ইস্তাম্বুলের ডলমাবাহচে প্রাসাদে অনুষ্ঠিত হলে ‘ইউক্রেনীয় বন্দর থেকে শস্য ও খাদ্যসামগ্রীর নিরাপদ পরিবহণের উদ্যোগ’ নামক শীর্ষ সম্মেলন। এই সম্মেলনে তুরস্ক ও জাতিসংঘ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছে। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দেশ একটি চুক্তিতে উপনীত হয়। এই চুক্তি বিশ্বের লাখ লাখ মানুষকে খাদ্যের জন্য অসহনীয় মূল্য পরিশোধ করা থেকে বাঁচাবে। বিভিন্ন পক্ষ শস্য পরিবহণের জন্য ইস্তাম্বুলে একটি যৌথ অপারেশনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে সম্মত হয়েছে। এ নিয়ে লিখেছেন বুরহানেত্তিন দুরান।
গত ২২ জুলাই ইস্তাম্বুলের ডলমাবাহচে প্রাসাদে অনুষ্ঠিত হলে ‘ইউক্রেনীয় বন্দর থেকে শস্য ও খাদ্যসামগ্রীর নিরাপদ পরিবহনের উদ্যোগ’ নামক শীর্ষ সম্মেলন। এই সম্মেলনে তুরস্ক ও জাতিসংঘ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছে। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দেশ একটি চুক্তিতে উপনীত হয়। এই চুক্তি বিশ্বের লাখ লাখ মানুষকে খাদ্যের জন্য অসহনীয় মূল্য পরিশোধ করা থেকে বাঁচাবে। এই উদ্যোগের আওতায় বিভিন্ন পক্ষ শস্য পরিবহনের জন্য ইস্তাম্বুলে একটি যৌথ অপারেশনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে সম্মত হয়েছে। এই উদ্যোগের ফলে ইউক্রেনের বন্দরগুলো অবরোধমুক্ত হয়েছে। এটি ২০ মিলিয়ন টন শস্যের সরবরাহকে সুরক্ষিত করেছে। এই কৃতিত্ব মূলত তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের। তার ‘সংকল্পিত’ প্রচেষ্টার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। অথচ দ্য ইকোনমিস্ট এই উদ্যোগকে ‘একটি ভূরাজনৈতিক সংকীর্ণ পথে হাঁটা’ হিসেবে বর্ণনা করেছে? কী ভুল ভাষ্য!
শস্য করিডরটি খুলে যাচ্ছে। কারণ ইউক্রেন ও রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে এনে তুরস্ক তাদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। তুরস্ক কাকতালীয়ভাবে বা ‘একটি ভূরাজনৈতিক সংকীর্ণ পথে হেঁটে’ কিয়েভ ও মস্কোর আস্থা অর্জন করেনি। এই উদ্যোগ ছিল উভয় দেশের প্রতি তুরস্কের নীতির ফলস্বরূপ। যুদ্ধের আগে ও যুদ্ধকালীন কয়েক দফা যে আলোচনা হয়, সেই নতুন অগ্রগতিরও ফসল। তদুপরি, পরাশক্তি প্রতিযোগিতার প্রতিক্রিয়ায় এরদোগানের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার জন্যই চুক্তিটি করা সম্ভব হয়েছে। বিশ্বব্যবস্থা বহুমুখীকরণে বৈশ্বিক পরিবর্তনের যে ঢেউ উঠেছে, এটি তার গতিকে ত্বরান্বিত করল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে একটি শস্য করিডর তৈরি করা নিঃসন্দেহে একটি একক উত্সাহব্যঞ্জক ঘটনা। তবে যুদ্ধবিরতি এবং পরবর্তীকালে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আরো অনেক পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে তুরস্ক কূটনৈতিক উদ্যোগ অব্যাহত রাখবে। প্রকৃতপক্ষে এরদোগান চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে এ কথার ওপর জোর দেন যে, আসলে ‘যুদ্ধে কোনো বিজয়ী পক্ষ নেই’। এজন্য তিনি ‘ন্যায্য শান্তি’ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, যুদ্ধের বিভিন্ন পক্ষ (ও তাদের সমর্থকেরা) লড়াই চালিয়ে যেতে যেমন সক্ষম, তেমনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞও। ফলে শিগ্গিরই শান্িত অর্জনের আশা করা বৃথা।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ও পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিক্রিয়ায় শুধু যুদ্ধ উন্মাদনা বা ইউরোপে নিরাপত্তার সংকট তৈরি হয়নি, সত্যিকার অর্থে এর ফলে একটি নতুন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ক্রমাগত জ্বালানি, খাদ্য ও পণ্যসংকটগুলো বিশ্বব্যাপী মন্দার সূত্রপাত করতে সক্ষম হয়েছে। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিশেষজ্ঞদের দাবি অনুযায়ী এর ফলে পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়ার মধ্যে নতুন করে শীতল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তারা জোর দিয়ে বলছেন যে, ইতিমধ্যে পশ্চিমা আধিপত্যের অবসান হয়েছে এবং বহুমেরুকরণের পরিবেশে একটি নতুন পরাশক্তির উত্থানের প্রতিযোগিতা চলছে। সেই নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতা পশ্চিমা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শীতল যুদ্ধের বিপরীত পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছে। বাইডেন প্রশাসনের ‘গণতন্ত্র বনাম কর্তৃত্ববাদী’ বক্তৃতা ‘কমিউনিস্ট হুমকি’ প্রতিস্থাপন করার জন্য পর্যাপ্ত আদর্শিক পুঁজি তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। চীন ও ভারতসহ বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো কেবল পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়ার মধ্যে মেরুকরণের পক্ষ হতে অস্বীকার করেনি, বরং একটি নতুন ভূরাজনৈতিক পরিবেশ তৈরির জন্য কিছু উদ্যোগও তারা নিতে শুরু করেছে। একই সময়ে রাশিয়াকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। রাশিয়ার এই প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ‘পশ্চিমা-পরবর্তী যুগ’ এবং বহুমেরুকরণবাদের রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করছে। এইভাবে পরাশক্তি প্রতিযোগিতার আসল বিষয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তা একটি নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে।রাশিয়ার বিচ্ছিন্নতার ওপর জোর দেওয়ার কারণে তা বেইজিং ও মস্কোর মধ্যে সম্পর্ককে স্থায়ী করতে পারে। এ কথা চিন্তা করে ওয়াশিংটনের নীতি বিশেষজ্ঞরা এখন উদ্বিগ্ন। প্রকৃতপক্ষে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার পশ্চিমা প্রচেষ্টা কার্যকর হবে না যতক্ষণ না মস্কো হাল ছেড়ে দেয়। এরদোগানের তুরস্ক সেই দেশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, যারা অনিশ্চয়তা ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রস্তুত।
লেখক: ইবনে হালদুন (বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct