২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে, দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ৬৪%, কিন্তু আদিবাসী মহিলাদের সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ৪২%। আর শিক্ষাক্ষেত্রে সমগ্র দেশে স্নাতক ৯% এর কাছাকাছি হলেও আদিবাসী মহিলাদের মধ্যে ৩% এরও কম। আবার স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে শিশুমৃত্যুর হার বা শিশুকন্যার অপুষ্টি, কিংবা রক্তাল্পতায় আক্রান্ত নারীর কথাই বলুন, দেশে আদিবাসী নারীদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। তাই আদিবাসী মহিলা রাষ্ট্রপতি হলেই কি সব পাল্টে যাবে? এ নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন যোগেন্দ্র যাদব। আজ শেষ কিস্তি।
ওর কথা শুনে আমার একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। ২২ জুন, দ্রৌপদী মুর্মুর এনডিএ-র রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হওয়ার খবর আসে। তার ঠিক ১০ দিন পরে, মধ্যপ্রদেশের গুনা জেলা থেকে খবর এলো যে সাহারিয়া উপজাতি সম্প্রদায়ের ৩৮ বছর বয়সী এক মহিলা, রামপ্যারিকে, জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। তাঁর পরিবারকে মধ্যপ্রদেশ সরকারের তরফ থেকে ৬ বিঘা জমি দেয়া হয়েছিল। ওঁর সঙ্গে কাগজপত্রও ছিল। কিন্তু জমি দখল করে বসেছিল আদিবাসী নন এমন সমাজের মানুষেরা। জবরদখল করার পরে তারা আবার সেখানে কৃষিকাজও করছিল। উপরন্তু, রামপ্যারির পরিবারকে হুমকিও দিচ্ছিল ওরা। এই ঘটনার ঠিক এক সপ্তা আগে, রামপ্যারি ও তাঁর স্বামী অর্জুন, পুলিশকে এই বিষয়ে বিস্তারিতভাবে জানায় এবং তাঁদের কাছে সুরক্ষাও চায়। কিন্তু, কিছুই করা হয়নি। রামপ্যারি যখন মাঠে গিয়ে আপত্তি জানান, তখন তারা সেখানেই ওঁর গায়ে ডিজেল ছিটিয়ে ওঁকে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ঘটনার ভিডিও-ও পাওয়া যায়। এইবারে আমি ভাবতে বসলাম, যদি দ্রৌপদী মুর্মু রাষ্ট্রপতি হন তাহলে কি রামপ্যারি ও তাঁর পরিবার ন্যায় বিচার পাবেন? এটা কি তাহলে নিশ্চিত হবে যে এদেশে আর কোনো রামপ্যারিকে দিবালোকে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হবে না?
চুপচাপ বসে বসে এইসব ভাবছিলাম। হঠাৎ, উনি বলে উঠলেন, দেখুন, আমিও প্রতীকের গুরুত্ব বুঝি। যদি রাষ্ট্রপতি শুধুমাত্র একটি রাবারের সিলমোহর হয়েই থাকেন, তবে আমি মুখার্জি, পাটিল, শর্মা বা অন্য কোনো সিনহা, রেড্ডি এবং যাদবের পরিবর্তে মুর্মু, সোরেন, মুন্ডা, রাথওয়া, মীনা বা অন্য কোনোও জাতব ও বাল্মীকির নাম দেখতে চাইব। যে সমাজ শত-সহস্র বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে ছিল সে সমাজ তখনই ন্যায়বিচার পাবে যখন তার প্রতিনিধিরা নিজেরা চেয়ারে বসবে। তিনি একনাগাড়ে কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন। এবারে আসল প্রশ্নটা হল, দলিত বা আদিবাসীরা ঠিক কোন পথ ধরে চেয়ার পর্যন্ত পৌঁছবে? একটা পথ হল, বাবাসাহেব আম্বেদকর, নেলসন ম্যান্ডেলা এবং মার্টিন লুথার কিং এর দেখানো বিপ্লবের পথ। অর্থাৎ সামাজিক ন্যায়বিচারের আন্দোলনের ভিত্তিতে বিতাড়িত সমাজের লোকেরা ক্ষমতা দখল করুক। তামিলনাড়ুর দ্রাবিড় আন্দোলন এবং কাঁশিরামের বিএসপি আন্দোলনও এই পথ ধরেই হয়েছিল। এই পথ দিয়ে ক্ষমতা লাভ করলে, বঞ্চিত সমাজের মানুষেরা মৌলিক সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারে। এ তো গেলো প্রথম পথ। দ্বিতীয় পথে আসি। সেই পথ দেখিয়েছেন বারাক ওবামা বা প্রেসিডেন্ট কে আর নারায়ণন। এই অত্যাশ্চর্য পথ অনুসরণ করে ক্ষমতা অর্জন সামাজিক ন্যায়বিচার আন্দোলনের মাধ্যমে হয় না। ক্ষমতা দখল করে কিছু নেতা তাদের ব্যক্তিগত প্রতিভা এবং আদর্শিক অঙ্গীকার বাদ দিয়ে সমাজের কিছু স্বার্থ পরিবেশন করতে সক্ষম হয়। আর তৃতীয় পথটিকে আপনি চামচা পদ্ধতিও বলতে পারেন আবার শিখণ্ডী মার্গও বলতে পারেন। যে সমস্ত বড়ো বড়ো বিতাড়িত সমাজের নেতারা এই পথ দিয়ে আসেন, তাঁদের চেয়ারে বসানোই হয় যাতে তাঁরা তাঁদের সমাজের প্রতি হওয়া অন্যায় ও অত্যাচারগুলোকে ঢেকে রাখতে পারেন। এই শ্রেণীর নেতারা যতই সক্ষম হোক না কেন, তাঁরা সরকারের সেফটি-ভালভ হিসেবে কাজ করে। যাতে প্রান্তিক সমাজের মানুষদের ক্ষোভ আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়তে না পারে। তাঁরা খুব দক্ষতার সাথে সামাজিক অন্যায় ও শোষণের ব্যবস্থাকে বজায় রাখতে পারে, যাতে এই শ্রেণিটির ভোটও পাওয়া যায় এবং প্রশাসনকে তাদের জন্য কিছু করতেও না হয়। দ্রৌপদী মুর্মু এই পথগুলির মধ্যে কোনটিকে অনুসরণ করবেন? এ প্রশ্নের উত্তর যেদিন পেয়ে যাব সেদিন আপনার অভিন্দনও আমি স্বীকার করে নেবো। এই খানেই তিনি তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন। কথাগুলো তো সবই সত্যি, কিন্তু কেনো জানি না, আমার মন এই কথাগুলো কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। তাই তখন আমি অন্য একজনকে খুঁজছিলাম যিনি আমার অভিনন্দন গ্রহণ করবেন।
লেখক ‘স্বরাজ ইন্ডিয়া’র প্রতিষ্ঠাতা।
অনুবাদ: প্রতীক্ষা ঘোষ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct