বাইশে শ্রাবণ: সবাই বিষাদে মলিন
সনাতন পাল
“মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান/ মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজুট,/ রক্ত কমলকর, রক্ত অধরপুট/ তাপবিমোচন করুণ কোর তব/ মৃত্যু অমৃত করে দান”, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের প্রথম প্রভাতে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে অমৃতের স্বরূপ বলেই আহ্বান করেছিলেন ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীতে ‘মরণ’ কবিতায়। আবার “আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে/ তবু শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে”- গানটির আলোকে সহজে অনুমান করা যায় রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচিন্তায় নান্দনিকতার সফল উপস্থিতি আছে। অসীম প্রতিভাধর রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যকে যেমন বিশ্বস্বীকৃতি এনে দিয়েছেন, তাঁর চিন্তার স্তরে স্তরে যে মানবকল্যাণের বিচিত্র দিক প্রতিফলিত, রবীন্দ্র গবেষণায় এসব দিকও উঠে এসেছে। তবে সুদীর্ঘ সাহিত্যিক জীবনে রবীন্দ্রনাথ কে অনেক ঘাত প্রতিঘাত লালন এবং ধারণ করতে হয়েছে। বাল্য বয়সে কবির মায়ের মৃত্যু এবং পরবর্তীতে সন্তান ও স্ত্রীর অকাল মৃত্যু অন্যতম। মৃত্যুর মতো বেদনাবহ ঘটনা যেখানে সমগ্র মানব সত্ত্বাকে উলট পালট করে দিতে সক্ষম, সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একান্ত স্বজন হারিয়েও নিজেকে স্থির রেখেছিলেন। তবে কাব্য-সাহিত্যে কবির মৃত্যু দর্শন নানা অনুষঙ্গে বিকশিত ও সমন্বিত হওয়া থেকে উপলব্ধ হয়, তাঁরও অন্তঃস্থলে প্রচুর ভাংচুর চলেছে। যতই তিনি বেদনাবহ ঘটনাগুলো সসম্মানে আত্মস্থ করে উপেক্ষা করুন না কেন। কবি ‘নৈবেদ্য’ কাব্য গ্রন্থে’ মৃত্যু ‘ কবিতায় বলেছেন- ‘মৃত্যু অজ্ঞাত মোর/ আজি তার তরে/ ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ডরে/ এত ভালোবাসি/ বলে হয়েছে প্রত্যয়/ মৃত্যুরে আমি ভালো/ বাসিব নিশ্চয়।’ অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই ‘মৃত্যু’ এমনই এক বাস্তব সত্য যে, মৃত্যু সম্পর্কে বিশ্বাসের কোনো প্রয়োজন পড়ে না। রবীন্দ্রনাথ মৃত্যু নিয়ে অনেক ভেবেছেন। অল্প বয়স থেকেই মৃত্যু বিরহ কাতর হৃদয়ে একটি আর্তনাদ, এই দুঃখস্বর প্রশ্ন রূপে উত্থিত হয়েছে বার বার । কিন্তু পরিণত বয়সে বিশেষ করে বিদায়ের কয়েক বছর পূর্ব থেকে রবীন্দ্রনাথ মৃত্যু সমন্ধে বহু কবিতা লিখেছেন- সেগুলি কেবল প্রশ্ন নয়, মানুষের চির নিরুত্তর কিছু প্রশ্নের উত্তরও তার মধ্যে রয়েছে।
গুরুদেব একবার কঠিন রোগ থেকে মুক্ত পাবার পরে একখানা চিঠিতে লিখেছিলেন-”মৃত্যুর ভিতর দিয়ে ফিরে আসা সকলের ভাগ্যে ঘটে না। যদি ঘটে,তবে অন্তত তখনকার মত অহমিকা শিথিল হয়ে আসে, কতখানি স্থায়ী হয় বলতে পারিনে....” মানুষ সবচেয়ে বেশি ভয় করে মৃত্যুকে। তাই সব সময় মৃত্যুকে এড়িয়ে পালিয়ে বেড়াতে চায়। তবুও মৃত্যুকে আলিঙ্গন না করে কোনো উপায় নেই। যে কোনো মানুষের ক্ষেত্রেই সে কখন আসবে আমরা তা কেউ জানি না। কখনও কাক ভোরে, কখনও বা গোধূলি বেলায় কিংবা ভরা দুপুর বেলায়, আবার কখনও নিশুতি রাতে সে হঠাৎ করে বিনা আমন্ত্রণে এসে কড়া নাড়বে। তখন হয়তো এতোটাই যাবার তাড়া থাকবে যে, চাওয়া- পাওয়ার হিসেব মেলানো সম্ভব হবে না। যেতে না চাইলে এবং হাজার মন খারাপ করলেও থেকে যাবার কোনো উপায় থাকবে না। এটাই চরম সত্য। কিন্তু এই সত্যটাকে ভাবলেই মন কেমন করে ওঠে। আমরা সকলে সারা জীবন প্রাণপণ শুধু বাঁচার জন্যই লড়াই করি। এই লড়াইয়ের সময়, স্থান, কাল , পাত্র কিছুই নিদির্ষ্ট থাকে না । অবিরাম চলে এই লড়াই। কিন্তু এমন একটা ক্ষণ এসে উপস্থিত হয় যে, সেই ক্ষণে লড়াইয়ে হার মানতেই হয়। একথা অনেকেই মনে করেন যে, যাবার মুহূর্তে থাকার ইচ্ছেটা ভীষণই বেগবান হয়। একদিকে থেকে যাবার চরম চেষ্টা অপর দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। এই দুটি বিপরীত মুখী টান এতোটাই প্রবল হয়, যে কোনো একটা মুহূর্তে বন্ধনের সুতোটা ছিঁড়ে যায়।তখন চলে যেতে হয়। এই ক্ষণে ভীষণ মানসিক পীড়ার জন্ম নেয়। কিন্তু এই পীড়ার উপলব্ধির কথা কখনও কেউ কাউকে বলে যেতে পারে না। কারণ তখন এই যন্ত্রণা পরিজনকে বলার মত সময় থাকে না। মৃত্যু যন্ত্রণা কে কাব্য বা সাহিত্য গুণে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা প্রায় অসম্ভব। প্রকৃতি যেমনই থাকুক না কেন, কোনো মানুষই মৃত্যুকে খুশী মনে গ্রহণ করতে পেরেছেন এমন উদাহরণ আমাদের অজানা। অবশ্য বিপ্লবীদের ক্ষেত্রে তাদেঁর মুখের কথা বিবেচনা করলে মৃত্যু সম্পর্কে তাঁদের অনুভূতি ভিন্ন বলেই মনে হয়। কিন্তু এটাও হতে পারে যে তাঁদের মহান কর্তব্যের খাতিরে দেশের মানুষ কে অনুপ্রাণিত করতে হয়তো তাঁরা মনের গভীরে জন্ম নেওয়া সমস্ত পীড়ার কথা মুখে প্রকাশই করেন নি। আমরা সবাই পরিজন কে নিয়েই বাঁচি। কখনও একথা ভাবি যে পরিজন ছাড়া হয়তো আমাদের বাঁচাই অসম্ভব। কিন্তু বাস্তবে সেটা প্রতিফলিত হয় না। কারণ পরিজন বিয়োগের যন্ত্রণা অবশ্যই ভীষণ কঠিন, একথা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু সে যন্ত্রণা নিশ্চয়ই এতোটা নয় যে , তাকে ছাড়া বাঁচা সম্ভব নয়! বাস্তব তো এটাই যে সমস্ত যন্ত্রণা কে আমরা সহ্য করেই বেঁচে থাকতে সক্ষম হই। তা না হলে যে সকল পিতা- মাতা তাঁদের সন্তানকে হারান, সেই দুঃখে তাঁদেরও মৃত্যু ঘটত। কিন্তু বাস্তবে সেটা ঘটে না। কোথাও এর ব্যতিক্রম ঘটতেই পারে কিন্তু ব্যতিক্রম কখনই সাধারণ নিয়ম হতে পারে না।
সারা বিশ্বখ্যাত কবি রবীন্দ্রনাথ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২শে শ্রাবণ সমগ্র বাঙালি জাতিকে অভিভাবকহীন করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে অমৃতলোকে গমন করেছিলেন । এই দিনটি সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে বড় বেদনার দিন। ২২শে শ্রাবণ এলে অশ্রু সজল সবাই মলিনে বিষাদ। এই দিনটিতে এপার বাংলা এবং ওপার বাংলায় নানা রকম অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কবিকে স্মরণ করা হয়। বাইশে শ্রাবণ সম্পর্কে বলতে গেলে একথা অবশ্যই বলা দরকার যে কবি প্রয়াণে বাঙালির মনে যে শূন্যতা এবং বেদনার সৃষ্টি করেছে সেই শূন্যতা শ্রাবণের বৃষ্টির ধারাতে সামন্যতম পূরণ করতে পারে না। বরং কবি বিয়োগের বিরহ যাতনা যুগ যুগ ধরে একই রকম ভাবে বয়ে চলেছে। এই যাতনার কোথাও কোনো ছেদ নেই। অন্য কোনো ব্যক্তির মৃত্যু দিবসে এতোটা আবেগ সাধারণত খুব কমই দেখা যায়। আগামীতেও হয়তো বাইশে শ্রাবণ স্বমহিমায় আপন তালেই চলবে। এই দীর্ঘ শোক সৃষ্টির মূল কারণই হলো কবি গুরুর সৃষ্টি। তাঁর লেখা কবিতা এবং গান মানুষের কোন্ ক্ষণের সঙ্গী নয় ? উনার সর্ব শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি রবীন্দ্র সঙ্গীত সুখে যেমন প্রাসঙ্গিক দুঃখেও তেমনি প্রাসঙ্গিক। প্রেমে যেমন হৃদয়ে গোলাপের পাপড়ি মেলে বিরহে তেমন হৃদয়কে সঙ্গ দেয়। বাঙালি মনে সমস্ত আকুলতা- ব্যাকুলতা, আশা-আকাঙ্খা সবেতেই গুরুদেবের সৃষ্টি মানব হৃদয়ে অসাধারণ প্রাসঙ্গিকতার খোঁজ মেলে। তাই তো বাইশে শ্রাবণের গুরুত্ব আমাদের সকলের কাছে আদি অনন্তকাল ব্যাপী স্মরণীয়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct