জনগণের চাপে পড়ে রাজ্য সরকারগুলি হত-দরিদ্র মানুষকে, গ্রামকে ও কৃষককে সস্তায় বিদ্যুৎ দিতে বাধ্য হয়। রাজ্য সরকারের বিদ্যুৎ বোর্ড, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সেটা জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। এই পুরো ঘটনাগুলো রাজ্য সরকারগুলির নির্দেশে ঘটে। গ্রাম হোক শহর, গরিব হোক বা কোটিপতি, কৃষক হোক বা সরকারি চাকরিজীবী মানুষ; সকলকে সমানভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সরকারের বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে। তাই ‘বিদ্যুৎ (সংশোধনী) আইন ২০২২’ নিয়ে লিখেছেন যোগেন্দ্র যাদব। আজ প্রথম কিস্তি।
বেশ কিছু দিন আগে আমার এক বন্ধু পোস্ট অফিসে পোস্টকার্ড নিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের কাছে কোনও পোস্টকার্ড ছিল না। অন্তর্দেশীয় চিঠিও স্টকে ছিল না। তাদের হাত-পা বাঁধা, “স্যার এখন তো সমস্ত কাজ ক্যুরিয়ার কোম্পানির”। এ বড়ো করুণ সত্য। ডাক অফিস আজ জীবন্ত ইতিহাসের টুকরো ছাড়া আর কিছুই না। যেমন সরকারের বিএসএনএল প্রায় বন্ধের মুখে। যেমন সরকারি স্কুল আর সরকারি হাসপাতাল এখন দুঃস্থ পরিবারগুলোকে পড়াচ্ছে আর ওষুধের ভাঁওতাবাজি দিয়ে বেড়াচ্ছে। যদি সরকারের মর্জি চলে, তাহলে এই একই অবস্থা এবারে দেশের বিদ্যুৎ প্রদান ব্যাবস্থার সাথেও হতে চলেছে। গত সোমবার সরকার প্রতারণা করে যে বিদ্যুৎ সংশোধন আইন ২০২২ সংসদে পেশ করেছে, সেটা যদি পাস হয়ে যায় তাহলে কৃষক এবং দুঃস্থদের মাথায় বাজ পড়বে। এই আইন যদি তৈরি হয়, তবে বিদ্যুৎও বাজারিকৃত হয়ে যাবে। যেখানে টাকা আছে, সেই জায়গা হবে ঝকঝকে-ঝিকমিকে-চকচকে। আর যেখানে কানাকড়িও নেই, সে জায়গা চির-আঁধার।
এই বিষয়টাকে চুপচাপ লোকসভায় তুলে ধরা স্পষ্ট প্রতারণা ছাড়া আর কিচ্ছু না। তেরো মাসের টানা কৃষক আন্দোলনের আরো নানান দাবির মধ্যে বিদ্যুৎ প্রদানের এই দাবি ছিল অন্যতম। কৃষকদের সেই আন্দোলন দমন করার অভিপ্রায়ে ৯ ডিসেম্বর ২০২১-এ কেন্দ্রীয় সরকার সংযুক্ত কিষাণ মোর্চাকে লেখেন, “বিদ্যুৎ বিলের কুপ্রভাব কৃষকের উপর পড়বে না। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার সাথে আলোচনার পরেই বিদ্যুৎ বিল সংসদে উপস্থাপন করা হবে।” কিন্তু, গত ন’মাসে কৃষকের সাথে কোনো আলোচনা হয়নি। এই বিষয়ের বড় স্টেকহোল্ডার, বিদ্যুৎ কর্মচারী এবং ইঞ্জিনিয়ারদের জাতীয় সমন্বয় কমিটি (NCCOEEE)-র সাথে সরকার কিছু আলোচনায় বসেন। কিন্তু এটা বলার পরেও, সংসদে এই বিলকে পেশ করা হল। তবে একটাই বাঁচোয়া, বিলটা হাতে-হাতে পাশ না করে সিলেক্ট কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে। “বিদ্যুৎ (সংশোধনী) আইন ২০২২” নামক এই বিলের আসল কাজ হল বিদ্যুৎ বিতরণকে প্রাইভেট কোম্পানির হাতে তাদের মনমাফিক শর্তের ভিত্তিতে তুলে দেওয়া। বিদ্যুৎ ব্যবসার মোট তিনটে অঙ্গ আছে: কয়লা, জল বা সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন (জেনরেশন), হাইটেন্স টাওয়ার থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ (ট্রান্সমিশন) এবং স্থানীয় বা আঞ্চলিক গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সংযোগ (ডিস্ট্রিবিউশন)। বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ২০০৩ সাল থেকেই প্রাইভেট কোম্পানি অনুমতি পেয়েছে। এখনো পর্যন্ত অর্ধেক উৎপাদন তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এদিকে সাধারণ মানুষকে বিদ্যুৎ সরবরাহে প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর একটুও আগ্রহ নেই।
অনেক বছর ধরেই বহু কোম্পানি বিদ্যুৎ বিতরণের ব্যবসায় নজরদারি করছে। ঝোপ বুঝে কোপ মারবে। কিন্তু, তাদের পথে নানান সমস্যা দানা বেঁধেছে। বিদ্যুৎ রাজ্য সরকারের অধীনে রয়েছে। জনগণের চাপে পড়ে রাজ্য সরকারগুলি হত-দরিদ্র মানুষকে, গ্রামকে ও কৃষককে সস্তায় বিদ্যুৎ দিতে বাধ্য হয়। রাজ্য সরকারের বিদ্যুৎ বোর্ড, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সেটা জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া; এই পুরো ঘটনাগুলো রাজ্য সরকারগুলির নির্দেশে ঘটে। গ্রাম হোক শহর, গরিব হোক বা কোটিপতি, কৃষক হোক বা সরকারি চাকরিজীবী মানুষ; সকলকে সমানভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সরকারের বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে। প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর চাই বিদ্যুৎকেন্দ্রে নির্ঝঞ্ঝাট ব্যবসা। প্রস্তাবিত আইনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার বিদ্যুৎ বিতরণে প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর প্রবেশের পথ পরিষ্কার করছে। এবারে সরকারি বিদ্যুৎ বোর্ডের জন্য এটা বাধ্যতামূলক করতে হবে, যে দামে আপনার ঘরে বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়, সরকার প্রাইভেট কোম্পানিকে সেই একই দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে। কোম্পানিগুলোকে বিদ্যুৎ বিতরণের অনুমতিও দেওয়া হল আবার হত-দরিদ্র মানুষ, কৃষক আর গ্রামের সাধারণ মানুষকে সস্তায় প্রদানের হাত থেকে মুক্তিও পাওয়া গেল। রাজ্য সরকারের ওপর শর্ত চাপাবে, যদি সস্তা বিদ্যুৎ দিতে চায়, তার জন্য আলাদা ফান্ড তৈরি করে গ্যারান্টি দিতে হবে। রাজ্য সরকার যাতে জনগণের চাপের মুখে না পড়ে, তাই নিয়ম তৈরি করার কাজ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিদের করতে হবে।
লেখক ‘স্বরাজ ইন্ডিয়া’র প্রতিষ্ঠাতা।
অনুবাদ: প্রতীক্ষা ঘোষ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct