আধিপত্যকামী, প্রায় স্বৈরতন্ত্রী আর ইতিহাস জ্ঞান রহিত বর্তমান শাসক গোষ্ঠী হিন্দুস্তান নির্মাণে অর এতদ্দেশীয় আজাদি সংগ্রামে মুসলমানদের অতুল্য অবদানকে নস্যাৎ করতে উদগ্র আগ্রহে মত্ত। এমন সময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের অপ্রতিরোধ্য যোদ্ধা মাওলানা ওবাইদুল্লাহ সিন্ধির অবদান সম্পর্কে মর্যাদাপূর্ণ নাতিদীর্ঘ একটি সন্দর্ভ হাজির করেছেন বাঙালি মুসলমানদের মর্যাদার অন্বেষক-ইতিহাসবিদ খাজিম আহমেদ।
‘হিন্দুস্তান’-এর আজাদি সংগ্রামে মাওলানা ওবাইদুল্লাহ্ সিন্ধির নাম পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণযোগ্য। ওবাইদুল্লাহ্ সিন্ধি বিশিষ্ট ইসলামতাত্ত্বিক। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে একটি শিখ ধর্মাবলম্বী পরিবারে তাঁর জন্ম হয়েছিল। বিষয়টি কৌতূহলোদ্দীপক। অতি শৈশবেই তিনি তাঁর পিতা-মাতাকে হারান। অর্থাৎ ‘এতিম’ হয়ে যান। পনেরো বছর বয়সেই তিনি ‘ইসলাম’ কবুল করেন। ইসলামি নানান সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা ও বদান্যতায় তিনি ইসলাম সম্পর্কে অতলান্তিক লেখাপড়া আর গবেষণার মারফত নিজেকে একজন বিচক্ষণ ‘আলেম’ অর্থাৎ ইসলাম-বেত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই অনিঃশেষ জ্ঞানার্জনের ফলে হিন্দুস্তানি আলেমবর্গ তাঁকে মাওলানা (মহাজ্ঞানী আর অগণন ব্যক্তির নেতা) হিসেবে অভিহিত করেন। ইসলাম বিষয়ক জীবন দর্শন এবং এই শিক্ষার আলোকে ভারতীয় সমাজকে অনুধাবন করার প্রয়াসে ব্যাপক বৌদ্ধিক চর্চায় আত্মস্থিত হয়ে উঠলেন। মাওলানা ওবাইদুল্লাহ্ সিন্ধির রাষ্ট্রদর্শন, সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা এবং ‘কলোনিয়াল পাওয়ার’ (ঔপনিবেশিক ক্ষমতা আর ধারণা) সম্পর্কে তাঁর আধুনিক আর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য এবং মান্যতা পেতে পারে— এমন তাত্ত্বিক মতবাদ তৎকালীন রাষ্ট্রনায়ক বর্গের সামনে উত্থাপন করেন এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জনমত সৃজন এবং তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের ‘অ্যাভিনিউ’ তৈরি করেন। এটি ছিল তাঁর ‘সিয়াসতি’ চেতনার উৎকৃষ্ট ফসল। বস্তুত সেই সময়ে ভারতের রাজণীতি ক্ষেত্রে তিনি আন্তর্জাতিক স্তরে একজন মান্য ‘স্টেটসম্যান’ হয়ে ওঠেন। এশিয়া এবং ইউরোপের রাষ্ট্রনেতারা তাঁকে জানতেন। তাঁর জীবনের নানান ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তা প্রমাণিত হয়েছে। মাওলানা ওবাইদুল্লাহ্ সিন্ধি বস্তুত শাহ ওয়ালিউল্লাহ্ এবং শাহ মোহাম্মাদ ইসমাইলের ভাবশিষ্য ছিলেন। মুঘল সাম্রাজ্য যখন ক্রমেই পতনের দিকে এগোচ্ছে তেমন সময়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহ্ এবং শাহ ইসমাইল সেই পতন রোধে অধিনায়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন। মাওলানা ওবাইদুল্লাহ্ সিন্ধি উপলব্ধি করেছিলেন, ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠীর উচ্ছেদসাধনই ভারতীয়দের প্রধান ‘জাতীয় কর্তব্য’। তিনি বৈপ্লবিক চেতনা বিস্তারে ক্রিয়াশীল হয়ে উঠলেন। ‘মাওলানা’ হলেন ‘বিপ্লবী’। এতদ্দেশীয় নানা স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইতিহাস বিষয়ের সিলেবাসে বা পাঠক্রমে ‘বহির্ভারতে স্বাধীনতা অন্দোলন’ বা ‘বিদেশে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র আন্দোলন-প্রয়াস’ ছাত্রদের পড়ানো হয়। কিন্তু সেখানে মাওলানা ওবাইদুল্লাহ্ সিন্ধির শুধুমাত্র নামটিই উল্লেখ করা হয়। তাঁর কৃতিত্বের বিষয়টি অনালোচিত থেকে যায়। অথচ তিনি বিদেশে সাময়িককালের জন্য ‘ভারত সরকার’-এর পত্তন করেন। এটি খুব সহজ বিষয় ছিল না।
কাবুলের পথে
স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তিনি বৈদেশিক সাহায্যের প্রয়োজনীয়তার কথা প্রথম ভেবেছিলেন। এই প্রসঙ্গে বলা দরকার তাঁর এই রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং তত্ত্বের দ্বারা পরবর্তীতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু প্রভাবিত এবং অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। বস্তুগত ও নৈতিক— উভয়বিধ সাহায্যই ছিল মাওলানার কাঙ্খিত বিষয়। তৎকালীন আজাদি সংগ্রামের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আলোচনা শেষে তিনি ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে কাবুল অভিমুখে রওনা হলেন। আফগানিস্তান-এর শাসক হবিবুল্লাহ্ খান-এর সঙ্গে ওবাইদুল্লাহ্-র গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু আফগান সরকার তাঁদের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির কারণে নির্লিপ্ত ছিলেন। এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মাওলানা ওবাইদুল্লাহ্ সিন্ধি অপেক্ষকৃত শক্তিশালী রাশিয়ার জার সরকারকে ব্রিটিশের প্রতি মিত্রতা নীতি পরিত্যাগ করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে সাহায্য করতে অনুরোধ করেন। এই সময়ে জার্মান এবং তুর্কি সরকারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে তিনি প্রথম অস্থায়ী ‘আজাদ হিন্দ সরকার’ গঠন করেন। রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ ছিলেন প্রেসিডেন্ট আর অধ্যাপক বরকতুল্লাহ্ ছিলেন এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী। এই গোপন বিপ্লবী দল কাবুল, আঙ্কারা, দামাসকাস এবং ইজিপ্টের কায়রোতে কয়েকটি বিপ্লবী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন মাওলানা ওবাইদুল্লাহ্ সিন্ধি। জার্মানির ‘বার্লিন কমিটি’র সমর্থনে আর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এক ব্যাপক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা তৈরি করেছিলেন। বসরা এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ব্রহ্মদেশে সেনা বিদ্রোহেও এঁদের প্রেরণা কাজ করেছিল। ‘রেশমি রুমাল ষড়যন্ত্র’ মামলায় মাওলানা ওবাইদুল্লাহ্ সিন্ধির নামও ছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আর সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী তাঁর ভারতে প্রত্যাগমনের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তাঁকে ‘হিন্দুস্তান’-এ অবাঞ্ছিত ব্যক্তিরূপে গণ্য করা হয়।
কাবুল থেকে রাশিয়া
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ওবাইদুল্লাহ্ সিন্ধি কাবুল পরিত্যাগ করে মস্কো চলে গেলেন। সেখানে সাম্যবাদ বা কমিউনিজম সম্পর্কে দ্বিধাহীন বিস্তর পড়াশোনার পর এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে, ইসলাম অন্য যে কোন ‘ইজম’-এর চেয়ে উন্নততর। রাশিয়ায় অবস্থানকালীন তুর্কি রাষ্ট্রদূত-এর সঙ্গে রাজনৈতিক বন্ধুত্ব হয়। তুর্কি বন্ধুর অনুরোধক্রমে তিনি তিন বৎসর তুরস্কে অবস্থান করলেন। কাবুল, মস্কো আর তুরস্কের নানান শহরে বসবাস কালে অজস্র গুরুত্ববাহী ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে তাঁর পরিচয় গড়ে ওঠে। স্বদেশ তিনি অবাঞ্ছিত। স্বভাবতই নির্বাসিত তিনি। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে এতটাই বিপজ্জনক বলে মনে করত। এর পরে তিনি চলে গেলেন ইসলাম-এর পবিত্র ধর্মনগরী মক্কায়। মক্কায় অবস্থানকালে তিনি আবারও ধর্মচর্চা এবং তদ্-বিষয়ক অধ্যয়নে মগ্ন হয়ে গেলেন। এই সময়ে তিনি ভারতের মুসলমান ‘উম্মাহ’কে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে সচেতন এবং অতি সাবধান হতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমরা এই আলোচনায় উল্লেখ করেছি যে, তিনি শাহ ওয়ালিউল্লাহ্ এবং শাহ ইসমাইলের দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। কিন্তু তুরস্কে অবস্থানকালে তিনি ‘প্যান ইসলামি’ নেতা জামালউদ্দিন আল্-আফগানির রাজনৈতিক মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। জামালউদ্দিন আল্-আফগানি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া-আফগানিস্তান, এশিয়া অংশের রাশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের ভৌগলিক অঞ্চল নিয়ে একটি ‘ইসলামিক কনফেডারেশন’-এর প্রতিষ্ঠা প্রত্যাশা করেছিলেন। মাওলানা ওবাইদুল্লাহ্ সিন্ধি এই মতবাদে শেষ জীবনে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন।
মাওলানার প্রত্যাবর্তন
১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেস মাওলানা ওবাইদুল্লাহ্ সিন্ধি নিরাপদ প্রত্যাবর্তন দাবি করেন। এই দাবি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমূহও সমর্থন করেছিলেন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে নিষেধাজ্ঞা বাতিল হয়ে যায়। সুদীর্ঘ ২৪ বছর পর মাওলানা ওবাইদুল্লাহ্ সিন্ধি শহর করাচিতে ফিরে আসেন। করাচিতে তিনি ইসলাম-দর্শন চর্চা, প্রোফেট হজরত মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে মূল্যায়ণ এবং সেই মহান নবী সা-এর শিক্ষা যুব সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিপ্রায়ে ব্যাপক শারীরিক পরিশ্রম করেন। মানসিক অবসাদও তাঁকে বিব্রত করে তোলে। আদতে তিনি একজন ধর্ম ও কর্মযোদ্ধা। আরাম তাঁর জীবনে গরহাজির ছিল। তিনি স্পষ্ট উচ্চারণ করেছিলেন, ইসলামি চিন্তা-চেতনা, জীবনাদর্শ ও কাণ্ডজ্ঞান অনুসরণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে ঐহিক ও পারত্রিক মুক্তি।১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতায় অনুষ্ঠিত উলেমা সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন, ব্রিটিশমুক্ত ভারতেই আমার ফিরে আসার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে এল। প্রত্যাবর্তনের পরও কোনও বিশ্রাম পেলাম না। শরীরও সাথ দিচ্ছে না। ... ... কিন্তু একথা বলব, শাহ ওয়ালিউল্লাহ্ বিশ্বাস করতেন ‘উলামা সমাজ’-ই দেশে বিপ্লব ও বিদ্রোহের আগুন জ্বালাতে পারে। আমার-ও সেই বিশ্বাস রয়েছে। জীবনের ব্যাপক অংশ তিনি বৈপ্লবিক চেতনা জাগরণের জন্য বরাদ্দ করে রেখেছিলেন। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ‘হিন্দুস্তান’ তাঁর এই মহান সন্তানকে হারিয়েছিল। সেদিন তামাম হিন্দুস্তান শোকে আচ্ছন্ন হয়েছিল। আজ কেউ তাকে মনে রাখেনি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct