্ষেত্রে জেলে যাওয়া বন্দির বাড়ির লোকেরা এসে উকিল ধরে তার জামিনের চেষ্টা করে, তাকে বাঁচাবার জন্য মামলা লড়ে।কিন্তু যার নিজের লোক বলতে কেউ নেই বা থাকলেও বহু দূরে থাকায় কোনওভাবে খবর পায়নি,তার কি হয় ?উপযুক্ত জায়গায় খবর না যাওয়ায়,বিচারাধীন বন্দি হয়েই দিনের পর দিন তাকে জেলে পচতে হয়।শুনেছি, এই ছেলেটির ক্ষেত্রেও নাকি সেটাই হয়েছিল।এইটুকু শোনার পর স্তব্ধ হয়ে গেলাম।পুলিশ ভদ্রলোককে কিছু প্রশ্ন করব ভেবেছিলাম কিন্তু তা’ আর পারিনি। তবে শচীন ঘোষই পুলিশ সমাজের একমাত্র আইকন নন, বহু মানবিক পুলিস অফিসার এবং সাধারণ পুলিশ কর্মী আছেন,যাঁদের মানবিক কাজের একাধিক ছবি আমরা সংবাদপত্রে দেখতে পাই। আর অভাগা আলতাফের মত অবিচারের বলি শুধু বাংলাতেই ন্য়,দেশের বহু জায়গাতেই হয়,সংবাদপত্রে যার বহু দৃষ্টান্ত মাঝে মাঝে চোখে পড়ে।যাঁরা তর্কবাগীশ কিন্তু আইন, আদালতের বিশদ খবর রাখেন না তাঁরা বলেন বিনা দোষে একটা মানুষ কিভাবে জেলে থাকবে? ওপরের ঘটনাটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, তাঁদের এই ধারণা কত ভুল?একাধিক বার খবর কাগজের পাতায় দেখা গিয়েছে, এত বছর জেলে থাকার পর আদালতের নির্দেশে বেকসুর খালাস।কিন্তু কেন এমন হবে ? এই পৃথিবীতে তো সবাই স্বাধীনভাবে খোলামেলা পরিবেশে বাঁচতে এসেছে কিন্তু তা’ স্বত্বেও বিনা দোষে কিছু মানুষের মুক্ত জীবনকে কেন কেড়ে নেওয়া হবে ?
লেখক বিশিষ্ট লেখক ও প্রাবন্ধিক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct