ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ একটি বহু আলোচিত ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহ, বেশির ভাগ আলোচনা বা বর্ণনা পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকদের কলমে এবং তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিতেই লেখা। ইউসুফ সালাদিন আয়ুবীকে ক্রুসেডের মহানায়ক হিসেবে তুলে ধরেছেন আরবীয় লেখক আমিন মালাউফ। তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বাংলা তরজমা করেছেন পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের প্রাক্তন সচিব আব্দুস শুকুর। আজ পঞ্চম পর্ব।
আল আথির লিখেছেন,ফরাসীরা ধরা পড়ার মুখে তখন মুসলিমরা সামনের ঘাসে আগুন ধরিয়ে দিল,তপ্ত বাতাস,ধোঁয়া নাইটদের দিকে ছুটতে লাগল, পিপাসা আগুন ধোঁয়ার মধ্যেও যুদ্ধের ভয়ানক তেজে এক এক বার মনে হতে লাগল নাইটরা বুঝি মুসলিমদের উপর আধিপত্য করবে কিন্তু পারল না, মুসলিমরা খ্রীষ্টানদদের বিজয়ের চিহ্ন হোলি ক্রস দখল করে ফেলল,ফরাসীদের জন্য ছিল ইহাই সব থেকে বড় পরাজয়, কারন তাদের দাবী এখানেই মেসিয়া(জসাস) ক্রুস বিদ্ধ হয়েছিলেন। ইসলাম মতে মেসিয়া বা যীশু খ্রীষ্টের ক্রুসবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা বাহ্যিক মাত্র,যাই হোক, এতসব লোকসান সত্বেও হিত্তিন গ্রামের আশেপাশে অনধিক দেড়শতাধিক নাইট শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়েছিল কিন্তু মুসলিমরা চারদিক থেকে ঘিরে রাজার তাবু ছাড়া সব তাবু উড়িয়ে দিয়েছিল, সালাদিনের ১৭ বছরের পুত্র আল মালিক আল আফজাল বলেছেন,’ হিত্তিনের যুদ্ধের সময় আমি আব্বার পাশে ছিলাম, আমি প্রথম যা দেখলাম, যখন ফরাসীদের রাজা পাহাড়ের উপর থেকে প্রবল আক্রমনে করে আমাদের সেনাদের পিছিয়ে আমার আব্বার কাছে নিয়ে এল,আমি দেখলাম তিনি বিমর্ষ হলেন,ভ্রু কুঞ্চিত করে দাড়িতে হাত বোলালেন, সয়তান ধ্বংশ হোক বলে অগ্রসর হলেন,পাহাড়ের দিকে জোর আক্রমন করলেন, দেখলাম, আমাদের সেনাদের আক্রমনের চাপে ফরাসীরা পিছু হঠতে লাগল, আমি আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলাম,’ জয় আমাদের’ কিন্তু ফরাসীরা নুতন শক্তিতে জোর আক্রমন করল, আমাদের সৈন্যরা আব্বার পাশে আবার জড় হয়ে গেল, তিনি আবার আক্রমন করতে জোর দিলেন, ফরাসীরা পিছিয়ে পাহড়ে উঠে পড়ল। আমি আবার চীৎকার করে উঠলাম,’ তাদের হারিয়েছি, আব্বা আমার আমার দিকে ফিরে বললেন,’ চুপ, বিজয় তখন হবে যখন পাহাড়ের উপরের শিবির গুলো জয় হবে’ তখন সুলতান ঘোড়া থেকে নামলেন,মাথা নত করলেন, কাঁদতে লাগলেন জয়ের আনন্দে।
বিজয়ের কান্নার মধ্যেই সুলতান ঘোড়ায় উঠলেন,তাবুর দিকে যাত্রা করলেন, প্রধান বন্দীদের যেমন রাজা গাই ও রাজপুত্র আরনাতকে তাঁর সামনে আনা হল। সুলতানের উপদেষ্টাদের একজন, লেখক ইমাদ আল দিন আল আফসানি সেখানে হাজির ছিলেন। তিনি লিখেছেন, রাজাকে ডেকে পাশে বসালেন প্রিন্স আরনাটও পাশে বসল, সুলতান তাঁর অপকর্ম গুলির জন্য কৈফিয়ত চাইলেন,’ তুমি কতবার কথা দিয়েছ তারপর তা ভঙ্গ করেছ, কতবার কত চুক্তি সই করে একবারও মাননি, দোভাষীর মাধ্যমে জবাব দিলল, রাজরাজারা এমন করেইথাকে আমি বেশি কিছু করিনি’ এ সময় গাই পিপাসায় ছটফট করছিল,মাতালেরর মত তার মাথা ঢলে পড়ছিল মুখ আতঙ্কে চুপসে ছিল,সুলতান সাহস দিলেন,খাবার জল এনে দিলেন , রাজা পান করলেন,অবশিষ্ট আরনাতকে দিলেন, সে তৃষ্ণা মেটাল, সুলতান রাজা গাইকে বলললেন, ‘ আপনি তাকে জল দেবার আগে আমার অনুমতি নিলেন না, তাই এখন তাকে দয়া দেখাতে আমি বাধ্য থাকলামনা’ আরব প্রথা অনুসারে কাওকে পানি দিলে তাকে করুনাও করা হয়। সুলতান যাকে নিজের হাতে হত্যা করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন,তার কোন বাধা থাকলোনা,ইমাদ আল দিন আরো বলেছেন,--সুলতান হাঁসলেন তাঁর ঘোড়ায় উঠলেন,এবং কয়েদীদের আতঙ্কের মধ্যে রেখে চলে গেলেন। অন্য কয়েদীদের ফেরা তদারকি করলেন, তরোয়াল হাতে ফিরে এলেন। আরনাতকে তাঁর কাছে আনতে বললেন,অস্ত্র্র হাতে আরনাতের দিকেএগিয়ে গেলেন, ঘাড় ও কাঁধের মাঝে জোরে আঘাত করলেন, সে পড়ে গেল,মাথা কেটে ফেললেন,দেহ পায়ে করে ঠেলে রাজার কাছে নিয়ে গেলেন,রাজা কাঁপতে লাগল, সুলতান সাহস দিয়ে বললেন,’ এ লোকের দশা এর দুঃস্কর্ম ও বিশ্বাসহীনতার জন্য।
রাজা এবং অধিকাংশ বন্দীকে ছেড়ে দেওয়া হল,টেম্পলার ও হসপিটালারদের চৈলিয়নের রেনল্ডের মতই অবস্থা করা হল। এই উল্লেখযোগ্য দিন শেষ হওয়ার আগেই, সুলতান তাঁর প্রধান আমিরদেরকে জড় করলেন,ও বিজয়ের জন্য ধন্যবাদ দিলেন, বললেন যে সম্মান আক্রমন কারীরা নষ্ট করেছিল তাহা আবার পুনরাদ্ধার হল। তিন বললেন,ফরাসীদের সেনাবাহিনী বলে আর কিছু থাকলনা, আমাদের সেই সুযোগ নিয়ে অন্যায়ভাবে হারানো জমি পুনরুদ্ধার করতে হবে। পরের দিন রবিবারে তিনি টিবেরিয়াসের দূর্গ আক্রমন করলেন। যেখানে রেমন্ডের স্ত্রী ছিলেন,তিনি বুঝলেন বাধা দেওয়া বৃথা তাই আত্ম সমর্পন করলেন। সালাদিন সবাইকে অক্ষত থাকার সুযোগ দিলেন। পরের মঙ্গলবার বিজয়ী বাহিনী,আক্রে বন্দরের দিকে ধাওয়া করলেন, কোন বাধা ছাড়া দখল করলেন, বিগত কয়েক বছরে শহরটির অর্থনৈতিক গুরুত্ব খুব বেড়েছিল, পশ্চিম দেশ গুলোর সাথে বানিজ্য এই শহর দিয়েই হত। সুলতান তথাকার ইটালিয়ান ব্যবসাদের বোঝালেন সেখানে থাকার জন্য এবং কোনো অসুবিধা হবেনা বললেন, সব রকম সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিলেন। কিন্তু তাঁরা নিকটস্থ বন্দর টায়ারে যেতে চাইল, সুলতান সামান্য অখুশি হলেন কিন্তু বাধা দিলেন না। তাদের সম্পদ নিয়ে যেতে দিলেন, ও সাহায্য করতে চাইলেন। সালাদিন এতবড় সেনাবাাহিনীর প্রধান হিসেবে,ঊদ্দেশ্যহীন ভাবে গ্রামীন এলাকায় ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে কোন ভাল কিছু দেখলেন না,তিনি হুকুম দিলেন প্যালেস্তাইনে ফরাসী শক্তিশালী এলাকা গুলোকে দমন করার হুকুম দিলেন,সামারিয়া ও গ্যালিলীর ফরাসীরা একের পর এক আত্ম সমর্পন করল,কখনও কয়েক ঘন্টার মধ্যে আবার কখনও কয়েকদিন পর পর। নেবুলাস হাইফা ও নাজারেথের অধিবাসিরা টায়ার এবং জেরুযালেমে চলে যায়। কেবল জাফ্ফাতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল,সালাদিনের ভাই আল আদিলে এর অধীনে একদল মিশরীয় সেনা বাাধার সম্মুখীন হচ্ছিল, যখন তিনি শহর দখল করে সবাইকে অধীনস্ত ক্রীতদাস করলেন, আল আথির স্বীকার করেছেন তিনি নিজেও একটি ফরাসী মেয়েকে ক্রীতদাসী হিসেবে এ্যলেপ্পোর বাজার থেকে কিনেছিলেন।তার একটি ১ বছরের বাচ্চা ছিল,একদিন তাঁকে কোলে করে যেত পড়ে গেল ও মুখ চুলকোতে লাগল কাঁদতে লাগল। আমি তাকে সান্তনা দিলাম, আমি আমার দুর্ভাগ্যে কাদছি,আমার ছয়টা ভাই ছিল সবাই মরে গেছে আমার স্বামী ও বোনের কি হয়েছে জানিননা জাফনার সব ফরাসীর এই হাল।
অবশ্য বেশীর ভাগ স্থলে ফরাসীদের থেকে আরবভূমি পুনরুদ্ধার হল রক্ত পাত ছাড়াই, আক্রেতে অল্প সময় অবস্থান করার পর সালাদিন উত্তরের দিকে আগিয়ে গেলেন, টায়ার পেরিয়ে গেলেন,এর শক্ত পোক্ত দেওয়ালগুলো এড়িয়ে সময় বাঁচালেন। উপকুল বরাবর বিজয়ীর মত এগিয়ে গেলেন।৭৭ বছর দখল দারীর পর ২৯শে জুলাই যুদ্ধ ছাড়াই সাইদা দখলে এল। কয়েকদিন পর বেইরুট ও জুবাইলের একই দশা হল। মুসলিম সৈন্যরা এখন ত্রিপলি বিজয়ের কাছাকাছি পৌঁছে গেল,সালাদিন যখন দেখলেন এদিকে আর ভয় নাই, তখন দক্ষিনে ফিরলেন, এবং আবার টায়ারের সামনে থামলেন।,ভাবতে লাগলেন, অবরোধ করবেন কি না। কিছু ইতস্ততঃ করার পর,বাহা আল দিন বলেছেন, সুলতান অবরোধ করলেন না সৈন্যরা চারিদিকে ছড়িয়ে ছিল সৈন্যরা খুবই পরিশ্রান্ত ছিল, এবং টায়ার খুবই সূরক্ষিত ছিল, সিমান্তের সমস্ত ফরাসীরা সেখানে জড় হয়েছিল, তিনি এসক্যালন আক্রমন করা ভাল মনে করলেন যাহা সহজে পরাজিত হল। সালাদিনকে এই সিধান্তের জন্য খুব পস্তাতে হয়েছিল, অবশ্য তখনকার মত তাঁর বিজয়যাত্রা অব্যহত ছিল,৪৪ সেপ্টেম্বর এ্যসকেলন অধীন হল,তারপর গাজা, টেম্পলারদের অধীন ছিল, সালাদিন এরমধ্যে জেরুজালেমের আশেপাশে তাঁর আমিরদের পাঠাতে লাগলেন, সেখানে তারা বেথেলহেলম সমেত কয়েকটি জায়গা অবরোধ করল, এখন সুলতানের এখন একটা ইচ্ছা প্রবল থাকল তাঁর এই বিজয় আর একটাই মুকুট যোগ পবিত্র নগরীর পুনর্বিজয়-- জেরুজালেম অভিযান ও বিজয়। সুলতানের বাসনা, মহান খলিফা উমরের সাফল্য কি তার জীবনেও দ্বিতীয় বার ঘটাতে পারবেন,সম্মানীয় নগরী ধ্বংশ না করে এবং বিনা রক্তপাতে সেখানে পা রাখতে পারবেন,তিনি জেরুজালেমের অধিবাসীদের কাছে বার্তা দিলেন শহরের ভবিষ্যৎ নিয়ে শহরের আলোচনার জন্য এগিয়ে আসতে , গন্যমান্য কিছু মানুষের একটি দল দেখা করতে এ্যসকেলনে এলেন, বিজয়ীর দাবী যুক্তিপূর্ণ ছিল, বিনা যুদ্ধে শহরের দখল ছেড়ে দিতে হবে যারা শহর ছেড়ে যেতে চান যেতে পারবেন, তাদের সম্পত্তি নিয়ে যেতে পারবেন, খ্রীষ্টান উপাসনালয় গুলির ক্ষতি করা হবেনা তীর্থযাত্রী হিসেবে যারা আসবেন নিরাপদে থাকবেন, কিন্তু সুলতান অবাক হয়ে দেখলেন শহর দখলের সময়ের মতই উদ্ধত ব্যবহার করতে চাইলেন ফরাসীরা, যীশুর জন্মের শহর দিয়ে দিতে হবে / কভি নেহি, এই শহর তাদের যাই ঘটুক শহর তারা রক্ষা করবেই।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct