বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থায় মুসলিম দেশগুলোর জোরালো উপস্থিতি নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মুসলিম দেশগুলো মূলত দু’টি শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়। বিশ্বের সব মুসলিম দেশ ওআইসির সদস্য হিসাবে একধরনের ঐক্যের সুতায় বাঁধা থাকলেও ঔপনিবেশিক শক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে এমনই বিভাজন রেখা টেনে গেছে যাতে এক অপর দেশের শত্রুতার বীজ বপন হয়ে আছে। তাই মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে অনাগ্রাসন চুক্তির প্রস্তাব স্মরণীয় হয়ে উঠছে। এ নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ দ্বিতীয় কিস্তি।
এমনই অবস্থায় একটি গুণগত পরিবর্তনের জন্য ২০১৮ সালে তুরস্ক যখন ওআইসির সভাপতির দায়িত্বে ছিল তখন তুর্কি শিক্ষাবিদ লেখক ও ইস্তাম্বুল মেডিপোল ইউনিভার্সিটির যোগাযোগ বিভাগের অধ্যাপক ইহসান আকতাস মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে একটি অনাগ্রাসন চুক্তির প্রস্তাব করেন। সম্প্রতি কাতারের আমির তুরস্ক ও ইরানের কাছে একই ধরনের প্রস্তাব দিয়েছেন। এর পথ ধরে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ব্যাপকভিত্তিক বা অঞ্চলভিত্তিক এই অনাক্রমণ চুক্তি হতে পারে। অধ্যাপক ইহসান আকতাস উল্লেখ করেন, প্রথম ধারণা হিসাবে, শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্রগুলো একত্র হতে পারে এবং একটি অ-আগ্রাসন চুক্তি গঠন করতে পারে। তুলনামূলকভাবে নিরাপদ তুর্কি রাষ্ট্রগুলো এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, লিবিয়া গৃহযুদ্ধে টুকরো টুকরো হবার উপক্রম হয়। তখন লিবিয়া ইস্যুতে পাঁচটি মুসলিম দেশ তুরস্কের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তুরস্ক সক্রিয় ভূমিকা না নিলে লিবিয়া আজ সিরিয়ায় পরিণত হতে পারত। অনেক পশ্চিমা দেশ হানাদার হয়ে আসত; লিবিয়ানরা হয়তো আরো ৫০ বছর ধুঁকতে থাকত। অনাগ্রাসনের একটি ইসলামী চুক্তির ধারণা প্রথম নজরে অনেকের বিরক্তিকর মনে হতে পারে। কারণ ২০০ বছর ধরে, পশ্চিমারা বিশ্বব্যবস্থা এবং নিরাপত্তা স্থাপত্যের অবয়ব দিয়েছে। মুসলিম দেশগুলো নিজেদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগের কারণে পশ্চিমাদের দখলদারিত্ব, শোষণ বা কারসাজির শিকার হয়েছে। এ ধরনের চুক্তি মুসলমানদের একে অপরের সাথে সম্পর্কিত নিরাপত্তা উদ্বেগ হ্রাস করবে এবং একইভাবে তারা পশ্চিমাদের অবাঞ্ছিত প্রভাব থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখতে সক্ষম হবে।
একটি বিষয় স্মরণীয়, ইসলামের উত্থান ও প্রাধান্য যে এশিয়ায়, সেই মহাদেশটিই ইতিহাসের বেশির ভাগ সময় বিশ্ব শাসন করেছে। উপরন্তু, অটোমান রাষ্ট্র ৪০০ বছর ধরে ইউরোপীয় ব্যবস্থার মধ্যে দৃঢ়ভাবে বিদ্যমান ছিল। বিশ্বের ঐতিহ্যগত নিরাপত্তা দৃষ্টান্ত আজ ভেঙে পড়েছে। এখন ন্যায়বিচার ও সহানুভূতিভিত্তিক একটি নতুন ব্যবস্থা প্রয়োজন। নতুন বিশ্বব্যবস্থাকে অবশ্যই উন্নত মানব মনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং আধুনিক সমাজের নিরাপত্তা ও কল্যাণের চাহিদা পূরণে সক্ষম হতে হবে। ইউরোপের পক্ষে এমন নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা আর সম্ভব বলে মনে হয় না। এ ধরনের পদক্ষেপের জন্য মুসলমানদেরকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। ইসলামিক দেশগুলোর অনাগ্রাসন চুক্তি প্রতিষ্ঠা তৃতীয় মুসলিম পুনর্জাগরণের সূচনাও হতে পারে- কারণ এই জাতীয় ধারণাগুলো কেবল নিরাপদ পরিবেশে বিকাশ লাভ করে। ইসলামিক দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর এসব দেশের উপর প্রভাব ও শোষণকে শক্তিশালী করে। অনেকের মতে, পশ্চিমা দেশগুলো এই ধরনের পরিস্থিতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করবে। ধারণা হিসাবে এটি ওআইসিতে সভায় গৃহীত হলে পরে পর্যায়ক্রমে বা অঞ্চলভিত্তিক তা বাস্তবায়ন হতে পারে।
পশ্চিমা ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইসলামী দেশগুলোর ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করেছে। বর্তমানে ইরান, সৌদি আরব, ইয়েমেন, মিসর, লেবানন, কাতার, সিরিয়া প্রভৃতি ইসলামী দেশগুলোর মধ্যে বিরোধ তাদের দুর্বল করে দিচ্ছে। ফলে এসব দেশের প্রায় সব সম্পদই অস্ত্রের জন্য পশ্চিমাদের কাছে চলে যাচ্ছে। তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, গুরুত্বপূর্ণ খনিজ, আফ্রিকার সমস্ত সম্পদ- যে অর্থ মানব কল্যাণে ব্যয় করার কথা তা অস্ত্র এবং স্বৈরশাসকদের উচ্ছৃঙ্খলতায় ব্যয় করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা তার প্রতিপক্ষ শক্তি প্রকৃতপক্ষে মুসলিম বিশ্বে কোনো শক্তিশালী রাষ্ট্র চায় না, যার মধ্যে রয়েছে তুরস্ক, ইরান বা সৌদি আরব। ফলে তারা এসব রাষ্ট্রের বিরোধ নানাভাবে জাগিয়ে রাখতে চায়। ইসলামী সম্মেলনে ঐতিহ্যবাহী রাষ্ট্রগুলো অর্থাৎ তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও মিসরের ক্ষমতাবান হওয়া ভবিষ্যতের জন্য আশাব্যঞ্জক। আগে তেলসমৃদ্ধ আরব দেশগুলো বেশি কার্যকর ছিল। এখন এর সাথে প্রযুক্তি ও সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক অগ্রসর দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এখন, ওআইসি, বিশেষ করে শক্তিমান ইসলামী দেশগুলো একটি অনাগ্রাসন চুক্তির উদ্যোগ নিতে পারে। তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তান, মিসর এবং সৌদি আরব যদি একটি অনাগ্রাসন চুক্তিতে স্বাক্ষর করে তবে ক্ষমতাধর পশ্চিমা কোনো দেশ এদের শাসকের দিকে আঙুল নাড়তে অক্ষম হবেন এবং বলতে পারবেন না, এটি যদি আমার জন্য না হয় তবে আপনি ১৫ দিনের বেশি সময় টিকে থাকতে পারবেন না। অথবা অন্য কোনো দেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে সাতবার ভাবতে হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct