স্বাধীনতার প্রাপ্তির ৭৫ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে প্রধানমন্ত্রীর মুখে দেশের সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিয়ে কোনও আশ্বাস না থাকলেও ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিন্তু সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিলেন ইংরেজরা যাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল সেই দায়িত্ব পাওয়া ‘ভারতীয় ডোনিয়নের গণ-পরিষদ’-এর সভাপতি ডা. রাজেন্দ্রপ্রসাদ। সেই ইতিহাস রোমন্থন করেছেন জাইদুল হক।
ভারতের স্বাধীনতার প্রাপ্তির ৭৫ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশবাসীকে এই ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’ উৎসবে শামিল হয়ে হর ঘর তেরঙ্গা পতাকা উড্ডয়নের আহ্বান জানিয়েছেন। স্বাধীনতার এই ৭৫ বর্ষ উদযাপন মহাসমারোহে দেশজুড়ে পালিত হওয়ার আবহ বর্তমান। কিন্তু এই ৭৫ বছরে দেশের স্বাধীনতা আনার পিছনে যাদের সম্মিলিত অবদান তাদের নিয়ে আলোচনা অনেকটাই স্তিমিত। এর মূলে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের গান্ধি পরিবারের চরম বিরোধিতা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পশ্চাদে নেহরু পরিবারকে কোনওভাবেই মান্যতা দিতে চান না প্রধানমন্ত্রী। এমনকী প্রধানমন্ত্রীর মুখে দেশের হিন্দু-মুসলিম যে সম্মিলিতভাবে স্বাধীনতা এনেছেন সে কথা ঘুণাক্ষরে শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর স্বাধীনতা সংগ্রামে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অগ্রণী ভূমিকা নেওয়া ব্যক্তিত্বকে এখনও স্মরণ করার সময়। কিন্তু সেই আবহ এখন নেই। দুই সম্প্রদায়ের সম্মিলিত শক্তিই যে দেশের স্বাধীনতা এনেছে তা কোনওভাবেই স্বীকার করতে চায় না বিজেপি সরকার। বিশেষ করে, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিমরাও যে অংশ নিয়েছিলেন সে কথা দেশের মানুষকে বিস্মৃতির অতলে রাখা হয়েছে। অথচ, আজ থেকে ৭৫ বছর আগে পরিস্থিতি ছিল আলাদা। তখন যে কি পরিস্থিতি বিরাজ করছিল তা তৎকালীন সমযের সংবাদপত্রগুলিতে চোখ বোলালেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। বিশেষ করে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাংলা দৈনিক পত্রিকাগুলি স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময় তোরা যে ভূমিকা নিয়েছিল তা উল্লেখ করা প্রয়োজন।
স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষ পূর্তির সময় আমরা একটু খতিয়ে দেখতে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক বাংলা সংবাদত্রগুলিতে ঠিক কি সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছিল তাতে নজর দেওয়া যেতে পারে। স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশেষ সহযোগিতার জন্র তৎকাীলন সময়ে বাংলা দৈনিক ‘যুগান্তর’ ও ইংরেজি দেনিক ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’র বিশেষ অবদান আছে। আর্কাইভ থেকে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট প্রকাশিত যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত স্বাধীনতা অর্জনের নানা খবর বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, এখন কিন্তু সেই সময়ের মতো পরিবেশ আর নেই। এখন আর রাষ্ট্রনেতাদের মুখে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার কথা শোনা যায় না। দেশের সংখ্যালঘুদের উপর কোনও অত্যাচার হলে একেবারে মুখ কুলুপ এঁটে থাকেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। গো রক্ষকদের হাতে পিটিয়ে হত্যা কিংবা সাম্প্রদয়িকতার রোষানলে পড়ে ধর্মীয় স্থানের অধিকার হরনের বিষয়টি তাদের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে রয়েছে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর এই পাওনা প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। অবশ্য, স্বাধীনতার সময়ে দেশের রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে শীর্ষ দেশনায়কদের কাছে সংখ্যালঘুরা ব্রাত্য ছিল না। তারা কিন্তু বরাবরই প্রাধান্য পেয়ে এসেছে। এ বিষয়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট প্রকাশিত যুগান্তর পত্রিকার উপর নজর রাখলে বোঝা যাবে সেই সময় সংখ্যালঘুুদের কিন্তু বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হত।
যুগান্তর (১৫ আগস্ট, ১৯৪৭)
যুগান্তর পত্রিকা সেদিন শিরোনাম করেছিল ‘ভারতের শৃঙ্খলুমক্তি’। আর শীর্ষ ছবিটি ছিল জাতির জনক মহাত্মা গান্ধির। গান্ধিজির ছবির নীচে খবরের শিরোনাম ছিল ‘গণ-পরিষদ কর্ত্তৃক ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা’। এই শিরোনামের নীচে আরও একটি সাব হেডিং নজর কেড়েছিল। তাতে লেকা ছিল: ‘পণ্ডিত নেহরু কর্ত্তৃক সদস্যদের সঙ্কলপবাক্য উত্থাপনঃ সংখ্যালঘুদের প্রতি ডাঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদের আশ্বাসদান’। খবরের শুরুতে লেখা হয়: ‘নয়াদিল্লী, ১৫ই আগষ্ট— অদ্য ভারতীয় ডোমিনিয়নের গণ-পরিষদ ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়াছে। ভারতীয় স্টান্ডার্ড টাইম এগারটার পর ভারতীয় ডোমিনিয়ানের গণ-পরিষদ ভবনে ক্ষমতা হস্তান্তর অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়। দুইশত বৎসরের পরাধীনতার বন্ধন মুক্তির এই অনুষ্ঠানে গ্যালারীতে তিলমাত্র স্থান ধারণের উপায় ছিল না। ক্ষমতা হস্তান্তর অনুষ্ঠান কোরাল ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীত দ্বারা আরম্ভ হয়।’ ওই সংবাদের মধ্যেই ডা. রাজেন্দ্রপ্রসাদের বক্তৃতা তুলে ধরা হয়। এ নিযে যুগান্তর পত্রিকায় ;ডা. রাজেন্দ্রপ্রসাদের বক্তৃতা’ শিরোনামে সংবাদে সেদিন লেখা হয়: ‘অদ্য রাতে শামন ক্ষমতা হস্তান্তর উপলক্ষে অনুষ্ঠিত গণ-পরিষদের ঐতিহাসিক দিবেশনে সবাপতি ডাঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ তাঁহার বক্তৃতায় বলেন যে, ভারতে সংখ্যালঘুরা সম্পূর্ণ ন্যায় বিচার পাইবে, তাহাদের সম্পর্কে কোনওপ্রকার পক্ষপাতিত্ব করা হইবে না।’ যুগান্তরের প্রথম পাতার একেবারে বাম দিকে লেখা রযেছে যার শিরোনাম হল: ভারতের নূতন মন্ত্রিসভা’। তার নীচে সাব হেডিং-এ লেখা: ‘সদস্যদের নাম ঘোষণা।’ এর পর খবরে নয়া মন্ত্রিসভার নাম লেখা হয়: ‘সদস্যদের নাম পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ; সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল— স্বরাষ্ট্র ও প্রচার বিভাগ; ডা. রাজেন্দ্রপ্রসাদ—খাদ্য ও কৃষি; মৌলানা আবুল কালাম আজাদ— শিক্ষা, ডা. জন মাথাই—রেলওয়ে; সর্দার বলদেব সিং— দেশরক্ষা; শ্রী জগজীবন রাম— শ্রম; মি. সি এইচ ভাবা— বাণিজ্য; বি. রফি আহমেদ কিদোয়াই— যোগাযোগ; রাজকুমারী অমৃত কাউর স্বাস্থ্য; শ্রীযুক্ত আর কে সম্মুগম চেট্টি— অর্থ; ডা. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি— শিল্প ও সরবরাহ; মি. এন ভি গ্যাডগিল— পূর্ত্ত’।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct