মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা
তুহিন সাজ্জাদ সেখ
উন্নয়নশীল প্রযুক্তির রামধনুর আলোকচ্ছটায় প্রগতির উজ্জ্বল বিকিরণে চতুর্দিক জ্বলজ্বলে হয়ে উঠেছে। সভ্যতা আধুনিকতম বিজ্ঞানের মোড়কে আচ্ছাদিত,প্রায় একপ্রকার সুস্থ নিরাপদ আশ্রয়ে বিশ্রামরত! দেহরক্ষী থেকে পান্থশালার স্পট বয়, কারখানার শ্রমিক থেকে সরকারি অফিসের মেজোবাবু, সমীক্ষা থেকে সংগ্রহশালা, পরিসংখ্যান থেকে প্রতিরক্ষা, প্রেক্ষাগৃহ থেকে শ্রেণীকক্ষ, রণভূমি থেকে বনভূমি, গ্রন্থ থেকে গ্রন্থাগার সর্বত্রই বিজ্ঞানের সুনিপুণ উপস্থিতি লক্ষণীয়। এই বিজ্ঞান আজ মানুষকে শিখিয়ে দিচ্ছে কিভাবে সময়কে নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী করা যায়। তবে ইতিমধ্যেই বিজ্ঞানের অনবদ্য দান মুঠোফোনের দৌলতে মানুষ গোটা বিশ্বকেই প্রায় মুষ্ঠিবদ্ধ করে ফেলেছে। প্রেম নিবেদন হোক কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস সবই এখন নিমেষেই,তাও আবার ঘরে বসে। — এসব সেই বিজ্ঞানের দান! দীর্ঘ দশক পর পুরোন বন্ধুর সাথে আলাপন কিংবা হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মানুষটির দেখা পাওয়া, বিদেশি বন্ধুর সাথে সুখালাপ বা বাণিজ্যিক লেনদেন, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে নিজের মতামত পোষন কিংবা প্রতিবাদের প্রবহমানতা, সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ কিংবা নিছকই সময় কাটানো যাই হোক না কেন — সেটাও আমাদের জন্য সময় বাঁচিয়ে সুলভ করেছে এই বিজ্ঞান: ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, শেয়ারচ্যাট, স্কাইপ, ইমু ইত্যাদি সব প্রয়োগের মাধ্যমে।
কি আর করতে বাকি রেখেছে এই বিজ্ঞান —
— বিজ্ঞান আমাদের জন্য কি না করেছে! বিজ্ঞান নিরন্তর আমাদের সেবায় নিয়োজিত। চাষীর জন্য বীজতলার প্রস্তুতি, বীজ রোপণ,ফসল কাটাই, জলসেচ, মাড়াই, ঝাড়াই, বাঁধাই প্রভৃতি সব কাজের জন্য বিজ্ঞান তার উদার হস্ত বাড়িয়ে দিয়েছে ; চাষীর হিত চিন্তা করে, সময় বাঁচিয়ে সুফল শস্য ঘরে তোলার জন্য। বিজ্ঞানের অমূল্য সৃষ্টি ইন্টারনেট আজ আবালবৃদ্ধবনিতার, ধনী নির্ধনের সেবায় নিযুক্ত। আমরা একবেলা না খেয়ে থাকতে পারি কিন্তু ইন্টারনেট ছাড়া এক সেকেন্ডও আমরা চলতে পারি না। তথ্য প্রযুক্তির পরিষেবা আমাদের ছায়াসঙ্গী। আজ ইন্টারনেট-এর পঞ্চম পুরুষে পা রেখেছে আমাদের সভ্যতা। এই বিজ্ঞানই আমাদের বহির্মুখী ও বহুমুখী কর্মযজ্ঞে সামিল হতে সাহায্য করেছে। বিজ্ঞানই আমাদের শিখিয়ে দেয় জীবনের আসল অর্থ “কর্মই ধর্ম”। বিজ্ঞান আমাদের জীবনে বেঁচে থাকার সংজ্ঞাটাই পুরো পাল্টে দিয়েছে। বিজ্ঞানের নানা অভূতপূর্ব আবিষ্কার শুধু আমাদের চমকে দিয়েছে তাই নয় , বিজ্ঞান আমাদের জীবনযাত্রায় বৈচিত্র্য এনে দিয়েছে। এই বিজ্ঞান আমাদেরকে ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ‘, ‘মেশিন লার্নিং ‘, ‘ইন্টারনেট অব থিংস ‘, ‘ থ্রি ডি বায়োপ্রিন্টিং ‘ -এর মতো জীবনমুখী সব প্রযুক্তি উপহার দিয়েছে, যা সভ্যতার অগ্রগতিকে আরও দ্রুততর ও সাবলীল করে তুলেছে। শিক্ষা থেকে সাহিত্য, সংস্কৃতি থেকে চাষবাস, ইতিহাস থেকে ভবিষ্যৎ দুনিয়া, ভূলোক থেকে ভূগর্ভ, প্রসাধন থেকে প্রশাসন, সুরক্ষা থেকে চিকিৎসা সবক্ষেত্রেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উদারমনে আমাদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ পরিষেবা দিয়ে চলেছে। বিজ্ঞান ছাড়া আমরা অচল, সভ্যতা অচলায়তন! তবে আমরা কি বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি যথেষ্ট সংবেদনশীল ? বিজ্ঞানের প্রতি আমাদের ভক্তি কি যথেষ্ট ? আমরা কি সঠিকভাবে সঠিক মাধ্যমে বিজ্ঞান শিক্ষা, চর্চা ও তার প্রচার প্রসার করছি ?
— অবাক হচ্ছেন তাই না, কিন্তু এই প্রশ্ন গুলো থেকেই যায়। কেননা আমরা বিজ্ঞান বলতেই ইংরেজি ভাষায় বিজ্ঞান পড়া ও লেখার কথা ভাবি। আমরা ভেবেই নিই ইংরেজি ভাষা ছাড়া বোধহয় বিজ্ঞান শেখা বা শেখানো কোনটাই সম্ভব নয়। — তবে এ কথা পুরোপুরি সত্যি নয়, আমাদেরকে নিজের নিজের মাতৃভাষায় বিজ্ঞান শিখতে হবে। যে কোন ভাষা শিক্ষা কোন একজন মানুষের জীবনে একটি নতুন সম্ভাবনাময় দিগন্ত খুলে যাওয়ার মতো। তাই নতুন নতুন ভাষা শিক্ষা মানুষের জীবনে নানা রঙের আগমন ঘটায়। সেই হেতু বিদেশি কোন ভাষা যেমন ইংরেজি, ফরাসি, পোর্তুগিজ, স্প্যানিশ, জার্মানি, ইতালিয় ইত্যাদি ভাষা শিক্ষা খুবই উপকারী, কেননা এই সব ভাষার মধ্য দিয়ে ওই সব দেশের তথ্য, সংস্কৃতি, সমাজনীতি, রাজনীতি ও অর্থনীতির দেশজ স্বাদ চাঁখা সম্ভব হয়। তবে সেই শিক্ষা কোন রকমভাবেই নিজের মাতৃভাষাকে অবহেলা করে নয়। আমাদের জীবনে যে কোন শিক্ষা কেবলমাত্র মাতৃভাষাতেই তার পরিপূর্ণতা লাভ হয়। বিশেষ করে বিজ্ঞানের শিক্ষা তো বটেই। কেবলমাত্র মাতৃভাষাতেই বিজ্ঞান শিক্ষার মাধ্যমেই আমাদের শিক্ষার পূর্ণতা প্রাপ্তি হবে।মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চায় আমরা বিজ্ঞান শিক্ষার পূর্ণ ব্যাপ্তিকে আত্মস্থ করতে পারব। আমাদের মধ্যে সম্পূর্ণ রুপে বিজ্ঞানের আলো ফুটে উঠবে। মাতৃভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষার মাধ্যমে আমরা নিজেদের মধ্যে বিজ্ঞানের বিস্তার ও জনপ্রিয়করণ ঘটাতে সক্ষম হবো। যার ফলস্বরূপ আমাদের সকলের মধ্যে বিজ্ঞান মনস্কতার জন্ম হবে। এই বিশেষ মেজাজ আমাদেরকে দ্বেষ বিদ্বেষ, হিংসা, মারামারি, দাঙ্গা ফ্যাসাদ,হৈ চৈ, নোংরামি প্রভৃতি অপকর্মের হাতছানি থেকে বিরত রাখবে। আমাদের মধ্যে মানবিকতার নিদর্শন তৈরি হবে। জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হবে সহজ ও সরল উপায়ে সমাজের উন্নয়ন। বিশ্বাস হয়ে উঠবে যুক্তিনির্ভর। উন্নয়ন হবে সুসংগত। সভ্যতা হবে সুন্দর। এই মাতৃভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা, তার প্রচার প্রসার ও জনপ্রিয়করনের উদ্দেশ্যে ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের অধীন স্বশাসিত সংস্থা “বিজ্ঞান প্রসার” নানা সব জনহিতকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে। আর বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, আমরা এই ভাষাতেই খাই ও পরি,এই ভাষাতেই আমাদের জন্ম মৃত্যু; তাই প্রতিদিন আমাদের জীবনে ভাষা দিবসের সমান। তাই আমাদের সকলের জীবনের ব্রত হোক আমরা সবাই বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শিখব ও শেখাব এবং তার বিস্তার ঘটাব। আমরা যেন কখনোই ভূলে না যাই — “মোদের গরব মোদের আশা/ আ মরি বাংলা ভাষা” । শ্রেষ্ঠ ভাষা আমার মাতৃভাষা। কৃষ্টি ও সৃষ্টির ভাষা আমাদের বাংলা মাতৃভাষা।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct