সাম্প্রতিক ইতিহাসে তুরস্কের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবণতা আবার দেখা যাচ্ছে। নানা ধরনের ঝুঁকি মোকাবেলা করে এগিয়ে যাচ্ছে দেশটি। ১৯২৩ সালের ২৪ জুলাই সুইজারল্যান্ডের লুজানে যে চুক্তিটি স্বাক্ষর হয়েছিল, এক বছর পর সেটি শতবর্ষ পার হচ্ছে। এরপর কী হতে যাচ্ছে দেশটিতে? তুরস্ক কি খোলস থেকে বেরিয়ে আবার আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রক শক্তিতে পরিণত হবে? যদিও নতুন বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে সম্ভবত আবির্ভূত হতে যাচ্ছে তুর্কিরা। এ নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ প্রথম কিস্তি।
এই সময়ের আলোচিত এক দেশ তুরস্ক। মধ্যপ্রাচ্যে দেশটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে মূলত তার কৌশলগত অবস্থান, সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি, অটোমান সময়ের ঐতিহাসিক ভূমিকা আর এর প্রায় সোয়া আট কোটি অগ্রসর জনসংখ্যার কারণে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একেপি) শাসনে নতুন এক দর্শনের মধ্য দিয়ে দেশটি অগ্রসর হচ্ছে। ২০০২ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা তুরস্কের বর্তমান রাষ্ট্রপতি রজব তৈয়ব এরদোগান মুসলিম বিশ্বে নতুন এক প্রেরণা তৈরি করেছেন। বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে তুরস্ক নিজেকে পশ্চিম থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে নিয়ে সব বিশ্বশক্তির সাথে একধরনের সমান্তরাল সম্পর্ক তৈরি করেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয় সাম্রাজ্য বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ার পর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয় পুরো তুর্কি সাম্রাজ্য। অপমানকর ‘সেভরেস চুক্তি’ চাপিয়ে দেয়া হয় দেশটির ওপর। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা। অবশেষে লুজান চুক্তি নামে অপেক্ষাকৃত কম মন্দ আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষর হল। এর মধ্য দিয়ে আধুনিক তুরস্কের সীমানা নির্ধারিত হয়। তবে তুর্কি রাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী অনেক শহর ও ভূখণ্ড যুক্ত করে দেয়া হয় অন্য দেশের সাথে। নানা বিধিনিষেধ প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে চেপে বসে তুর্কি জাতির ওপর। সাম্প্রতিক ইতিহাসে তুরস্কের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবণতা আবার দেখা যাচ্ছে। নানা ধরনের ঝুঁকি মোকাবেলা করে এগিয়ে যাচ্ছে দেশটি। ১৯২৩ সালের ২৪ জুলাই সুইজারল্যান্ডের লুজানে যে চুক্তিটি স্বাক্ষর হয়েছিল, এক বছর পর সেটি শতবর্ষ পার হচ্ছে। এরপর কী হতে যাচ্ছে দেশটিতে? তুরস্ক কি খোলস থেকে বেরিয়ে আবার আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রক শক্তিতে পরিণত হবে? বিশ্বশক্তিগুলো কিভাবে দেখছে তুরস্ক এবং দেশটির এরদোগানের নেতৃত্বাধীন একে পার্টির সরকারকে? এসব প্রশ্নের অনেক কিছুর জবাব এখনো স্পষ্ট নয়। তবে নতুন বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে সম্ভবত আবির্ভূত হতে যাচ্ছে তুর্কিরা।
লুজান চুক্তি স্বাক্ষরের সময় এতে চুক্তির কোনো মেয়াদের উল্লেখ ছিল না। তবে যেকোনো আন্তর্জাতিক চুক্তির কার্যকারিতার মেয়াদ ধরা হয় ১০০ বছর। এই হিসাবে অনেকের মতে, ২০২৩ সাল পর্যন্ত এর কার্যকারিতা রয়েছে। তার মানে অবশ্য এ নয় যে, চুক্তির শত বছর পর তুরস্কের অবস্থা ঠিক ১০০ বছর আগে ফিরে যাবে। লুজান চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তদানীন্তন মিত্রশক্তি- ব্রিটেন, ফ্রান্স, গ্রিস, ইতালি, জাপান, রোমানিয়া ও যুগোশ্লোভিয়া এবং তৎকালীন অটোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে। অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করেন মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের প্রতিনিধি হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসমেত ইনোনু। এই চুক্তির ফলে তুরস্কের নতুন প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌমত্ব আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়। লুজানের চুক্তির মাধ্যমে এর আগে স্বাক্ষরিত সেভরেস চুক্তি বাতিল হয়। তুরস্কের নতুন সীমানা চিহ্নিত ও স্বীকৃত হয়। তবে একই সাথে এর মাধ্যমে খিলাফত বিলুপ্ত করে আনুষ্ঠানিকভাবে মোস্তফা কামালের অধীনে তুর্কি প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। চুক্তিটিতে তুরস্কের প্রতিপক্ষের সব দাবি মেনে নেয়া হয়। তবে এর মাধ্যমে সেভরেস চুক্তির একটি অংশ হিসেবে পৃথক কুর্দি অঞ্চল প্রতিষ্ঠার যে দাবি ছিল সেটি পরিত্যক্ত হয়। এর মাধ্যমে তুরস্ককে সাইপ্রাস, লিবিয়া, মিসর এবং সিরিয়ায় অবস্থিত আদানা ও গাজিয়ানতেপসহ কয়েকটি লেভান্ট শহরের ওপর তার সার্বভৌমত্ব ত্যাগ করতে হয়। এ চুক্তির পর সিরিয়া ও লেবানন ফরাসিদের দখলে চলে যায়। মিসর, সুদান এবং ইরাক আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ দখলের অংশ হয়ে ওঠে। ফিলিস্তিন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের অধীনে আসে; পরে এটিকে ব্রিটিশরা ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে তার কাছে হস্তান্তর করে। তুরস্ককে দুর্বল করতে, ইজিয়ান সাগর এবং কৃষ্ণসাগরের মধ্যবর্তী তুর্কি প্রণালীকে সব ধরনের শিপিং ও বেসামরিক যাতায়াতের জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা করা হয়। তুরস্কের ওপর অলিখিত আরো কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, যার আওতায় তেল ও গ্যাসের জন্য দেশটিকে খনন করা থেকে বিরত থাকতে হয়। লুজান চুক্তির পটভূমিটি কী ছিল তা নতুন পরিস্থিতি বোঝার জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যকে পরাজিত করার পর, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি এবং অন্যান্য মিত্র বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী রাজবংশের অটোমান সাম্রাজ্যকে সঙ্কুচিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই ইসলামী পরাশক্তি ৬০০ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপ এবং উত্তর আফ্রিকার বিশাল এলাকা শাসন করে। ১৯১৪ সালে তৎকালীন অটোমান সাম্রাজ্য জার্মানির সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর অংশ হিসেবে, অটোমান সাম্রাজ্য জার্মানি, অস্ট্রিয়া এবং হাঙ্গেরির পক্ষে যুদ্ধ করে। কিন্তু এই যুদ্ধে অটোমানরা সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হওয়ার মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct