উর্দু ভাষায় (রবীন্দ্রনাথ)
জাভেদ হুসেন
উর্দু-ফারসি কাব্য আবহের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় বাল্যকাল থেকেই। বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন হাফিজ সিরাজীর একনিষ্ঠ ভক্ত। মাঝরাত অবধি মগ্ন হয়ে তিনি হাফিজের গজল আবৃত্তি করে যেতেন। প্রার্থনার সময় তিনি যে ঘন্টাখানি ব্যবহার করতেন তার গায়ে খোদাই করা ছিল হাফিজের এই শেরখানি: মা রা দর মনযিলে জানাঁ চে আম্ন ও আয়শ চুঁ হর দম জরস ফরিয়াদ মিদারদ কে বর-বনদিদ ম্যাহমিলহা (প্রিয়র পথে চলতে গিয়ে কিসের স্বস্তি, এখানে যে সর্বদা যাত্রার ঘণ্টাধ্বনি নিরন্তর করে ফরিয়াদ - চলো, চলো) ঘন্টাখানি শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্র জাদুঘরে এখনো রাখা আছে। যদুনাথ সরকারের Tagore and Iran - নামে একখানি প্রবন্ধ আছে। তাতে এক কৌতুহলুদ্দিপক ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। ফারসিভাষীদের মাঝে একটা প্রথা আছে। তাঁরা হাফিজকে বলেন ‘লিসানুল গায়েব’, মানে অদৃশ্যের রসনা। কোনো অবস্থায় ঠিক কী করতে হবে হবে দোটানায় থাকলে তাঁরা ‘দিওয়ানে হাফিজ’ হাতে নিয়ে পাতা উলটে চোখ বন্ধ করে কোনো একটা গজলের ওপর আঙুল রাখেন। যে পংতির ওপর আঙুল পড়ে সেটা থেকেই করণীয় ঠিক করা হয়। রবীন্দ্রনাথ যখন ইরানে গিয়ে হাফিজের সমাধি দর্শনে গেলেন, সমাধি রক্ষক তাঁর হাতে এক খণ্ড দিওয়ানে হাফিজ দিয়ে কবিকে তাই করতে বললেন। নিজ দেশের দুর্দশার কথা ভাবতে ভাবতে কবি যে পংতিতে আঙুল রাখলেন তার অর্থ এ রকম—
আর কি খুলবে তারা সেই পানশালার দরজা
আর কি খুলবে আমাদের নিয়তির এই জট
যদিও ভণ্ডদের কারণে সেই দরজায় পড়েছে তালা
বিশ্বাস রাখো, হতাশ হয়ো না, ঈশ্বরই খুলে দেবেন এই দ্বার
রবীন্দ্রনাথ যখন নোবেল পুরস্কার পেলেন, অন্য ভাষার মানুষেরাও তাঁর সম্পর্কে আগ্রহী হলেন। ১৯১৪ সালে নিয়ায ফতেহপুরি ‘গীতাঞ্জলি’র উর্দুতে অনুবাদ করে ছাপলেন। নাম দিলেন ‘আরযে নগমা’। স্মৃতিকথায় তিনি জানাচ্ছেন যে, একদিন তিনি বিখ্যাত উর্দু কবি আকবর এলাহাবাদির সঙ্গে বাক্যালাপ করছেন। হাতে ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদের বই। আকবর বইয়ে ছাপা রবীন্দ্রনাথের ফটো দেখে বললেন, ‘ওনার ছবি দেখলে খামাজ রাগের কথা মনে হয়। সংগীত যদি ভাষায় রূপ দেওয়া হয় আর তা যদি ভাবনার প্রকাশ হয়, তবে এর মাঝে রবীন্দ্রনাথের কবিতাকে ঠাঁই দিতেই হবে।’ নিয়ায নিজে মুগ্ধ হয়েছিলেন ‘গীতাঞ্জলি’র গীতিময়তায়। অনুবাদের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন,‘কবিতাগুলো খুবই সুরেলা। এই স্বাভাবিক গীতিময়তা শুধু মানুষ নয়, ঈশ্বরের যে কোনো সৃষ্টির প্রথম উপাদান। এই সুর জেগে উঠলে অতীন্দ্রিয় অনুভূতির জন্ম দেয়। ঠাকুর সেই সুরের সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। এমনকি তিনি ঈশ্বরকেও আহ্বান করেছেন এক সুরস্রষ্টা বলে।’ আবদুর রহমান বিজনোরি মাত্র ৩২ বছর বয়সে ১৯১৮ সালে গত হওয়ার আগেই বড় উর্দু কাব্য বিশ্লেষকের মর্যাদা পান। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়ার বছর তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডে। সেই সময় এক কবিদের আসরে যাওয়ার স্মৃতি তিনি জানাচ্ছেন, ‘এক কবিকে বলতে শুনলাম—রবীন্দ্রনাথ পড়ার পর আমি আর লিখতেই পারছি না, এমন কবিতার পর আর কী লেখা যায়!’ দেশে ফিরে বিজনোরি ভাবলেন, হয়তো ভারতীয় সব ভাষাতেও রবীন্দ্রনাথের ব্যাপক অনুবাদ হচ্ছে। কিন্তু তিনি হতাশ হলেন। বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলেন যে ভারতের অভিজাতরা রবীন্দ্রনাথের নামই জানে না, হয়তো ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের উর্দু অনুবাদে বিজনোরির উদ্যোগকে স্বীকার করতে হয়। বন্ধু আবদুল আজিজ খালিদকে দিয়ে তিনি কবির নির্বাচিত কবিতার উর্দু অনুবাদ করালেন, ভূমিকা লিখলেন সেই বইয়ের। নাম দিলেন ‘গুলে নগমা’, মানে গানের ফুল। নিজেও অনুবাদ করেছেন মুক্ত ছন্দে। বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী বিজনোরির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁকে দিয়ে অনুবাদ করালেন ‘চিত্রা’। বিজনোরি ভূপাল সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা হলেন। সেখানে ১৯২৬ সালে শিক্ষা বিভাগের পরিচালক বন্ধু মুফতি মোহাম্মদ আনোয়ারুল হককে অনুরোধ করে উর্দুতে অনুবাদ করালেন রবীন্দ্রনাথের নাটকের। নিয়ায ফতেহপুরির ‘গীতাঞ্জলি’ অনুবাদের পেছনেও ছিল তাঁর প্রেরণা। অল্প বয়সে মারা না গেলে এই স্পৃহা আরও বহু দূর যেত সন্দেহ নেই। উর্দু কবি, বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা, তেলিঙ্গানা কৃষক আন্দোলনের সংগঠক, সর্বভারতীয় প্রগতিশীল লেখক সংঘের অন্যতম মখদুম মহিউদ্দিন রবীন্দ্রনাথে আকৃষ্ট হয়েছিলেন অন্যরকম কারণে। ১৯৩৫ সালে তিনি একটা বই লিখলেন। নাম ‘টেগোর অওর উনকি শায়েরি’। তাঁর মতে,‘আজকের এই যান্ত্রিক যুগে যখন মানবতা নিষ্পেষিত, মানুষ যখন সুবিধাবাদের দাস, যখন যন্ত্র আর ট্যাংকের গর্জনে বিরান মরুতে আর্তনাদের মতো সব কণ্ঠস্বর বিফলে হারায়, তখন কি কেউ ভাবতে পেরেছিল যে এই সব ছাপিয়ে এমন এক কণ্ঠ উঠে আসবে যে শ্রবণহীনদেরও মর্মমূলে প্রবেশ করবে! হ্যাঁ... এমনই একজন উঠে এসেছেন বাংলার বুক হতে। তাঁর মুখে সাধুর জ্যোতি। তাঁর কবিতায় আছে মসিহার স্পর্শ। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’ রবীন্দ্রনাথের প্রায় সব নাটক আর উপন্যাস উর্দুতে অনুবাদ হয়েছে। কবিতার অনুবাদ করেছেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম উর্দু কবি রঘুপতি সহায় ফিরাক গোরখপুরি। নোবেল উচ্ছ্বাস কেটে যাওয়ার বহু পরে, ১৯৬২ সালে তিনি অনুবাদ করেছেন ‘টেগোর কি এক সও এক নযমে’। এর ভূমিকা লেখেন হুমায়ূন কবীর। সংকলনের প্রথম কবিতা ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’, উর্দু নাম- শিকস্তে খোয়াবে আবশার। খুবই যত্নে করা এই সংকলনে বিস্তৃত টিকা যোগ করা হয়। ১৯৬১ সালে ‘আজকাল’ উর্দু ম্যাগাজিনের মে সংখ্যায় তিনি লিখছেন, ‘আমার অনুবাদ করা ঠাকুরের কবিতায় চার-পাঁচ হাজার লাইন আছে। তিনি প্রায় তিন হাজার কবিতা লিখেছেন। তিন হাজার বিষয় নিয়ে ভাবতে পারা সত্যিই বিস্ময়কর! কবিরা প্রায়ই পুনরাবৃত্তি জোরজবরদস্তি করেন। শেক্সপিয়ারের ক্ষেত্রেও তা ঘটেছে। কিন্তু এই জগৎ আর মানবজীবন এত সততা আর আন্তরিকতা দিয়ে ফুটিয়ে তোলার এমন বিপুল ক্ষমতা ছিল রবীন্দ্রনাথের যে সে সব প্রাণবন্ত ছবি এই জগৎকেই আমাদের জন্য চিত্রশালা বানিয়ে দিয়েছে।’
মুনশি প্রেমচন্দ উর্দু ছোট গল্পের সার্থক জনক। নিজের চিঠিতে অন্তত ১২ বার তিনি রবীন্দ্রনাথের উল্লেখ করে তাঁর শৈলী সার্থকভাবে ব্যবহার করেছেন বলে গর্ব করেছেন। মুনশি প্রেমচন্দের পাশাপাশি আরেকজন দিকপাল উর্দু কবির রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে খুব সখ্য ছিল। শায়েরে ইনকিলাব বা বিপ্লবের কবি নামে পরিচিত এই কবি হচ্ছেন জোশ মালিহাবাদি। রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে তিনি শান্তিনিকেতনে ছয় মাস কাটিয়ে গিয়েছিলেন। হামিদুল্লাহ আফসার আর পারভেজ শাহিদি দুজনই নাম করা প্রগতিশীল উর্দু কবি। তাঁদের কবিতায় রবীন্দ্রনাথের ব্যবহার করা ইমেজারি বারবার ফিরে এসেছে। শাহিদি কবির জন্ম জন্মবার্ষিকীতে লিখলেন ‘নগমায়ে হাজাত’, মানে বন্দী গান। একই উপলক্ষে আফসার উর্দুতে অনুবাদ করলেন ‘শিশু’ কবিতাখানি। আফসার বলতেন যে, যার এক হাতে ‘দিওয়ানে হাফিজ’ আরেক হাতে ‘গীতাঞ্জলি’, তার চাইতে ধনী আর কে আছে! বাংলাদেশের একজন বাঙালি উর্দু কবি মৌলভি জাকির হুসেইন সত্তরের দশকের মাঝামাঝি ‘গীতাঞ্জলি’র উর্দু অনুবাদ করেন। ঢাকাবাসী দিনাজপুরে জন্ম নেওয়া এই কবির অনুবাদখানি ছেপে বের হয়নি। উর্দু পাঠকদের কাছে ‘গোরা’ আর ‘কাবুলিওয়ালা’ আগে থেকেই বেশ জনপ্রিয়। হাল আমলের উর্দু গল্পকার আনওয়ার কমর একটা গল্প লিখলেন, নাম ‘কাবুলিওয়ালা কি ওয়াপসি’, অর্থ কাবুলিওয়ালার ফিরে আসা। এর প্রধান চরিত্র সেই চেনা রহমত। রবীন্দ্রনাথের গল্প যেখানে শেষ হয়েছে কমরের গল্প সেখান থেকে শুরু। আফগানিস্তানের বর্তমান সময়ে ফিরে এসেছেন রহমত কলকাতা থেকে। এই গল্পকে উর্দু পোস্টমডার্ন ফিকশনের পথিকৃৎ ধরা হয়। উর্দু ভাষায় রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে গুলজারের কথা না বললে। তাঁর কথা বলে আপাতত শেষ করা যাক। হাল আমলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই উর্দু কবির কবিতার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল দশ বছর বয়সে পাড়ার লাইব্রেরি থেকে ইংরেজি অনুবাদে ‘গার্ডেনার’ বইখানি চুরি করে। দেশভাগের পর ভারতে এসে, পরে বাংলার সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ সেই মুগ্ধতা বাড়িয়েছে। নিজে ভালো বাংলা জানেন। বহু পরে তিনি ‘গার্ডেনার’ উর্দু অনুবাদ করেন ‘বাগবান’ নামে। অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথের গান। ‘শিশু’ অনুবাদ করেছেন ‘নিন্দিয়া চোর’ নামে। সেই শৈশবের পরিচয় পরিণত বয়সে তিনি অকুণ্ঠ স্বীকার করেছেন ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতা’ নামে এই নজমে:
এক দেহাতি লোক
মাথায় গুড়ের বোঝা নিয়ে
দীর্ঘ প্রান্তও হচ্ছিল পার
গুড়ের গন্ধ পেয়ে ভনভন করে
মাথার ওপর জুটল মাছির ছাতা
দিন বেড়ে তপ্ত হলো সূর্য
গলে গলে পড়তে লাগল গুড়ের ধারা
সরল লোকটা অবাক
মাথা বেয়ে পড়ছে ঝরে
মিষ্টি মিষ্টি বিন্দু
আর সে খাচ্ছে চেটে
সেই সরল গ্রামের লোকটা আমি
আমার মাথায়
কে গেল রেখে
ঠাকুরের কবিতার বোঝা!
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct