বুড়িমা
তাপস কুমার বর
রমেশ বাবুর চায়ের দোকানে সেদিন, সুদীপ স্যার, সৌমেন কাকু ও সুকেশ জ্যেঠু তাসের আড্ডায়, বাজি ধরা খেলাতে প্রতিবারের মতো এবারে ও বেশ তর্ক যুদ্ধ চলছিল। সেই সময় হঠাৎ একটা ভিখারি বুড়িমা রমেশ বাবুর চায়ের দোকানের কাছে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বললো... “বাছা, কাল থেকে পেটে একমুঠো খাবার জোটেনি, অন্যের দরজায় দরজায় কত ঘুরেছি, কেউ একবার ও খেতে বলেনি, পেটে খিদের জ্বালা! কিছু খাবার দিবি”? হঠাৎ সকলে চুপ! সুদীপ স্যার বললো বুড়িমা কোথায় থেকে আসছেন? বুড়িমা কিছুক্ষণ চুপ, তার পর সুকেশ জ্যেঠু বললো “ও বুড়িমা কোথা থেকে আসছেন? তখন বুড়িমা বললো “বাছা কানে একটু কম শুনি, জোরে না বললে শুনতে পাইনা বাছা! বয়সটাও কম হলো না যে”! সেদিন রমেশ বাবুর চায়ের দোকানে সকলের মনে একটা মানবিকতা জেগে উঠেছিল। সুদীপ স্যার বললো, দেখেছো সৌমেন মানুষ কত স্বার্থপর হয়? সৌমেন বললো একদম ঠিক কথা বলেছেন। সকলে একটা বিস্ময় নিয়ে ভিখারি বুড়িমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। রমেশ বাবু বুড়িমাকে দোকানের ভেতর ডেকে চা ও বিস্কুট খেতে দিলেন। এদিকে তাসের আড্ডায় কারোর আর মন বসলো না। সকলে বুড়িমার কাছে এসে বসলো। সকলে জানতে চায় কেন তিনি শেষ বয়সে ভিক্ষা করছেন? ও বুড়িমা আপনার কি কোন আত্মীয়-স্বজন,ছেলে-মেয়ে নেই? বুড়িমা চা খাওয়া শেষ করলো। সকলের আগ্রহে তিনি সায় দিয়ে বললেন -- “বাছা, তোমরা আমার জীবনের ঘটনা শুনতে চাও? সকলে একসাথে বললো হ্যাঁ বুড়িমা”!
বুড়িমা তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া নির্মম পরিনতির কথা জানাতে শুরু করলো। বুড়িমা বললো বাছা, আমার বাড়ি মহেশপুর গ্রামে। এখান থেকে প্রায় ১০০০ কিলোমিটার দূরত্ব।আমার এক ছেলে ছিল তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ও দেখেছি। কিন্তু ভগবান সেই সুখ আমার কপালে বেশি দিন রাখেনি। ছেলের বয়স তখন মাত্র তেরো বছর হঠাৎ একটা পথ দুর্ঘটনায় ছেলেটা মারা যায়। তখন সংসারে আমরা তিনজন ছিলাম।আমাদের পরিবারটা শেষ হয়ে গেলো,ছেলের চিন্তাতে সব সময় মনটা বিমর্ষ হয়ে থাকতো। এইভাবে বছর তিনেক কেটে গেলো। তার পর হঠাৎ একদিন স্বামী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলো। সংসারটা ভেসে গেলো....”সুখ তুমি কত নিদারুণ পরিক্ষা নিলে আজ আমার সংসারটা খালি করে”! পাড়া প্রতিবেশীরা প্রথমে আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছে। এইভাবে কোন মতে টেনেটুনে দিন চলছিল। প্রকৃতি কত নিষ্ঠুর? হঠাৎ বন্যার জলে মহেশপুর গ্রাম সব জলের তলায় তলিয়ে গেলো। বাঁচার আর কিছু অবশিষ্ট রইলো না বাছা। তার পর পেটের যন্ত্রণায় এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করি। রমেশ বাবুর চায়ের দোকানে সুদীপ স্যার বললো বড়োই নিষ্ঠুর পরিনতি। সকলে মাথা নাড়লেন। সকলে দেখতে পেলো বুড়িমার হাসির আড়ালে কত যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে। দু-চোখ দিয়ে অশ্রু বন্যা বইতে চাইতে। মনে হয় কোন একটা আঘাত চোখের শুকনো জল কোটরে শুকিয়ে শুকিয়ে সঞ্চিত হয়ে রয়েছে! আজ বুড়িমার জীবন পাথরের আঘাতে নিরুত্তর থেকে গেছে। রমেশ বাবুর চায়ের দোকানে সুকেশ জ্যেঠু বললো-”আচ্ছা সুদীপ আমাদের বাড়ির বাম পাশে একটা খালি ঘর পড়ে আছে, ওখানে বুড়িমাকে রাখলে কেমন হয়? সকলে উৎসাহে চেঁচিয়ে উঠলো বললো “খুব ভালো হবে সুকেশ জ্যেঠু বুড়িমা তো আমাদের মায়ের মতো”! এই কথা শুনে বুড়িমার দু-চোখ অশ্রুতে ভরে গেলো। বললো “বাছা আজ থেকে তোমরা আমার ছেলে”!
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct