ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ একটি বহু আলোচিত ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহ, বেশির ভাগ আলোচনা বা বর্ণনা পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকদের কলমে এবং তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিতেই লেখা। ইউসুফ সালাদিন আয়ুবীকে ক্রুসেডের মহানায়ক হিসেবে তুলে ধরেছেন আরবীয় লেখক আমিন মালাউফ। তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বাংলা তরজমা করেছেন পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের প্রাক্তন সচিব আব্দুস শুকুর। আজ ষষ্ঠ পর্ব।
তরোয়ালের দ্বারাই জেরুজালেম দখল করতে হবে সুলতান তাই ঠিক করলেন,সিরিয়ার চারি দিকে ছড়িয়ে থাকা বাহিনীকে হুকুম দিলেন পবিত্র নগরীর আশে পাশে জড় হতে, সব আমিররা ছুটে এলেন, আবিচারের দিন মুসলিমরা আল্লাহের কাছে কি জবাব দেবে যদি এটুকু না করে,বা বলতে পার আমি জেরুজালেমের জন্য শহীদ হয়েছি। কথিত আছে একবার একজ্যোতিষী নাকি বলেছিলেন, এই শহরে প্রবেশ করলে সালাদিনের এক চোখ অন্ধ হয়ে যাবে, জবাবে সালাদিন বলেছিলেন জেরুজালেম দখল করার জন্য আমি দুটি চোখ ই বিসর্জন দিতে রাজি আছি। অবরুদ্ধ শহরের মধ্যে এদিকে প্রতিরোধের দায়িত্বে রামলার শাসক ইবিলিনের বালিয়ান, একজন লর্ড ইবনে আল আথির যা বুঝিয়েছেন, ফরাসীদের রাজার মতই মর্যাদা তার বাহিনীর পরাজয়ের পর তিনি হিটিন থেকে টায়ারে আশ্রয় নিয়েছিলেন এই গ্রীষ্মে তিনি জেরুজালেম থেকে তার স্ত্রীকে আনার অনুমতি নিয়েছিলেন,এবং কথা দিয়েছিলেন যে তিনি অস্ত্র বহন করবেন না এবং এক রাতের বেশী জেরুজালেমে থাকবেন না। কিন্তু সেখানে পৌঁছবার পর সাধারন মানুষ তাঁকে থেক যাবার জন্য খুব অনুরোধ করে,কারন তিনি ছাড়া তেমন নির্ভরযোগ্য আর কেউ ছিলনা, বৈলান কথা রাখার মত সম্মানীয় ব্যক্তি ছিলেন, বুঝলেন সুলতানকে দেওয়া কথা খেলাপ করে, জেরুজালেম রক্ষার কাজে অংশ নেওয়া ঠিক হবেনা, তিনি সরাসরি সালাদিনের কাছেই পরামর্শ চাইলেন। মহান উদার সুলতান,শপথ থেকে তাকে মুক্তি দিলেন, যদি তার কর্তব্যের দাবী চায় তাঁকে সেখানে থাকতে হবে ও অস্ত্র রাখতে হবে তবে তিনি তাহা করতে পারেন,এবং যেহেতু যেহেতু জেরুযালেমের প্রতিরক্ষার কাজে এত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন , সুলতান তাঁর স্ত্রীর সঙ্গী দিয়ে নিরাপদে টায়ারে আসার ব্যবস্থা করে দিলেন। সালাদিন কখনও কোনও সম্মানীয় লোকের অনুরোধ, তাঁর ভয়ানক শত্রু হলেও, উপেক্ষা করতেন না,এই ক্ষেত্রে অবশ্য ঝক্কি ছিল খুবই কম, বৈলানের সাহসিকতা সত্বেও মুসলিম বাহিনীকে আটকাবার ক্ষমতা তার ছিলনা, যদিও প্রতিরক্ষা পরিকাঠামো মজবুত ছিল এবং ফরাসীরা রাজধানীর প্রতি খুবই অনুগত ছিল, কিন্তু অবরোধ সীমাবদ্ধ ছিল মাত্র কয়েকজন নাইট ও শহরের অধিবাসী যাদের তেমন কোন সামরিক অভিজ্ঞতা ছিলনা। এছাড়াও মৌলবাদী জ্যকোবাইট, প্রাচ্য জেরুজালেমের খ্রীষ্টানরা সালাদিনের পক্ষে ছিল, বিশেষ করে পুরোহিতরা কারন ল্যাটিন উপরওয়ালারা বহুদিন তাঁদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে আসছিল। সুলতানের প্রধান উপদেষ্টাদের একজন ছিলেনন ইউসুফ বাতিত নামে এক গোঁড়া (orthodox) পাদরী, সেই ফরাসীদের ও প্রাচ্য খ্রীষ্টানদের সাথে যোগাযোগের দায়িত্বে ছিল। যখন অবরোধ শুরু হয় তখন পাদরীরা বাতিতকে কথা দিয়েছিল যদি পশ্চিমারা বেশী ক্ষন দ্বার আটকে রাখে তবে তার গোপন দ্বার খুলে দেবে। যা ঘটল ফরাসীরাা জোরালো সাহসী প্রতিরোধ করল কিন্তু বেশীক্ষন টিকলনা, কয়েকটি ধাঁধা দিয়ে তা শেষ হল। ২০শে সেপ্টেম্বর জেরুজালেমকে ঘেরাও করা শুরুহল,৬দিন পর সালাদিন যার শিবির ছিল ওলিস পর্বতের উপর তার সৈন্যদের চুড়ান্ত আক্রমনের জন্য চাপ বাড়াতে বললেন।২৯শে সেপ্টেম্বর কারিগররা দেওয়ালের উত্তর দিকে একটি ফাটল সৃষ্টি করতে পারল, পশ্চিমারা ১০৯৯ সনে যেখানে ভাঙ্গন ধরাতে পেরেছিলছিল বালাদিন যখন বুঝল প্রতিরোধে ফল হবেনা তখন সুলতানের কাছে ধরা দিলেন ও নিরাপদে বেরিয়ে যাবার আবেদন করলেন।সালাদিন অনমনীয় রইলেন, তিনি আগেই যেসব শহর অধিকারের যে সব শর্ত অধিবাসীদের দিয়েছিলেন সেগুলি অগ্রাহ্য হওয়ায়,এখন আলোচনার সময় নয়,সুলতান এখন তরোয়ালের সাহায্যেই,নগরের দখল নিতে চাইলেন,ঠিক যেমন ফরাসীরা আগে করেছিল,সুলতানের এই প্রতিজ্ঞা থেকে সরানো সম্ভব যদি কেবল ফরাসীরা দ্বার খুলে দেয় ও নিঃশর্ত আত্মসমর্পন করে।
ইবনে আল আথির লিখেছেন,বালাতিন সালাদিনের কাছে প্রানরক্ষার প্রতিশ্রুতি চাইলেন, সালাদিন কোন কথা দিলেন না বালিয়ান সুলতানের হৃদয় নরম করতে চাইলেন কিন্তু সফল হলেন না, তখন সুলতানকে এভাবে বললেন,’হে সুলতান, এই শহরে কত লোক আছে ঈশ্বরই একমাত্র জানেন, তারা এখন যুদ্ধে ইতস্ততঃ করছে কারন তারা জানে আপনি তাদের হত্যা করবেন না,এর আগে যেমন বহু মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, তারা বাঁচতে চায়, মৃত্যুকে ঘৃনা করে,কিন্তু যদি দেখি যুদ্ধ অবশম্ভাবী হয় তবে আমাদের নারী শিশুদের সব হত্যা করবো, আপনার জন্য এক দিনার বা এক শিশু বা মেয়ে যুদ্ধাবশেষ থাকবেনা,তারপর আল আকসা মসজিদ ও বহু মুসলিম স্থান ধ্বংশ করব,আমরা ৫ হাজার মুসলিম বন্দী রেখেছি তাদেরকে হত্যা করব,সমস্ত অশ্ব সহ সব জীব জন্তু ধ্বংশ করব, সবশেষে আমরা শহরের বাইরে এসে মরণপন যুদ্ধে আপনার বহু সৈন্য হত্যা করে তারপর মরব।‘ যদিও সুলতান এই ভীতি প্রদর্শনে প্রভাবিত হন নাই, তিনি তাঁর অতি উৎসাহে এ বিচলিত হলেন, তবুও নরম না হবার ভাব দেখালেন, এবং তাঁর নিজের আমাত্যদের কাছে শপথের ছাড় চাইলেন, যাতে তিনি অস্ত্রের দ্বারা জেরুজালেম উদ্ধারের শপথ করেছিলেন—যাহাতে ইসলামের পবিত্র স্থানগুলি রক্ষা পায়। তাঁর সহচরদের দৃষ্টিভঙ্গী ইতিবাচকই ছিল,তাঁরা সুলতানের উদারতা জানতেন, তারা জোর দিলেন যাতে ফরাসীরা শহর ত্যাগ করার অনুমতির আগে যুদ্ধের ক্ষতিপুরণ দেয়। কারণ এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগার ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। উপদেষ্টারা বাঝালো বিরোধীরা বাস্তবে এখন যুদ্ধবন্দী মুক্তিপণ হিসেবে ১০ ডিনার নারী ৫ দিনার ও শিশুর জন্য ১দিনার হিসেবে, বালিয়ান নীতিগত ভাবে প্রস্তাব মেনে নিয়ে গরীবদের জন্য কিছু ছাড় চাইল, বললেন তারা এত বেশী দিতে পারবেনা,এরকম ৭ হাজারের জন্য ৩০হাাজার দিনার বলা হল, এবারও অনুমোদন দেওয়া হল যদিও খাজাঞ্চীর কর্মচারীদের কিছু আপত্তি ছিল।
তাই ১১৮৭ সনের ২রা অক্টোবর,৫৮৩ হিজরীর ২৭শে রজব যেদিন নবী(সঃ) এর জেরুজালেম হয়ে মহা যাত্রা শবেকদরও ছিল আমির ও সৈন্যদের উপর কড়া হুকুম ছিল যেন কোন খ্রীষ্টান ফরাসী বা দেশীয় এর গায়ে হাত না দেওয়া হয়। এবং প্রকৃত পক্ষে খুন জখম বা লুটপাট কিছুই হয়নি, শুধু কিছু চরম মেজাজের লোক পবিত্র গোল চার্চ(Church of the Holy Sepulchare) কে ধ্বংশ করতে চেয়েছিল ফরাসীদের অতিরিক্ত হিংসা পবিত্র শহর দখলের সময় দেখেছিল, তারই বদলা হিসেবে,সালাদিন তাদেরকেও চুপ করিয়ে দিলেন।বরং উল্টোদিকে খ্রীষ্টান ধর্মস্থান গুলির পাহারা বাড়িয়ে দিলেন ও ঘোষনা করে দিলেন ফরাসীরা যখন ইচ্ছা তীর্থ করতে আসতে পারবেন। অবশ্য ডোম অফ দি রক মসজিদে যে ক্রশ চিহ্ন লাগানো ছিল তাহা সরানো হোল, আল আকস মসজিদকে চার্চ বানানো হয়েছিল তাহাকে আবার মসজিদ করা হল দেওয়ালগুলি গোলাপ জলে ধুয়ে আবার নামাজ শুরু হলো।অধিকাংশ ফরাসী শহরে থেকে গেলেন,সালাদিন বহু সঙ্গীসহ দরগা থেকে দরগায় গিয়ে কান্না প্রার্থনা ও সিজদার মধ্যে সময় কাটাতে লাগলেন,ধনীরা দেশ ছেড়ে যাবার আগে তাদের বাড়ী, আসবাব ও ব্যবসাপত্র বেচে দিতে লাগলেন,ক্রেতা সাধারনতঃ orthodox অথবা Jacobite খ্রীষ্টান যারা থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন,পরে অনেক সম্পত্তি ধনী ইহদীদের মধ্যেও বিক্রি হচ্ছিল, তারা সালাদিনের নগরে থেকে গেল। বালিয়ানের কি হল , গরীব লোকদের মুক্ত করার জন্য যে ফান্ড দরকার সে তাহা যোগাড়ের চেষ্টা করতে লাগল,কয়েক হাজার দিনার কয়েক দিনার কয়েকশ বা কয়েক হাজার নানাভাবে চেষ্টা হল কেও কেও গেটে ভিক্ষাও করল। সুলতানের ভাই আল আদিল সুলতানের মতই দরদীী ছিলেন, ক্ষতিপুরন ছাড়াই ১হাজার ১ হাজার গরীব কয়েদীর মুক্তির জন্য আবেদন করেন, যখন ফরাসী প্রধান(Patriaarch) ইহা শুনলেন তখন তিনিও এরকম ভাবে ৭০০ জনের মুক্তি প্র্রার্থনা করলেন, এবং বালীয়ান আরও ৫০০ জনের, সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হল। তারপর সুলতান নিজের উদৌগে সমস্ত বৃদ্ধকে ও শিশু কোলে মহলাদের মুক্তি দিলেন। যখনন ফরাসী বিধবা ও অনাথদের কথা উঠল, সুলতান শধু ক্ষতিপুরন ছাড়া মুক্তি দিলেন তাই নয়, যাবার আগে কাউকে কাঊকে যৌতুকও দিলেন। সুলতানের খাজাঞ্চীর কর্মচারীরা হতাশ হলেন, তারা বলতে চাইলেন, ‘গরীবদের না হয় ছেড়ে দিন কিন্তু সামর্থ্যদের টা অন্ততঃ আদায় করুন। সরকারের এই সুযোগ্য কর্মচারীদের ক্রোধ বাধা মানলনা যখন জেরুযালেমের Patriaarch শহর ত্যাগ করল,কয়েক গাড়ী বোঝাই মূল্যবান সামগ্রী যেমন স্বর্ণ দামী কার্পেট ও আরও দামী জিনিষপত্র ইত্যাদি। ইমাদ আল দিন আসফাহামি এ সব তথ্য ফাঁস করলেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct