পরিণতি
সনাতন পাল
মাটির কুঁজো লাগবে নাকি! কুঁজো! হাঁক শুনেই ছোট্ট বিমল দৌড়ে কুমোরের কাছে গিয়ে বলল-” হ্যাঁ গো কাকা, তোমাদের বাড়ী কোথায় গো ? “ কুমোর বলল- “ আমার বাড়ী ঐ মহানন্দার পাড়ে গো, বাছা।” কুমোর কাকার কথা শুনে বিমল বলল-” মহানন্দা! সে তো মায়ের মুখে ঢের শুনেছি। মা বলেন, ঐ নদী দিয়ে নাকি বেহুলা তার সাপে কাটা স্বামী লখীন্দরের মৃত দেহ নিয়ে ভাসতে ভাসতে বয়ে গেছে ! আমাদের বাড়িটাও যদি তোমাদের মত মহানন্দার পাড়ে হতো, তাহলে কত্ত ভালো হতো, তাই না কাকা! এখনও কি ঐ নদীতে জলে ভর্তি আছে? বড় বড় নৌকা চলে? স্রোত আছে?, পাল তোলা নৌকা দেখা যায়?” কুমোর কাকা বলল- “ বর্ষার সময় নদীর বাঁধ ভেঙে পাড়ায় জল ঢোকে , আর আমরা সবাই তখন একটু দূরের একটা ইস্কুল আছে, সেখানে গিয়ে উঠি। মাটির কাঁচা হাঁড়ি কলসি গুলো সব নষ্ট হয়ে যায়, তখন গরু- বাছুর গুলো কে নিয়ে ভীষণ সমস্যায় পড়ি। দিন-রাত্রি ট্রাক্টর করে চুরি করে বালি কেটে কেটে একদম শেষ করে দিল। যে ভাবে বালি কাটছে , তাতে এবার বর্ষা এলে বাঁধ একদম নিরাপদ থাকবে না, বাঁধ ভেঙে হু হু করে গ্রামে জল ঢুকে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে । এখন খরার দিনে একদম জল নেই। নৌকা চলা তো দূরের কথা, মাথা তলিয়ে স্নান পর্যন্ত করা যায় না। “ বিমল বলল-” জল নেই কেন? জলও কি বালির মত চুরি করে নিয়ে গেছে নাকি? “ কুমোর বলল- “ চুরি করে নিয়ে গেলে কি আর নদীর জল কমে ? নদীর গর্ত একদম কমে গেছে, পলিতে ভরাট হয়ে গেছে- সংস্কার করার কেউ নেই। ফলে গর্তের গভীরতা কম হবার কারণে একদিকে এমনিতেই কম জল ছিল, অপর এদিকে রোদে সেই জল টুকুও শুকিয়ে গেছে, তাই আজ আর নদীতে তেমন জল নেই।” বিমল বলল-” তাই বলো , এবার বুঝেছি। রবি ঠাকুরের লেখা সহজ পাঠ বইয়ে পড়েছি-’ আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে..’। সেই কথা একদম তোমার কথার সাথে মিলে গেল।” কুমোরের হাঁড়ি বিক্রি করার ভীষণ তাড়া থাকলেও বিমলের কথা কে পাশ কাটিয়ে সে যেতে পারল না। তার বড় ছেলে পরেশ বেঁচে থাকলে বিমলের বয়সই হতো। বিমলকে দেখে কুমোরের তার নিজের ছেলের কথা মনে পড়ে গেছে। তাই বিমলের সাথে খানিকক্ষণ কথা বলে নিজের আত্মাকে কিছু টা জিরিয়ে নিলেন।
বৈশাখ মাস, প্রচন্ড গরম। এবারে জল তেষ্টা-টা একটু বেশি। কুমোর, বিমলকে বলল-” তোমাদের বাড়ীতে মাটির কুঁজো নেবে নাকি?” বিমল বলল-” একটু দাঁড়াও , মায়ের কাছে শুনে আসি”। ছেলে মায়ের কাছে দৌড়ে গিয়ে মাটির কুঁজোর কিনবে কি না, সেটা জিজ্ঞেস করল। মা, ছেলের কথা শুনে বাইরে কুমোরের সাথে দেখা করতে বেরিয়ে এলো। এসে কুমোর কে বলল-” আমাদের বাড়ীতে ফ্রিজ আছে। সেখানে জল বোতলে করে রাখা থাকে । ঐ ঠান্ডা জলের সাথে খানিকটা সাধারণ জল মিশিয়ে মাঝারি ধরণের ঠান্ডা করে খাই। তাই মাটির কুঁজো লাগবে না।” শুনে কুমোর বলল-” প্ল্যাস্টিকের বোতলে ফ্রিজে জল রেখে ঠান্ডা করে খাওয়ার চেয়ে মাটির কুঁজো-তে জল রেখে খাওয়া অনেক ভালো, গো দিদি- গ্যাস অম্বল কম হবে, হজম ভালো হবে। “ বিমলের মা রেখা দেবী বলল-” কোথায় রাখবো? ঘরে রাখার জায়গা নেই। কুঁজো টা একটু আঘাত লাগলেই ভেঙে যাবে”। কুমোর শেষে বুঝল যে, সেখানে আর কিছু হবার নয়। অবশেষে সেখানে থেকে রওনা দিল। আর সেই একই হাঁক-” মাটির কুঁজো লাগবে নাকি! কুঁজো.... !” সারাদিন ঘুরে ঘুরে সে সব গুলো কুঁজো এবং কলসি বিক্রি করতেই পারল না। অবশেষে অনেকটা দূরে একটা আদিবাসী পাড়াতে গিয়ে কটা কলসি বিক্রি করল। সেই দিয়ে চাল-ডাল যা জুটল, কিনে নিয়ে বাড়ীতে এলো। ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। নিরুপায় কুমোরের বাড়ীতে অবেলাতেই রান্না হল। এমন সময়ে খাওয়া হলো তাতে রাতে আর আলাদা করে আর খাওয়ার দরকার পড়ল না। এমনি ভাবেই প্রতিদিন দুপুর আর রাত মিলে একবার করেই ওদের খাওয়া জোটে। এখন যে খাওয়ার কষ্ট টা হচ্ছে সেটা বেশ কয়েক বছর আগে হয় নি। তখন তো এতো প্লাস্টিকের জিনিসের আমদানি হয়নি। ঘরে ঘরে ফ্রিজ হয়নি। এতো স্টিলের জিনিসপত্রের ব্যবহার শুরু হয়নি। পেটের সমস্যার জন্য অনেক মধ্যবিত্ত বাড়িতেও খরির উনোনে মাটির হাঁড়িতে ভাত রান্না হতো। মাটির কুঁজো এবং কলসির জল প্রাণ ভরে খেত । এখন তো সে সবের বালাই নেই। কুমোরকে গ্রামের সবাই খগেন নামেই জানেন । বহু কষ্টেই নানা টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে এই ভাবেই খগেনের দিন কাটে । তাঁর এক ছেলে আর এক মেয়ে আছে । ছেলে নকুল পড়াশোনা বাদ দিয়ে চায়ের দোকানে কাজ করে। হাতে থেকে পড়ে গিয়ে হঠাৎ করে কাপ প্লেট ভাঙলে নকুলের কপালে যেমন মালিকের প্রহার জোটে, তেমনি মাইনে থেকে তার দামটাও কেটে নেয় । এমন মাসও গেছে যে, সারা মাস কাজ করেও ছোট্ট নকুল কোনো মাইনেই পায়নি, ভাঙা কাপ প্লেটের ক্ষতিপূরণ দিতেই সব চলে গেছে।
ইতিমধ্যেই খগেনের মেয়ে, মায়ার বিয়ের দেখা শোনা চলছে। ছেলে একজন প্রাথমিক শিক্ষক। ছেলে পক্ষের মায়াকে পছন্দ হয়েছে। দেনা- পাওনার চাহিদা মিটে গেলেই হয়তো বিয়েটা হয়ে যাবে। ছেলের বাবা বলছে-” শুনুন মশাই, আপনার মেয়ে সুন্দরী তাই পছন্দ না হবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু শুধু সুন্দর ধুয়ে জল খেলেই তো আর হবে না! কিছু নগদ লাগবে। জানেন তো, প্রাইমারি মাস্টারদের এখন বাজার দর কি চলছে? আর হবে নাই বা কেন? এখন তো আর শুধু ডিগ্রি দেখিয়ে চাকুরি হয় না, সঙ্গে মোটা টাকা খরচাও করতে হয় । আমারও বেশ ভালো খরচা করতে হয়েছে। বিয়ে থেকে খরচ টা একটু তুলে নিতে পারলেই, ব্যস্ । খগেন বলল - “তা কত খরচ হয়েছে ?” ছেলের বাবা বিনয় বাবু বিনয়ের সাথে বললেন-” বেশি না ঐ লাখ পাঁচেক হবে “। শুনে খগেন মাথায় হাত দিয়ে বলল-”পাঁচ লাখ !”, সে তো অনেক টাকা । আমার তো অতো টাকা দেবার সামর্থ্য নেই। বিনয় বাবু বলল- “আহা! আরে মশাই, চিন্তা করছেন কেন? আপনি লাখ তিনেক দিলেই চলবে। বাকি দুইলাখ ধীরে ধীরে ছেলে স্কুল থেকেই ম্যানেজ করে নেবে । খগেন বলল-” স্কুল থেকে আবার কি করে ম্যানেজ করবে? উত্তরে বিনয় বাবু বললেন- “ আপনি ওসব ফাঁক ফোকর বুঝবেন না।” শেষে দুই লাখে রফা হলো। খগেনের কাছে কোনো টাকা নেই তবুও বিয়েতে রাজি হলো।কারণ সে ভাবল - “চাকুরি ওয়ালা ছেলে কোনো মতেই হাত ছাড়া করা যাবে না।” কিন্তু খগেন আগেই বলেছে যে সে আগে কোনো টাকা দিতে পারবেন না, সব পাওনা গন্ডা বিয়ের দিন রাতেই মিটিয়ে দেবেন। অবশেষে চার হাত এক করার দিন হাজির হলো। । বর এসে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে। ইতিমধ্যে বর কর্তা, ছেলের জামাইবাবু সমস্ত পাওনা গন্ডা বুঝে নিতে চাইলেন। বললেন-” সব বুঝে না পেলে বর উঠিয়ে নিয়ে যাবো”। তারপরে খগেন খুব কাকুতিমিনতি করে বলল- “ ছয় মাসের মধ্যে সব মিটিয়ে দেবো “। কিন্তু পরিস্থিতি শান্ত হবার নয়। অবশেষে লোকমুখে খবর পেয়ে পাড়ার মস্তান রাজু এলো। রাজু সব শুনে বলল-” খগেন কাকা তো বলছেই যে, আগামী ছয় মাসের মধ্যে সব মিটিয়ে দেবে, তাহলে আবার এতো কথা কিসের ? “ যে যাই বলুক না কেন! বিয়ে ভাঙা যাবে না, এ বিয়ে হবেই। শুনে ছেলের জামাইবাবু তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বলল- “আপনার কথা মত বিয়ে হবে নাকি ?” বলতেই তৎক্ষণাৎ রাজু রেগে গিয়ে বরের পিঠে সেঁটে একটা লাথি মারল। বর গিয়ে উপুর হয়ে বিয়ের ঘটের উপরে মুখ থুবড়ে পড়ল। নিজের পিঠেও কয়েক ঘা পড়ার সম্ভাবনা দেখে - বর কর্তা সিদ্ধান্ত বদল করতে বাধ্য হলো।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct