সাম্প্রতিক ইতিহাসে তুরস্কের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবণতা আবার দেখা যাচ্ছে। নানা ধরনের ঝুঁকি মোকাবেলা করে এগিয়ে যাচ্ছে দেশটি। ১৯২৩ সালের ২৪ জুলাই সুইজারল্যান্ডের লুজানে যে চুক্তিটি স্বাক্ষর হয়েছিল, এক বছর পর সেটি শতবর্ষ পার হচ্ছে। এরপর কী হতে যাচ্ছে দেশটিতে? তুরস্ক কি খোলস থেকে বেরিয়ে আবার আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রক শক্তিতে পরিণত হবে? যদিও নতুন বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে সম্ভবত আবির্ভূত হতে যাচ্ছে তুর্কিরা। এ নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ শেষ কিস্তি।
তুরস্ক তার সামরিক শক্তিকে সংহত করার চেষ্টাও করে। গত এক দশকে, তুরস্কের সামরিক ব্যয় ৮৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। জিডিপির অনুপাতে প্রতিরক্ষা ব্যয় ২.৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ২.৮ শতাংশ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তুর্কি প্রতিরক্ষা নীতিকে প্রভাবিত করে। ২০১৬ সালে আইসিস দুই তুর্কি সৈন্যকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে এবং ২০২১ সালে, পিকেকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে ১৩ জন তুর্কি সৈন্যকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। তুর্কি সৈন্যদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পরে, তুরস্ক এ ব্যাপারে কৌশলগত প্রতিশোধের ওপর জোর দেয়। এরদোগান উত্তর সিরিয়ায় পিকেকে-পিওয়াইডি’র বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের জন্য একটি জাতীয় ঐক্যমত অর্জন করেন, যদিও তিনি সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশে তুরস্কের হস্তক্ষেপের জন্য অনুরূপ সমর্থন পেতে ব্যর্থ হন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে, যখন বালিউনে সিরিয়ার বিমান হামলায় ৩৪ জন তুর্কি সৈন্য নিহত হয়, তখন একটি জনবিক্ষোভ সরকারের পাবলিক অ্যাপ্রুভাল রেটিংকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তবে ঠিক পরেই একেপি সরকার রাশিয়ান হুমকিকে উপেক্ষা করে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদের বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন স্প্রিং শিল্ড শুরু করে। সরকার আবারও তুর্কি জাতীয়তাবাদী মনোভাবকে বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হয়। সক্রিয় খেলোয়াড় এরদোগানের অধীনে গত এক দশকে তুরস্ক বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরে ক্রমবর্ধমান সক্রিয় খেলোয়াড় হয়ে উঠেছে। বিশ্বশক্তি হিসেবে রুশ স্বার্থের ক্ষতি করতে পারে এমন কর্মকাণ্ড নিয়ে অবশ্য তুরস্ক সতর্ক থাকে। দেশটি জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভর করে। আঙ্কারা সাইপ্রাস ও গ্রিসের একতরফা সামুদ্রিক সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এথেন্স এবং নিকোসিয়া তুরস্কের অবস্থানকে একটি গুরুতর জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে এবং ইইউকে তুরস্কের ওপর চাপ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। তবে, ইইউ-এর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার হুমকির মুখে আঙ্কারা কিছুটা নিরুৎসাহিত হয় এবং সাময়িকভাবে ইজিয়ান এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় সাগরে স্কেল-ব্যাক উত্তেজনার দিকে চলে যায়। সাবেক অটোমান প্রদেশ লিবিয়াতেও একই রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সিসির ‘লাল রেখা’ ঘোষণার পর, তুর্কি-সমর্থিত জিএনএ সৈন্যরা অগ্রসর হওয়া থেকে বিরত থাকে এবং পরে যুদ্ধবিরতিতে স্বাক্ষর করে।
পূর্ব ভূমধ্যসাগরে ইসরাইল ও তুরস্কের মধ্যে উত্তেজনা আংশিকভাবে ইসরাইল, সাইপ্রাস এবং মিসরের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক গ্যাস আবিষ্কারের ফলাফল। ইসরাইল ও গ্রিসের অর্থনৈতিক স্বার্থ ইউরোপে গ্যাস রফতানি করতে আগ্রহী দেশগুলোর একটি রাজনৈতিক ব্লক গঠনের বিষয় নিয়ে আসে। তুরস্কের পাইপলাইন ব্যবহার না করে ইউরোপে জ্বালানি রফতানির প্রচেষ্টা পশ্চিমের কাছে একটি শক্তি সেতু হিসেবে দেশটির ভূমিকা পালনকে চ্যালেঞ্জ করে। মাভি মারমারা ফ্লোটিলার ঘটনা ব্যতীত ইসরাইল ও তুরস্কের মধ্যে কোনো সামরিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। তবে, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯-এ, তুর্কি নৌ জাহাজগুলি গ্রিক সাইপ্রিয়ট বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (ইইজেড) বাইরে ইসরাইলি গবেষণা জাহাজ ‘ব্যাট গালিম’কে বাধা দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। ইসরাইলি জাহাজের প্রতি তুর্কি প্রতিক্রিয়া তার নীল হোমল্যান্ড মতবাদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল, যার দ্বারা তুরস্ক গ্রিস ও সাইপ্রাসের দখল থেকে তার ন্যায্য ইইজেড মুক্ত করতে চায়। এটি করে, আঙ্কারা এথেন্স এবং নিকোসিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করে। পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষকদের মধ্যে বিশেষভাবে আলোচিত বিষয় হলো, ২০২৩ সালের ২৪ জুলাই লুজান চুক্তির শতবর্ষ পরে কী হবে। সাধারণভাবে ধারণা করা হয় যে, লুজান চুক্তির শত বছর পরে তুরস্ক তেলের জন্য অনুসন্ধান শুরু করবে। কৃষ্ণসাগর এবং মারমারা সমুদ্রের সাথে সংযোগকারী একটি নতুন চ্যানেল স্থাপন করবে, যেখান দিয়ে জাহাজের পারাপার থেকে ফি সংগ্রহ করবে আঙ্কারা। এর মধ্যেই তুরস্ক তেল গ্যাস অনুসন্ধান কাজ শুরু করেছে। ইস্তাম্বুল খাল নামে নতুন চ্যানেল প্রকল্পের কাজও শুরু হয়েছে।
২০২৩ সাল তুরস্কের জন্য এমনিতেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। এই বছরের মাঝামাঝি দেশটিতে প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচন হবে। গত দুই দশকে তুরস্ককে এক নতুন অবস্থান ও গন্তব্যে নিয়ে এসেছেন রজব তাইয়্যেপ এরদোগান। তিনি ও তার দল একেপি এই যুগসন্ধিক্ষণের নির্বাচনে পুনর্নির্বাচিত হলে তুরস্ক সম্ভবত নতুন এক পর্বে পা রাখবে। আর এর ব্যতিক্রম হলে গন্তব্যের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়তে পারে। অনেক সমালোচক মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্ক উসমানীয় খেলাফতের পুরনো সাম্রাজ্যকে ফিরিয়ে আনতে চাইছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইসরাইলের সাথে বৈরী সম্পর্ক অনেকখানি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে তুরস্কের। আর্মেনিয়ার সাথেও সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা নিয়েছে আঙ্কারা। এ কথা সত্যি যে, লুজান চুক্তির মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে তুরস্ককে সঙ্কুচিত এক দেশে পরিণত করা হয়েছে। এমনকি মসুল ইদলিব আফরিন রাক্কার মতো তুর্কি ঐতিহ্যের শহরকে তুরস্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। লুজান চুক্তির অবসানের পর এসব এলাকাকে তুরস্ক তার মানচিত্রভুক্ত করতে পারে বলেও অনেকে সংশয় প্রকাশ করেন। ইজিয়ান সাগরের তুর্কি দ্বীপ যেগুলো গ্রিসকে স্থানান্তর করা হয়েছে সেগুলো আবার তুরস্ক নিজ নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে বলে মনে করা হয়। সাইপ্রাসের ব্যাপারে তুরস্ক আবার আগ্রাসী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে বলেও মনে করা হয়। (সমাপ্ত...)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct